দেশের অর্থনীতির গতি কমে গেছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন না। আবার অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণও পাচ্ছেন না। ঋণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকাই নেই ব্যাংকে। তবে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ভালো, রেমিট্যান্স প্রবাহও (প্রবাসী আয়) বাড়ছে। কিন্তু আমদানি ব্যয়ের চাপ বেশি থাকায় ডলারের বাজারও টালমাটাল। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।
সব মিলিয়ে স্বস্তিতে নেই কেউই। চাপে আছে সাধারণ মানুষও। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি যত কমই দেখা যাক না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে বড় বিষয় হচ্ছে চাল, আলু, পেঁয়াজ, তরিতরকারিসহ নিত্যপণ্যের দাম। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য হচ্ছে, এক বছরে সরু চালের দাম ২৭ দশমিক ৪৫ এবং মোটা চালের দাম ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১১৪ শতাংশ। যাতায়াত ভাড়া ও সন্তানদের লেখাপড়া করানোর খরচের চাপ তো আছেই। শহরের মানুষের ওপর বাড়তি বোঝা বাড়িভাড়া। এসব খরচ করার পর মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষের হাতে টাকা থাকছে না।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি এবং দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর তিনটি কারণকে সামনে রেখে গোটা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। এগুলো হচ্ছে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ না থাকা, সুদের হার হঠাৎ বেড়ে যাওয়া এবং বন্দরে পণ্য খালাসে বেশি সময় লাগা।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতিতে অস্থিরতা চলছে। বোঝা যায় যে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। সংশয় আছে রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে। বছরের পর বছর ধরে বলার পর ঋণের সুদ সামান্য কমলেও এখন তা আবার আগের জায়গায় উঠে গেছে। ব্যাংকের মধ্যম পর্যায়ের কর্মীরা চিঠি দিয়ে বলছেন, দেড়-দুই শতাংশ সুদ বেশি দিতে হবে।
ছোট ব্যবসায়ীদের অবস্থাও খারাপ
শুধু যে বড় শিল্পপতিরা এই অবস্থার মধ্যে আছেন, তা নয়। মাঝারি এবং ছোটদের অবস্থাও প্রায় একই। বড় ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসাকে আরও বড় করতে দ্বিধায় আছেন। ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় পণ্য উৎপাদনের খরচও বেড়ে গেছে। ফলে মুনাফা কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণ মানুষের কাছে টাকার সরবরাহ ভালো থাকলেই তাঁদের ব্যবসা ভালো থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কেনাকাটা করার সাধ্য কমে গেছে।
এবারের মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় মানুষের কেনাকাটার সাধ্য কমার বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে। এবারের বাণিজ্য মেলায় ৮৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। অথচ আগের বছর বিক্রি হয়েছিল ১১৩ কোটি টাকার পণ্য।
দেশের ভোগ্য ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় দুই প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তাদের বেচাকেনায় কোনো প্রবৃদ্ধি নেই। অনেক ক্ষেত্রে বিক্রি কমে গেছে। ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি বলেছে, তারা চলতি বছর আর কোনো বিনিয়োগে যাবে না, বরং তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
রাজধানীর মৌলভীবাজার ও শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরাও জানান, কয়েক মাস ধরে পাইকারি কেনাবেচা ভালো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি রেজাউল ইসলাম মালিবাগ ও মৌচাক সুপার মার্কেটের কথা উল্লেখ করে বলেন, এখন বাজারের অবস্থা ভালো নয়। বেচাকেনা কম।
বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নির্বাচনের বছরে এমনিতেই বিনিয়োগ কম হয়। নির্বাচনের বছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারও কমে যায়। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা এ কথা স্বীকারই করেন। অর্থনৈতিক সমীক্ষাগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যতিক্রম ছাড়া অর্থনীতির মূল চলকগুলো নির্বাচনের বছরগুলোতে অত গতিশীল থাকে না।
কিন্তু ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ার কারণে বিনিয়োগ কম করতে হচ্ছে-এই উদাহরণ এবারই প্রথম। গত বছর ব্যাংকঋণের সুদের হার যে এক অঙ্কের ঘরে নেমেছিল, তা আবার দুই অঙ্কের ঘরে উঠে গেছে। সব মহল থেকেই এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত বুধবার রাতে আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় সুদের হার এক অঙ্কে নামানোর তাগিদ দিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতির গতিতে ভাটা পড়েছে হলফ করে তা বলা খুব কঠিন। বলতে গেলে অর্থনীতির নির্দেশকগুলো দিয়ে বলতে হবে। তবে ব্যাংকের চড়া সুদ, টাকার অভাবে ঋণ দিতে না পারা, ডলারের সংকট ও উচ্চমূল্য, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়, বিনিয়োগে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের অতি সতর্কতা-এই সব দেখে তো অর্থনীতির ভাটার কথাই মাথায় আসে।
ব্যাংকের তহবিলে টান
ব্যাংকগুলোর তহবিলে পড়েছে টাকার টান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০টি ব্যাংকের তারল্য বা নগদ টাকার সংকট চলছে। এর মধ্যে বেসরকারি ১০ টির বেশি ব্যাংকের সংকটটা বেশি। এই ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
ঋণের সুদ যেমন ব্যাংকগুলো বাড়িয়ে দিয়েছে, আমানত সংগ্রহেও তারা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদ দিয়েও এখন গ্রাহক টানার চেষ্টা করছে। অথচ এক বছর আগেও ব্যাংক খাতে ছিল উদ্বৃত্ত তারল্য। তখন এক লাখ কোটি টাকার বেশি অলস পড়ে ছিল। এক বছরের ব্যবধানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে পর্ষদের অনুমোদন করা ঋণও দিতে পারছে না কয়েকটি ব্যাংক।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়ার অন্যতম কারণ টাকার অভাব এবং ঋণের চড়া সুদ। নতুন উদ্যোক্তারা সহজে ঋণ পাচ্ছেন না। যে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ছোটদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন।
ব্যবসায়ের পরিবেশের গুণগত উন্নতি না হওয়াকেও অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন আবুল কাশেম খান। তিনি বলেন, ‘সব সংসদ নির্বাচনের বছরেই সবাই সতর্ক থাকে, স্বাভাবিক যে এবারও আমরা তাই থাকব।’
চাপ বাড়াচ্ছে ডলার
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আমদানি এতই বাড়ছে যে বাংলাদেশ ব্যাংককে গত ৭ মাসে ১৫০ কোটি ডলার বিক্রি করতে হয়েছে।
সম্প্রতি নির্মাণ খাতের দুটি প্রধান উপকরণ রড ও সিমেন্টের দামও বেড়ে গেছে। ৬০ গ্রেডের রডের দাম দুই দফায় বেড়েছে প্রতি টনে ৩ হাজার টাকার মতো। প্রতি টন রডের দাম এখন ৬০ হাজার টাকার বেশি। অন্যদিকে সিমেন্টের দাম বস্তাপ্রতি দুই দফায় ৪০ টাকা বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। এতে নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ মূল্যবৃদ্ধির কারণ কাঁচামালের দামের ঊর্ধ্বগতি। পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিতে খরচ বেশি পড়ছে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের বছরে অর্থনীতিতে একটু ভাটার টান পড়ে, এটা সত্য। এ সময় যে প্রবৃদ্ধির হার কমে যায়, তা-ও সত্য। তার পরেও যদি আমদানি বেড়ে যায়, এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে এর পেছনে রাজনীতিকদের নির্বাচনী খরচ জোগানের একটা কৌশল কাজ করে।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।