অভাব নামের জগদ্দল পাথরটি সংসার থেকে সরে গেছে। ছোট্ট একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেই কামরুন নাহার সুখের আলোর সন্ধান পেয়েছেন। এখন আর দুই বেলা দুই মুঠো অন্নের জন্য কারও কাছে হাত পাততে হয় না এক সময়ের অভাবী এ নারীকে। মাত্র ৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ ও কুঁচে শুঁটকি তৈরির প্রকল্প করে কয়েক বছরের ব্যবধানে কামরুন নাহার সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান করছেন অসহায় নারীদের। কামরুন নাহারের উৎপাদিত কাঁকড়া বাংলাদেশে বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দেশের বাইরে চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান এবং সিঙ্গাপুরে রফতানি হয়ে থাকে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালী গ্রামের অনুকরণীয় নারী কামরুন নাহার ছোটবেলা থেকেই অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন। বাবার আর্থিক অবস্থা ছিল চরম খারাপ। অভাবের কারণে পঞ্চম শ্রেণী পাস করার পর অর্থাভাবে আর পড়ালেখা হয়নি। এ সময় কামরুনের পরিবার পাশের গ্রামের আলামীনের সঙ্গে তার বিবাহ দেন। কামরুন নাহারের স্বামী শ্রমিক হিসেবে সুন্দরবনে অন্যের নৌকায় কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। সেখান থেকে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চলত না।
স্বামীর একার রোজগারে একবেলা আহার জুটলে অন্যবেলা না খেয়ে থাকতে হতো কামরুনকে। সংসারের এ অবস্থার একপর্যায় কামরুন নাহার বেগম অন্যের ঘেরে কাঁকড়া চাষ প্রকল্পে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করেন। পরের ঘেরে কাজ করতে করতেই কামরুন নাহার বেগম কাঁকড়া চাষের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর কামরুন নাহার কাঁকড়া চাষের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজে একটা কিছু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এক সময় কামরুন নাহার তার পরিকল্পনাটির কথা স্বামীকে জানান। স্বামী আলামীন মোড়ল তাতে ইতিবাচক মনোভাব দেখান।
কিন্তু কাজ শুরু করার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের ছিল না। তাই কামরুন নাহার নেমে পড়েন অর্থের সন্ধানে। তবে আত্মীয়স্বজন কারও কাছ থেকেই কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পাননি। তারপরও নিজের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করতে দৃঢ়প্রত্যয়ী এ নারী সামনের দিকে চলতে থাকেন। অবশেষে ১৯৯৮ সালে কামরুন নাহার বেগম নওয়াবেঁকি গণমুখী ফাউন্ডেশনের সদস্য হয়ে ৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রকল্প শুরু করেন। স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু করলেও কাজে সফলতা আসতে থাকে। ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে অল্প কিছু দিন পর এনজিএফের ৪ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করে পুনরায় ৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নিজস্ব নৌকা ক্রয় করে সুন্দরবন এলাকা থেকে কাঁকড়া ধরে এনে বাড়িতে চাষ শুরু করে।
কাঁকড়া ধরার জন্য কুঁচে শুঁটকির প্রয়োজন হয়। বাজার থেকে কুঁচে শুঁটকি ক্রয় করতে লাভের একটা বড় অংশ ব্যয় করতে হয়। তাই এক পর্যায়ে কামরুন সিদ্ধান্ত নেয় কাঁকড়া মোটাতাজাকরণের পাশাপাশি কুঁচে শুঁটকির প্রকল্প শুরু করবেন, যেই কথা সেই কাজ। বর্তমানে দাতিনাখালী গ্রামের তিনিই একমাত্র উদ্যোক্তা যিনি কাঁকড়া মোটাতাজাকরণের পাশাপাশি কুঁচে শুঁটকিও করে থাকেন। এখন বাড়তি অর্থ ব্যয় করে কামরুনকে আর বাজার থেকে কুঁচে শুঁটকি কিনতে হয় না, বরং কামরুন নাহারের কাছ থেকে অনেক উদ্যোক্তা কুঁচে শুঁটকি কিনে নিয়ে যায়।
কামরুন নাহারের ছোট্ট একটি উদ্যোগ তার অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এ উদ্যোগ থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই কামরুন ছেলে এবং মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন, বাড়ি তৈরি করেছেন, জায়গাজমিও কিনেছেন। কামরুনের বড় ছেলে কলেজে এবং ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। বড় ছেলে পড়াশোনার পাশাপাশি তার মায়ের ব্যবসায় সহযোগিতা করছে। কামরুন নাহার বেগম স্বামী এবং ছেলেমেয়েসহ নিজ বাড়িতেই থাকেন। এক সময় তাদের পৈতৃক সম্পত্তি ছয় শতক ভিটাবাড়ি ছাড়া আর কোনো জমি ছিল না। কিন্তু ব্যবসায়িক সফলতার ফলে বর্তমানে ২.৪২ একর নিজস্ব জমির মালিক হয়েছেন কামরুন। নিজের জমি ছাড়াও বাড়ির সামনে কাঁকড়া মোটাতাজাকরণের জন্য আরও প্রায় তিন বিঘা জমি এক বছরের জন্য লিজ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছেন।
কামরুন নাহার তার খামারে উৎপাদিত কাঁকড়া বাংলাদেশে বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দেশের বাইরে চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান এবং সিঙ্গাপুরে রফতানি হয়ে থাকে। কুঁচে শুঁটকি স্থানীয় বাজারে জেলেদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। কামরুন নাহারের সফল এ উদ্যোগে সমাজের অতি দরিদ্র বিশেষ করে মহিলাদের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের উদ্যোগ কর্মসংস্থানে ব্যাপক অবদান রাখছে। বর্তমানে তার কারখানায় ছয়জন মহিলা এবং পুরুষ, খন্ড-কালীন ১৮ জন মহিলা ও পুরুষ কাজ করে। শ্রমিকদের সবাই হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য।
কামরুন নাহার নিজে সার্বক্ষণিক শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সব কাজ করে থাকেন। তার স্বামী ও এক ছেলে প্রকল্পে কর্মী হিসেবে কাজ করেন। কামরুন নাহার বেগমের কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ এবং কুঁচে শুঁটকি প্রকল্পে উৎসাহিত হয়ে আশপাশের অনেকেই এ ব্যবসা শুরু করছেন। বিশেষ করে কুঁচে শুঁটকি প্রকল্পের ব্যাপারে অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করছে।
কয়েক বছর আগেও উপকূলীয় এ এলাকার মানুষ যেখানে চিংড়ি চাষের ওপর বেশি গুরুত্ব দিত এখন তারা চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের মতে, চিংড়ি চাষের চেয়ে কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রকল্প অধিক লাভজনক এবং ঝুঁকিও কম। বর্তমানে কামরুন নাহার বেগমের উদ্যোগটি ওই এলাকায় দারিদ্র্যবিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি করে জমি লিজ নিয়ে কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রকল্প করার পাশাপাশি কুঁচে শুঁটকি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের স্বপ্ন দেখেন কামরুন নাহার। তিনি আরও স্বপ্ন দেখেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকার অতি দরিদ্র মানুষ বিশেষ করে মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবেন।
তথ্যসুত্র: নিউজ চিটাগং টুয়েন্টিফোর ডটকম।