কাগজ দিয়ে বাহারি পণ্য তৈরি করেন তিনি। হস্তশিল্পই তার জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। এই রোজগার দিয়েই তিনি সন্তানদের লেখাপড়া ও সংসার চালাচ্ছেন। বলছি এক সাহসী নারীর কথা। যিনি বিগত ২৫ বছর ধরে কাগজের বাহারি পণ্য তৈরি করে উপার্জন করছেন। তবে সাধারণ কাগজ নয় বরং তিনি কচুরিপানা থেকে তৈরিকৃত কাগজ দিয়ে এসব পণ্য প্রস্তুত করেন।
অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই! তার নাম শিউলি বেগম। তিনি জানান, ‘স্বামী শারীরিক সমস্যার জন্য কাজ করতে পারে না। আমিই একমাত্র কর্মজীবী।’ শুধু শিউলিই নন তার মত অনেক নারীই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। বরিশালের আগৈলঝারার চিত্র এমনই। সেখানকার নারীরা এই শিল্প থেকে উপার্জন করে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন। জানা গেছে, সেখানকার প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবারের সন্তানেরাই স্নাতকসম্পন্ন। বাকিদের সন্তনেরাও স্কুলে যাচ্ছে।
আরেক নারী শেফালী চক্রবর্তী। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। তার স্বামী একজন সাইকেল মেকানিক ছিলেন। বরাবরই সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হত। অতঃপর বিবর্তন থেকে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর শেফালী কচুরিপানার কাগজ থেকে দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা শুরু করেন। অতঃপর তার ভাগ্য যেন বদলে গেল।
বিগত ১৭ বছর ধরে তিনি এ পেশায় রয়েছেন। সন্তানদেরও লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এই উপার্জনের মাধ্যমে বড় মেয়েকে বিয়েও দিয়েছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে এই পেশায় যুক্ত রয়েছেন বেলা অধিকারী। কচুরিপানার বাহারি রঙের কাগজ দিয়ে তিনি বিভিন্ন বক্স তৈরি করেন। এই পেশায় যুক্ত থেকেই তিনি তার ছেলে স্বদেশকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করিয়েছেন।
পাশাপাশি তার অর্থ দিয়েই স্বামীকে আগৈলঝাড়া বাজারে একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির দোকান করে দিয়েছেন। আজ তিনি সাবলম্বী এক নারী। তারও খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। আজ বিবর্তনের সাহায্যে তিনি কর্মসংস্থানের পাশাপাশি লেখাপড়াও শিখেছেন। এক সময় কচুরিপানাকে কৃষকরা অভিশাপ হিসেবে ভাবত। আজ এটি এক আশীর্বাদের নাম।
কচুরিপানাকে কাজে লাগানোর জন্য শুধু যে এলাকার নারীদের উন্নয়ন হচ্ছে তা নয়। এর মাধ্যমে সুরক্ষিত হচ্ছে পরিবেশও। পাশাপাশি উপার্জনের এক মাধ্যম হিসেবে আস্থা অর্জন করেছে কচুরিপানা। বর্তমানে এসব হস্তশিল্প যাচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ ২০টিরও বেশি দেশে। বিদেশে এর চাহিদা বাড়ার কারণে ক্রমশ এর প্রসার বেড়েই চলছে।
বিশেষ করে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ক্রিস্টমাস ডে বা বড়দিনের ‘ট্রে’ সাজাতে এসব পণ্যের বেশ কদর রয়েছে। কচুরিপানার কাগজের সঙ্গে শন, সুতা, কেয়া পাতা, তালপাতা, পাট দিয়ে তৈরি করা হয়- অ্যালবাম, নোটবুক, গহনা ঝুড়ি, গিফট বক্স, শুভেচ্ছা কার্ড, মালা, সুতার ব্যাগ, পার্স, বক্স, খেলনা, ওয়ালম্যাট, সাইড ব্যাগসহ ৩০ হাজার উপহার সামগ্রী। আর এ কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন বরিশালের প্রায় দুই হাজারেরও বেশি পরিবার।
শুধু হস্তশিল্পের সঙ্গেই নয় অনেক নারী আবার জড়িত রয়েছেন কচুরিপানা কাটার কাজেও। তারা খাল-বিল থেকে কচুরিপানা কেটে সংগ্রহ করেন। মূলত ফেলে দেয়া কাগজের সঙ্গে কচুরিপানার মিশ্রণেই তৈরি হয় এই কাগজ। এসব কচুরিপানা সংরক্ষণ করা হয় একটি সংস্থায়। যার নাম বিবর্তন।
ম্যাননাইড সেন্ট্রাল কমিটি নামের আন্তর্জাতিক সংস্থা ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে আসে কর্ম সৃষ্টির প্রকল্প নিয়ে। তারা সহজে এবং প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা শুরু করে। ওই গবেষণার অংশ হিসেবে ফেলে দেয়া বা পরিত্যক্ত ময়লা-আবর্জনা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি।
কচুরিপানাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তার ওপর ১৯৯০ সালে গবেষণা শুরু হয়। অতঃপর ১৯৯৩ সালে বিবর্তন নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠে। বিবর্তনের কর্মীরা কচুরিপানা এবং ফেলে দেয়া কাগজ, কাপড় দিয়ে পুনরায় হাতে কাগজ তৈরির উদ্যোগ নেন। সেই উদ্যোগ প্রগতির পথে চলছে আজো। ২০০৮ সাল থেকে বিবর্তন ‘প্রকৃতি বাংলাদেশ’ নামে পরিচালিত হচ্ছে একটি পরিচালনা পরিষদের মাধ্যমে।