অফিস, সংসার ও সন্তান—সব সামলানোর পরও মনের মধ্যে চলে আসে অপরাধবোধ। অনুশোচনা হয় সবটা ঠিকমতো পারছেন তো? মা হিসেবে সন্তানকে হয়তো আরেকটু সময় দেওয়া যেত। মেয়ে বা স্ত্রী হিসেবে পুরো দায়িত্ব পালন করছেন তো? পরিবারের সবার দায়িত্ব তাঁর মাথার ভেতর থরেথরে সাজানো থাকে। অফিস থেকে টেলিফোন করে খোঁজখবর নিতে থাকেন সন্তানের। চেষ্টা করেন বাড়ি ফিরে লেখাপড়া করানোরও। কিন্তু সেই কর্মজীবী মাকে বলা হয়, তিনি সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না। মা কষ্ট পান। মাঝেমধ্যে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাও করেন। তখন পরিবারের সবার সেই মায়ের পাশে দাঁড়ানোর যে দায়, তা এড়িয়ে যাওয়া কি উচিত হবে?
একজন কর্মজীবী মা বলছিলেন, মেয়েকে নিজে পড়াতে পারলে ওর ফল আরেকটু ভালো হতো। মেয়েটি একা একা সারা দিন বাসায় থাকে। সংসারের এবং নিজের প্রয়োজনে চাকরি করেন। চাকরি ছেড়ে দিলে সংসারের খরচ স্বামীর একার আয়ে মেটানো যাবে না। তাঁর নিজের মা বয়স্ক আর অসুস্থ হওয়ায় নাতনির ভালোমন্দ দেখাশোনা আগের মতো করতে পারেন না। শাশুড়ি তাঁর মেয়ের চেয়ে নিজের মেয়ের বাচ্চাকে বেশি গুরুত্ব দেন। তাই সেখানেও রাখেন না।
মনের দোটানায় ভাবেন, চাকরি ছেড়ে দেবেন। তিনি পড়ে থাকবেন কেবল ঘরসংসার নিয়ে। কেউ কেউ বলেন, কর্মজীবী নারীর সন্তান বখে যায়। তারা মানুষ হয় না। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা এ ক্ষেত্রে কী বলে? হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, কর্মজীবী মায়েদের মেয়েরা জীবনে তুলনামূলক বেশি সফল হয়। আর এসব মায়ের ছেলেসন্তানেরা হয় নারীর প্রতি অনেক যত্নশীল। গবেষণাপত্রে বলা হয়, যেসব মা শুধু গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তাঁদের মেয়ের চেয়ে কর্মজীবী মায়ের মেয়েদের চাকরি করতে বা স্বনির্ভর হতে বেশি দেখা যায়। এমনকি কর্মজীবী মায়ের মেয়েরা অন্যদের চেয়ে বেশি উপার্জনও করেন। কর্মজীবী মা তাঁর বাড়িতে সন্তানদের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে রাখেন। ফলে তাঁদের ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে যে কার কতটুকু দায়িত্ব।
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ক্যাথলিন ম্যাকগিন বলেন, ‘মায়েরা ঘরের বাইরে কাজ করলে সন্তানেরা স্বনির্ভর হবে—প্রভাবটুকু আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু আমরা এটা আশা করিনি যে, তাঁদের সন্তানেরা যত্নশীলও হবেন।’ ম্যাকগিন মায়েদের কর্মজীবী হতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, যখন আপনি কাজে যান, তখন তা সন্তানদের এটা বুঝতে সাহায্য করে যে তাদের জন্য অসংখ্য সুযোগ খোলা আছে।
.
আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসা এক কর্মজীবী নারী আফসোস করে বলছিলেন, অফিসে বসে বাসার খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। বাচ্চাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি। কথা বলি। কিন্তু তারপরও মনের খুঁতখুঁতে ভাবটা যায় না। অন্যদিকে এতে কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়। এটাও বুঝি। তখন কাজে ঠিকমতো মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না। চিন্তাগুলো মাথায় ঘুরতে থাকে। কাজের পারফরম্যান্সে ঠিকই এর ছাপ পড়ে। মাঝেমধ্যে দেরি করে অফিসে আসি। সংসারের কিছু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেরি হয়।
বাংলাদেশের কর্মজীবী নারী নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। নারী এখন শুধু শিক্ষক-চিকিৎসকই নন, অন্য পেশাতেও তাঁরা সমানে অংশ নিচ্ছেন। পুলিশ, সামরিক বাহিনী, সাংবাদিকতা, প্রশাসন, প্রকৌশল নির্মাণশিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইনপেশা—সব ক্ষেত্রেই নারী এখন সমান তালে পা ফেলে এগোচ্ছেন। নারীর এই অগ্রযাত্রা আগামী দিনে পৃথিবীতে বাড়বেই। গোঁড়ামি, ভন্ডামি, পশ্চাৎপদ চিন্তা হয়তো গতিকে থামিয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু অগ্রগতির যে চাকা ঘুরছে; সেটিকে প্রগতিবিমুখ করে প্রতিক্রিয়াশীলতার জাঁতাকলে আর পিষ্ট করা যাবে না।
করণীয়টা কী?
কিছু কিছু দায়িত্ব মা-বাবার আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন একটা সময় পর্যন্ত প্রধানত তার খাবারদাবার, পড়াশোনা, স্বাস্থ্যসংক্রান্ত। ধীরে ধীরে তা অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সংসারে খরচ দিন দিন বেড়ে চলেছে। পর্যাপ্ত আয় না হলে মানসিকভাবে স্থির থাকাটা বেশ কষ্টকর। নারী সংসার ও ব্যক্তিস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য স্বাবলম্বী হতে চাইবেন, সেটা স্বাভাবিক।
একজন স্বাবলম্বী মায়ের সন্তানদের সব পরিবেশে মানিয়ে চলা শেখাতে হবে। সন্তানদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলার কাজে শুধু মা একা নন; পরিবারের সবাইকে সমর্থন দিতে হবে। মা-বাবা দুজনেরই সমানভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। অফিসে সময়মতো যাওয়া জরুরি। রাতে বা ছুটির দিনগুলোতে রান্না আগে থেকে করে রাখলে সময় বাঁচবে। সামর্থ্য থাকলে মাঝেমধ্যে বাইরের খাবার বাসায় নিয়ে আসা যেতে পারে। এতে বাচ্চারাও খুশি হয়। আর পরিবারের সদস্যদের মুখের রুচি বদলায়। অফিসে কাজের সময় সন্তান বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা না বলে টিফিন বা দুপুরের খাওয়ার সময় সহকর্মীদের মাঝে থেকে সরে গিয়ে ঘরের আলাপ করে নেওয়া ভদ্রতা। ঘরকে কখনোই অফিসে আনা ঠিক নয়।
বাসায় ছুটির দিনগুলোতে বাচ্চাদের সঙ্গে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটাতে হবে। ওদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, কী কী প্রয়োজন, অপ্রয়োজন, তা জেনে নেওয়া যেতে পারে। ওদের মতামতের আলোকে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বা প্রয়োজনে পরিবর্তন করাও যেতে পারে। আপনার প্রয়োজনীয় ছুটি নিয়েও সন্তানের লেখাপড়া তদারক করতে পারেন। সন্তানের অসুখ বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে অফিসকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয় তারা বুঝবে। সময় ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনামতো কাজ ও গুণগত সময়—এই তিনটি বিষয় খেয়াল রাখলে সন্তান ও সংসার নিয়ে আর কোনো নেতিবাচক কথা মনে আসতে পারবে না।
গবেষণা সাক্ষ্য দিচ্ছে, কর্মজীবী মায়ের সন্তানদের বুদ্ধিমত্তা একটু বেশি হয়। ফলে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাটা খুব একটা ভালো সিদ্ধান্ত নয়। মন খারাপ না করে কিংবা অনুশোচনায় না ভুগে এগিয়ে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। পাছে লোকে কিছু বলে—এই শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি যখন অফিস, সংসার—দুই-ই সামলাচ্ছেন; ফলে আপনি সব পারবেন। আপনার সাহস, আত্মবিশ্বাস আপনার সঙ্গেই আছে। হেরে গেলে চলবে না।
সুলতানা আলগিন : সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।