মধ্যেপ্রাচ্যের দেশ কাতারে ২০১৭ সালের জুন মাসে প্রতিবেশী চার দেশের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক অবরোধ শুরু হয়। সেসময় কাতারকে দুটি বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এক. বিশ্বকে বোঝানো যে, তাদের সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। দুই. বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর জন্য বিশ্বকে বোঝানো যে, কাতারের শক্তিশালী অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য এখনও ভালো পরিবেশ আছে। আর কাতার সেই পরিবেশ তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছে।
কাতার সংকট কাটিয়ে কীভাবে অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করছে সে বিষয়ে বলতে গিয়ে এমনটাই বলেন, লন্ডনের রয়েল ইউনাইডেড সার্ভিস ইন্সটিটিউশনের মধ্যেপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক মিশেল স্টিফেন। তেল ও গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে সৌদি আরব, বাহরাইন, মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
নিষেধাজ্ঞা হিসেবে কাতারের সঙ্গে সব ধরণের কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং পরিবহন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তারা। পরে ইরানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ইতি টানা, আল জাজিরা টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়াসহ মোট ১৩টি দাবি করে দেশগুলো। তবে শুরু থেকেই কাতার তার বিরুদ্ধে আনিত সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
একইসঙ্গে সৌদি আরবসহ তার মিত্রদের কোনো শর্ত মানার বিষয়টিও নাকচ করে দিয়েছে। ফলে দীর্ঘ ১৯ মাস ধরে কাতারের ওপর এ অবরোধ বহাল রেখেছে উপসাগরীয় দেশগুলো। ঐতিহ্যগতভাবে কাতার খাদ্য ও ভোগ্য পণ্যে আমদানি নির্ভর। অপরোধ আরোপ করা চার দেশ থেকেই আমদানির ৬০ শতাংশ যোগান হতো। ফলে অর্থনৈতিক এই অবরোধের ফলে সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হওয়ার কথা থাকলেও বিপরীতে দেশটির অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হচ্ছে বলেই বিবিসির এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।
সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এখন আর সামনে আসছে না। কাতারে অবরোধ আরোপ করা চার দেশ থেকে খাদ্যপণ্য বেশি আমদানি হওয়ায় নিষেধাজ্ঞার পরপরই দ্রুত তুরস্ক এবং ইরানের বিভিন্ন রুট ব্যবহার করে খাদ্যপণ্য আমদানি শুরু করে দেশটি। পাশাপাশি কাতার অভ্যন্তরীণ খাদ্যপণ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। দুগ্ধ চাহিদা পূরণে দেশটি বিদেশ থেকে হাজার হাজার গাভী আমদানি করে।
সবমিলে অবরোধকে কাতার সম্পূর্ণভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে বলে মনে করেন কাতারের এক অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা। তবে সামনে এটা কাতারের জন্য কতটুকু সহজ ও ভালো হবে সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে এভাবে খাদ্যপণ্য আমদানির নিশ্চয়তা পেতে হলে বিশ্বের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক (এলএনজি) দেশটিকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে।
কাতারের বিনিয়োগ তহবিল আল রায়ানের জেষ্ঠ্য পরিচালক আকবর খানের মতে, সংকট মোকাবিলায় সরকার জনসাধারণের প্রত্যাশের চেয়ে বেশি কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। দেশটির জনগণের জীবনযাত্রায় যাতে কোনো প্রভাব না পড়ে সে জন্য তারা গুরুত্বের সাথে কাজ করছে। এই অবরোধ তাদের বাণিজ্য সক্ষমতার ওপর কোনো প্রভাব না ফেললেও এটা তাদের মর্যাদা নষ্ট করেছে।
সংকট মোকাবিলায় সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত কাতারকে সাহায্য করেছে। অবরোধের তিন মাস পর সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে কাতার হামাদ পোর্ট চালু করে। যেটা কাতারে বড় বড় কার্গো জাহাজ আনার সক্ষমতা তৈরি করে। এই পোর্টটি থেকে দুটি মেরিটাইম জাহাজ চলাচলের পথ তৈরি করে কাতার।
