দেশের পাট থেকে উন্নত মানের ভিসকস সুতা তৈরি ও বাজারজাতের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফিনল্যান্ডে আড়াই শ কেজি শুকানো পাট পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ফল ইতিবাচক হলে প্রতিবছর প্রায় হাজার কোটি টাকা আমদানি সাশ্রয় হবে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয় করছে সরকার। ২০ সপ্তাহের মধ্যে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের তিনটি প্রতিষ্ঠানের পাট দিয়ে ভিসকস সুতা তৈরির রাসায়নিক পরীক্ষা, গুণগতমান নির্ধারণ, বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া, কারখানায় উৎপাদনের জন্য নকশা তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্বব্যাপী কাঠ থেকে ভিসকস সুতা তৈরি হয়। ভিসকস অত্যন্ত উন্নত মানের সুতা। এই সুতা দিয়ে তৈরি পোশাক অনেক আরামদায়ক হয়। দামও সুতি কাপড়ের চেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে দেড়গুণ বেশি হয়। আখ থেকেও ভিসকস তৈরি হয় স্বল্প আকারে। তবে পাট থেকে বাণিজ্যিকভাবে ভিসকস তৈরি করতে পারলে তা হবে মাইলফলক। বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে এককভাবে সাফল্যের দাবি করতে পারবে। কাঠের মধ্যে যে সেলুলোজ রয়েছে তা পাটেও রয়েছে।
পাটের সবুজ বাকলে সেলুলোজ নামক রাসায়নিক উপাদান থাকে। এই সেলুলোজই ভিসকস তৈরির মূল উপাদান। লিগনিন থাকার কারণে পাটের আঁশ শক্ত হয়। ওই পাটের আঁশকে লিগনিনমুক্ত করে ফেলা হয়। অন্যান্য ক্ষুদ্র রাসায়নিক উপাদানও একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বের করে নিয়ে আসা হয়। এতে পাটের আঁশ পেজা তুলার মতো নরম হয়ে যায়। তা থেকে যে সুতা তৈরি হয়, সেটাই ভিসকস সুতা।
দেশে ২০১৫ সালে পাট থেকে ভিসকস তৈরির ব্যাপারে প্রথম আলোচনা হয়। এর পরের বছর ২০১৬ সালে বিজেএমসির ওই সময়ের পরিচালক বাবুল চন্দ্র রায়কে প্রধান করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ১৪ জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে পাট থেকে ভিসকস সুতা তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। এর মধ্যে ফিনল্যান্ডের ভিশন হান্টার লিমিটেড, সাইটেক সার্ভিস কোম্পানি লিমিটেড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুইডেনের এ এফ ইন্ডাস্ট্রিজকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দেওয়া হয়।
ফিনল্যান্ডের দুটি প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল হিসেবে ল্যাবরেটরিতে পাট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে এবং এর গুণগত মান নির্ধারণ, পরামর্শ দেওয়া, কীভাবে কারখানায় উৎপাদন করা যায়, তা দেখবে। সুইডেনের প্রতিষ্ঠানটি ভিসকস উৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপনের নকশা কেমন হবে, কী ধরনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হবে তা নির্ধারণ করবে। স্থানীয় ও বৈশ্বিক বাজারে কীভাবে তা লাভজনক হতে পারে সেটার গবেষণা তথ্যও জানাবে। দেশে পোশাক শিল্প কারখানা ও বস্ত্র উৎপাদন কারখানা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুতার (স্পিনিং) কারখানা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভিসকসের চাহিদা।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান ড. মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের বস্ত্র উৎপাদন কারখানাগুলো বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ভিসকস আমদানি করে। এর মূল্য ৭০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা। এই ভিসকস আমরা নিজেরা উৎপাদন শুরু করলে আমদানি করার প্রয়োজন হবে না।’ সমীক্ষার বিষয়ে শতভাগ সাফল্যের আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এর আগে ১৯৯৬ সালে চীনে পাট থেকে ভিসকস সুতা তৈরি শুরু হয় পরীক্ষামূলকভাবে। তবে চীনে পাটের স্বল্পতা থাকায় ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ পাট থাকায় এ খাতে সাফল্য আশার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই আশাবাদী। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে কাজ দ্রুত শুরু করলে বাণিজ্যিকভাবে পাট থেকে ভিসকস সুতা উৎপাদন দেড় বছরের মধ্যে শুরু করা সম্ভব হবে।
বিজেএমসি বলছে, দেশে সুতা তৈরির কারখানা বাড়ছে। কাপড় উৎপাদনও বাড়ছে। পাট দিয়ে ভিসকস তৈরি ও বাজারজাতকরণ সফল হলে প্রতি বছর আমদানি সাশ্রয় হবে প্রায় হাজার কোটি টাকা। কমিটি প্রধান এবং এখন বিজেএমসির উপদেষ্টা বাবুল চন্দ্র রায় বলেন, গত অর্থ বছরে দেশে ৯১ লাখ বেল (২০/২২ লাখ মেট্রিক টন) পাট উৎপাদন হয়েছে। পাট উৎপাদনে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
এ ছাড়া চীন, মিয়ানমার ও পাকিস্তানে স্বল্প পরিসরে পাট উৎপাদন হয়। তাই পাট থেকে ভিসকস সুতা তৈরি শুরু হলে এ খাতে বাংলাদেশ রাজত্ব করবে কোনো সন্দেহ নেই। ভারত পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ভিসকসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশই কাজ শুরু করেছে।
তিনি বলেন, বিশ্বে যত বস্ত্র তৈরি হয় তার ৩১ ভাগ হয় কটন থেকে। আর ৬৭ ভাগ ভিসকস, সিনথেটিকের মতো সুতা থেকে। কটনের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে।
বিজেএমসির কারিগরি উপদেষ্টা ও সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির অন্যতম সদস্য প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, বাণিজ্যিকভাবে ভিসকস তৈরির জন্য ব্যাপক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছে গত মাসে। এপ্রিল মাসের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের ল্যাবরেটরির টেস্ট শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পুরো প্রক্রিয়া ২০ সপ্তাহের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। এরপরই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের বিষয়টি আসবে। তিনি বলেন, দেশে যে পাট উৎপাদন হয়, তার ১০ ভাগ দিয়েই বাণিজ্যিকভাবে ভিসকস সুতা তৈরি করা সম্ভব।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুসারে, প্রতিবছর দেশে ভিসকস আমদানি বাড়ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ২৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ১৪ হাজার ৬৪০ মেট্রিক টন ভিসকস আমদানি হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা বেড়ে ১৯ হাজার ৪০৯ মেট্রিক টনে দাঁড়ায়। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৫৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ৬৩৭ কোটি ৮২ লাখ টাকার বেশি মূল্যের ৩৩ হাজার ৭৩৭ মেট্রিক টন ভিসকস আমদানি করা হয়।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।