অর্থনীতির সঙ্গে তিনি জীবন ও বাস্তবতার মিল খুঁজে পেতেন সহজেই। তাই এই বিষয়টিকে অনেক বেশি জীবনঘনিষ্ঠ মনে করেছেন। যখন ব্যারিস্টার হওয়া বাদ দিয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়ার আগ্রহ দেখালেন, তাঁর বাবার মন কিছুটা খারাপ হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত বাবা তাঁর মেয়ের ইচ্ছাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদের ভালো ছাত্রী হয়ে ওঠাটাও বেশ জেদের বশে। তা না হলে যে মেয়ে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত টেনেটুনে পাস করতেন, তিনি কীভাবে ক্লাসের প্রথম স্থানটিকে নিজের জন্য পাকাপোক্ত করে ফেলেন? নাজনীনের ক্লাস থ্রি পর্যন্ত কেটেছে রাজধানীর মগবাজারে নজরুল শিক্ষালয়ে। বাবার চাকরির সূত্রে ১৯৮০ সালে চলে যেতে হয় খুলনায়। ঢাকা থেকে খুলনায়, সুতরাং সেখানকার মেয়েদের চেয়ে ভালো কিছু করতেই হবে। এ জেদ পেয়ে বসে নাজনীনকে। ফলাফল পরের বছরই ক্লাসের প্রথম স্থান। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি পাওয়ার পর পরিবারে কদর বেড়ে গেল নাজনীনের। এতে পড়ালেখায় আরও উৎসাহ বেড়ে যায়।
নাজনীন আহমেদ। অর্থনীতির গবেষক। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর মতে, নারীকে স্বপ্ন দেখতে হবে এগিয়ে যাওয়ার। স্বপ্ন দেখতে হবে বড় কিছু করার, বড় কিছু হওয়ার। এরপর জীবনের গতিধারা, পারিবারিক ও সামাজিক বাস্তবতায় সেই স্বপ্ন কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি প্রত্যেক মেয়েকে একসঙ্গে অনেক কাজ (মাল্টি টাস্ক) করার কৌশল শিখতে হবে।
ছোটবেলা থেকেই নাজনীন একসঙ্গে অনেক কাজ করার দক্ষতা আয়ত্ত করেছেন। তাই স্কুলজীবন থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি সংগীতচর্চা, খেলাধুলা, বিতর্ক, অভিনয়, বিএনসিসির গার্লস গাইড ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে এসব কর্মকাণ্ডেও মোটেই পিছিয়ে ছিলেন না তিনি। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌড়সহ আরও কিছু ইভেন্টে প্রথম হওয়াটা যেন নিয়ম বানিয়ে ফেলেন তিনি। সংগীত, বিতর্কেও জিতেছেন জাতীয় পুরস্কার। খুলনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যশোর বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম এবং ১৯৯০ সালে এইচএসসিতে ঢাকা বিভাগ থেকেও প্রথম হন নাজনীন।
উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পরিবারের সহায়তায় সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতক পড়ার সময় হঠাৎ করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। তবে পড়ালেখায় যাতে কোনো ছেদ না পড়ে, সে বিষয়ে ছিলেন সতর্ক। তাই এক দিনের জন্যও ক্লাস বাদ দেননি। বিয়ের পরদিন থেকেই ছিলেন ক্লাসে নিয়মিত।
তিন সন্তানের মা নাজনীনের প্রথম সন্তানের যখন জন্ম হয়, তখন তিনি মাস্টার্সের ছাত্রী। পড়ালেখার পাশাপাশি মা হিসেবে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে এতটুকু অবহেলা করেননি। সমস্যা হয়েছে, পরিবার ও নিজে মিলে সেসব মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু থেমে যাননি। কারণ, তাঁর স্বপ্ন ছিল এগিয়ে যাওয়ার। নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার পরপরই ১৯৯৭ সালে যোগ দেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগে (সিপিডি)। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের কাছে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে গিয়ে নিয়োগপত্র পেয়ে যান নাজনীন। রেহমান সোবহানের সঙ্গে গবেষণা শুরুর বছর না ঘুরতেই কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে অর্থনীতিতে আরও পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমান বিলেতে। ফিরে এসে যোগ দেন আজকের কর্মস্থল বিআইডিএসে। এরপর ২০০৬ সালে যখন নেদারল্যান্ডসে পিএইচডি করতে যান, তখন তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের বয়স ছিল মাত্র এক বছর। তাঁকে দেশে রেখে যাওয়া-আসার মধ্যেই পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
নাজনীন বলেন, এ দেশে নারীরা পেশাগত ও সামাজিকভাবে অনেক দূর এগিয়েছে নিঃসন্দেহে। সেই হিসেবে অর্থনীতিতে এখনো নারীর অংশগ্রহণ খুব বেশি বাড়েনি। কারণ, এখনো কর্মক্ষম অধিকাংশ নারী শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত নন। ২০১৬ সালের শ্রম জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে নাজনীন বলেন, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম নারীর মাত্র ৩৫ শতাংশ শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত আছে। এর মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশই কৃষিকাজে যুক্ত। আরেকটি অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রম দিচ্ছে। মাত্র ১০ থেকে ১১ শতাংশ নারী যুক্ত রয়েছেন আনুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে।
বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম প্রায় আড়াই কোটি নারী রয়েছেন, যাঁদের সিংহভাগই এখনো কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত নেই। এসব নারীকে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হলে তাঁদের দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করেন এ গবেষক। তিনি বলেন, প্রতিবছর বাজেটে নারী উন্নয়নে আলাদা কিছু বরাদ্দ দিলে তাতে নারীর প্রকৃত উন্নয়ন হবে না।
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানা উদ্যোগের পাশাপাশি নারীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে প্রতিটি পরিবারকেও কমপ্লায়েন্ট হতে হবে বলে মনে করেন নাজনীন। কারণ, পরিবার থেকেই যেকোনো ছেলে বা মেয়ের স্বপ্ন দেখার শুরু। তাই ছেলে-মেয়ে বিভেদ না করে পরিবার থেকেই নারীর স্বপ্নপূরণের পথটাকে সুগম করতে হবে।
গবেষক নাজনীন মনে করেন, বিভিন্ন পেশায় নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হলে জরুরি ভিত্তিতে কিছু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। এর মধ্যে বড় শহরগুলোসহ সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থাকে নারীবান্ধব করার পাশাপাশি পর্যাপ্ত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন ও চলাচলের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সুজয় মহাজন
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।