রাস্তায় চলন্ত বাসের সঙ্গে হালকা সংঘর্ষ হয় একটি ব্যক্তিগত গাড়ির। চালকেরা রাস্তা বন্ধ করে বিবাদ শুরু করে দেন। ব্যক্তিগত গাড়ির চালক গাড়ি থেকে নেমে বাসটিকে থামাতে চান। এদিকে বাসের চালক নির্মমভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির চালকের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে চলে যান! গুরুতর আহত হন ব্যক্তিগত গাড়ির চালক।
হঠাৎ রেগে গিয়ে আরেকজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আক্রমণ করা এবং এই আক্রমণ থেকে মেরে ফেলার ঘটনা ইদানীং প্রায়শই দেখা যাচ্ছে। কোনো একটি বিষয় নিয়ে বচসা, বিবাদ আর সেখান থেকে প্রলয়ংকরী রাগ আর রাগের বশবর্তী হয়ে মেরে ফেলা একটি অমানবিক আচরণ। কেবল ঘরের বাইরেই নয়, এমনকি পরিবারের মধ্যেও এই অমানবিক আচরণের ঘটনাগুলো ঘটছে। পথচারী পথচারীকে, বন্ধু বন্ধুকে, ভাই ভাইকে চরম আঘাত দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই নিষ্ঠুরতা আর হঠাৎ ভীষণ রেগে যাওয়ার পেছনে প্রকৃতপক্ষে আক্রমণকারীর হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, সেই সঙ্গে প্রমাণিত হচ্ছে তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার অক্ষমতা।
একটি শিশু যখন বেড়ে ওঠে, তখন আমরা তার শারীরিক বিকাশটুকু চোখে দেখি। পাশাপাশি তার মনঃসামাজিক বিকাশও ঘটে কিন্তু আমরা সেটা খালি চোখে দেখতে পাই না। শিশুর জ্ঞানীয় বিকাশ (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) আর নৈতিকতার বিকাশ (মর্যাল ডেভেলপমেন্ট) তার আচরণগুলোকে দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি আরেকজনকে দেখে শেখা (অবজারভেশনাল লার্নিং); শক্তির চর্চা (পাওয়ার এক্সারসাইজ) আর মাদকাসক্তি এই আক্রমণাত্মক আচরণকে প্রভাবিত করে। খুব ছোটবেলা থেকেই কোনো শিশুকে যদি বোঝানো হয় জগতে শক্তি প্রয়োগই একমাত্র সম্পদ, তখন তার জ্ঞানীয় বিকাশের জগতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আবার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, এই অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণের পেছনে থাকে মানুষের অবদমিত কামনা-বাসনা, যাকে তিনি তুলনা করেছেন অবচেতন মনের দরজা খুলে দেওয়ার সঙ্গে।
অবচেতনে মানুষ যা কামনা করে, চেতন মনে সে তার শিক্ষা, সভ্যতা, সামাজিকতা আর নৈতিকতা দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখে। এই অবদমিত চাহিদাগুলো সরাসরি পূরণ হয় না বলে হিংস্রতা আর নৃশংসতার মধ্য দিয়ে ঘুরপথে পূরণ করার চেষ্টা চলে। তখনই নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটে। মানুষের মধ্যে এই হিংস্রতার ব্যাখ্যায় অন্য মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, একজন মানুষ নিজের হতাশা থেকেই মূলত আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। নিজের হতাশা কাটাতে সে বেছে নেয় দুর্বল একজনকে! এই দুর্বলের ওপর হিংস্রতা দেখিয়ে সে একধরনের মানসিক পরিপূর্ণতা লাভ করে, হিংস্রতার সপক্ষে নিজস্ব যুক্তি তৈরি করে। এই তত্ত্বকে বলা হয় ‘ফ্রাস্টেশন-অ্যাগ্রেশন হাইপোথিসিস’।
জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ এরিক ফ্রম তাঁর এনাটমি অব হিউম্যান ডেস্ট্রাকটিভনেস বইয়ে নানা মাত্রায় মানুষের হিংস্রতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের সহিংসতাকে তিনি প্রতিরক্ষামূলক এবং মৌলিক চাহিদা মেটানোর আচরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। খাদ্যের প্রয়োজনে আর হিংস্র জীবজন্তু থেকে বাঁচতে মানুষ তখন আক্রমণাত্মক আচরণ করত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শ্রেণিধারণা, ভূরাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আর মনঃসামজিক কারণে পরিবেশে আর প্রতিবেশের প্রভাবে মানুষ অহিতকর সহিংসতার চর্চা শুরু করে, যেটাকে তিনি বলেছেন ‘ম্যালিগন্যান্ট অ্যাগ্রেশন’। মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তিগুলো পারিপার্শ্বিকতার কারণে ভয়ানকভাবে প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত কারণেই মূলত কিশোর, তরুণ থেকে শুরু করে পরিণত বয়সের মানুষের মধ্যে হত্যা প্রবৃত্তি তৈরি হয়, তারা সহিংস আচরণ করে। হঠাৎ রেগে যাওয়া, আর রেগে গিয়ে চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে আরেকটি জীবন শেষ করে ফেলার মনোবৃত্তির পেছনে যে বিষয়গুলোকে সরাসরি দায়ী করা যায়, সেগুলো হচ্ছে:
পাওয়ার এক্সারসাইজ: নিজেকে কোনো দিক দিয়ে শক্তিশালী ভাবা। কোনো আচরণের জন্য জবাবদিহি করতে হবে না, বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না বলে বিশ্বাস করা। ক্ষমতাশালী মা-বাবা বা কোনো শক্তিবলয়ের প্রভাবে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য ভাবা।