যে চ্যানেল ব্যবহার করে মালয়েশিয়া, চীন, তুরস্ক, ভারত ও গ্রিসের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করে দেশটি। ফলে অবরোধ আরোপ করা দেশের সমুদ্রসীমা ব্যবহার না করেই অধিক কার্গো জাহাজ দেশটিতে ঢুকতে পারে। এর আগে প্রতিবেশী দেশগুলোর পোর্টে আসা পণ্য ছোট জাহাজে করে কাতারে নিয়ে আসা হতো।
এর বাইরে সংকট মোকাবিলায় নতুন সম্পর্কের ওপরও জোর দিচ্ছে কাতার। খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানিতে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে কাতার। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। কাতারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সচিব, অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে।
যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি বোয়িং থেকে কাতার এয়ারয়েজের বিমান ক্রয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে কাতারের বিনিয়োগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। একই সাথে কাতার জার্মানির সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
জেষ্ঠ্য পরিচালক আকবর খান আরো বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর এই অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক অবরোধ উপসাগরীয় দেশের বাইরে গিয়ে কাতারকে নতুনভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে সুযোগ করে দিয়েছে। এই সম্পর্কগুলো কাতারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেখানোর জন্য নয়, বরং অবরোধ থাকার পরও যে দেশটিতে ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ আছে সেটা বোঝানো।
বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে কাতার শ্রম আইন, বেসরকারীকরণ, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, অতিমাত্রায় বিদেশী মালিকানা রাখার ব্যবস্থা করে অর্থনৈতিক পুর্নগঠনের ঘোষণা দিয়েছে। কাতার মনে করে এসব পুর্নগঠন বিদেশী বিনিয়োগ ও পরিচালনা সহজ করবে।
তবে প্রশাসনিক গঠনগত সমস্যা কাতারে বেশি বিদেশী সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা বলে মনে করেন অনেকে। দেশটির সাবেক একজন উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কাতারে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেশ ভয়াবহ। সে কারণে কাতারের বাজার খুব বড় হয়ে উঠতে পারেনি। পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা কম এবং দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি।
গ্যাস মজুদে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে আছে কাতার। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানীতে শীর্ষে থাকা কাতার ২০১৭ সালে ৮১ মিলিয়ন টন গ্যাস রপ্তানি করেছে। যা বিশ্বের মোট রপ্তানীর ২৮ শতাংশ। এছাড়া দিনে ৬ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করেছে দেশটি। এরপরও দেশটি গ্যাসের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার জন্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সংগঠন ওপেক থেকে বেরিয়ে এসেছে। কাতার বলছে অবরোধের সাথে ওপেক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
কাতারের জ্বালানি সম্পদের কারণেই দেশটি অবরোধের মধ্যেও ক্রমন্বয়ে অর্থনীতিকে প্রসারিত করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যমতে, ২০১৭ সালে কাতারের অর্থনীতি ১ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে বৃদ্ধি ২ দমমিক ৪ শতাংশ আর ২০১৯ সালে ৩ দশমিক ১ শতাংশ বাড়বে।
তবে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে উপসাগরীয় অন্য দেশগুলোর চেয়ে কাতার দুর্বল বলে মনে করেন লন্ডনের ক্যাপিটল ইকোনোমিক্সের মধ্যেপ্রাচ্য বিষয়ক অর্থনীতিবিদ জ্যাসন তুভে। তিনি বলেন, দেশটিতে মাত্র ৩ লাখ কাতারি নাগরিক আছে এবং খুব সহজেই তাদেরকে কাজ দিতে পারে সরকার।
মিশেল স্টিফেন বলছেন, কাতার বহুমুখী ব্যবসায়ী অর্থনীতির দেশ না হতে চাইলে তাদের সেটা প্রয়োজন হবে না। কারণ কেবল গ্যাস উত্তোলন করেই অর্থনীতিকে সচল রাখতে পারবে তারা। গ্যাস সম্পদ দিয়েই এখানে সবকিছু দাঁড় করানো সম্ভব। তথ্যসূত্র: বনিকবার্তা।