দেখে শেখা: পরিবারে বা চারপাশে এ ধরনের অন্যায় আর অমানবিক আচরণ দেখে নিজের মধ্যে সেগুলো লালন করা এবং সময়মতো নিষ্ঠুর আচরণ করা।
বিকাশের সমস্যা: শারীরিক বিকাশ হয়তো ঠিকমতো হয়েছে কিন্তু জ্ঞানীয় বিকাশ (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) আর নৈতিকতার বিকাশ (মর্যাল ডেভেলপমেন্টের) ঠিকমতো না হওয়া। ফলে একজন মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুর আচরণগুলো যে মোটেই ঠিক নয়, সেই বোধটুকু জন্মায় না।
মানসিক সমস্যা: শিশু-কিশোরদের মধ্যে কনডাক্ট ডিসঅর্ডার, ইমপালস কন্টোরাল ডিসঅর্ডার আর প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (বিশেষ করে অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি), বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার ইত্যাদি মানসিক সমস্যা থাকলে অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ করার প্রবণতা, এমনকি হত্যা প্রবৃত্তি হতে পারে। কখনো হতাশা আর বিশেষ ধরনের বিষণ্নতা থেকেও আগ্রাসী আচরণ হতে পারে।
আবেগ নিয়ন্ত্রণের চর্চা না থাকা: একজন মানুষ যখন নিজের আবেগগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, অন্যের আবেগকে ধারণ করতে পারেন না, তখন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁর অহং আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এই অহং বা ইগোকে ডিফেন্স করতে গিয়ে বেপরোয়া আচরণ করে ফেলেন, জন্ম নেয় সহিংসতার।
মাদকাসক্তি: মাদকের প্রভাবে এবং মাদক পাওয়ার তাড়নায় মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। মাদকাসক্তি একটি রোগ। এই রোগের প্রভাবে মানুষের চিন্তা ও আচরণের বৈকল্য দেখা দেয়। আচমকা সহিংস আচরণ আর হত্যা প্রবৃত্তির জন্য মাদক অনেকাংশে দায়ী বলে গবেষণায় দেখা গেছে। খেলা আর বিনোদনে সহিংসতার চর্চা: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ভিডিও বা ইন্টারনেটভিত্তিক গেম, যেখানে সহিংসতা আর নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়, সেগুলোর চর্চা করলে ব্যবহারকারীদের মধ্যে আগ্রাসী আচরণ তৈরি হয়। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, সহিংসতায় পূর্ণ টিভি অনুষ্ঠান বা চলচ্চিত্র দেখতে থাকলে শিশুদের মধ্যে সহিংস আচরণ করার প্রবণতা বেড়ে যায়।
সহিংস-আগ্রাসী আচরণ কমাতে করণীয় কী:
সবার আগে পরিবার: পরিবারে সহনশীলতা আর নৈতিকতার চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। ছোটখাটো বিষয় থেকেই শিশুদের মধ্যে পাওয়ার এক্সারসাইজ না করার অভ্যাস তৈরি হবে। মা-বাবা যদি কখনো রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে গাড়ি চালানোকে উৎসাহিত করেন, কোনো একটি কাউন্টার বা লিফটে লাইনে না দাঁড়িয়ে হুট করে ঢুকে যান, চারপাশের মানুষ, বিশেষত অধস্তনদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেন, ব্যক্তিজীবনে অনৈতিকতার চর্চা করেন এবং পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হন, তখন শিশুর মনোজগতের পরিবর্তন ঘটে, যা তাকে পরবর্তী সময়ে সহিংস-আগ্রাসী আচরণে উদ্বুদ্ধ করে।
জবাবদিহি: যেকোনো অন্যায় আচরণের জন্য জবাবদিহি আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত থাকবে যে সমাজে, সেখানে আগ্রাসী আচরণ কম হবে। অনিয়ম করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি বিলীন করতেই হবে।
সহিংস খেলা আর বিনোদনের চর্চা না করা: যেসব গেম আর চলচ্চিত্রের উপজীব্য সহিংসতা আর হত্যা, সেগুলোকে যত দূর সম্ভব পরিহার করে গঠনমূলক গেম আর চলচ্চিত্রচর্চার অভ্যাস করতে হবে।
মাদকাসক্তি প্রতিরোধ: মাদকাসক্তি প্রতিরোধ করতে হবে। পরিবারে কেউ মাদকাসক্ত হয়ে গেলে বিষয়টিকে গোপন না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে হবে।
জীবনাচারের পরিবর্তন: প্রাত্যহিক জীবনাচারে শৃঙ্খলা থাকতে হবে। বিশেষ করে রাতে জেগে থাকা আর দিনের বেলা দুপুর অবধি ঘুমানোকে কখনোই উৎসাহিত করা যাবে না। ঘুমের সময়ের পরিবর্তনসহ জীবনাচারে অনিয়ম আর উচ্ছৃঙ্খলতা মানুষের ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ নষ্ট করে দেয়, চিন্তা ও আচরণের সমস্যা তৈরি করে। তাই ঘুমসহ জীবনাচারে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।
মানসিক সমস্যা শনাক্ত ও চিকিৎসা: শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক কারও মধ্যে মানসিক সমস্যার যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। রাগসহ বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শসেবা ও চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
তথ্যসূত্র: প্রথমআলো ডটকম।