সাভারের বাথানটেকের মেয়ে সাথী আক্তার। অভাবের সংসারে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। থেমে যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন! তবু ভেঙে পড়ার পাত্রী নন সাথী। নিজের স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি হাল ধরেন সংসারেরও। সেই সঙ্গে শুরু করেন পড়াশোনার পাঠ। সাথীর মুখেই শোনা যাক তাঁর সংগ্রামী জীবনের সাতকাহন,
‘আজ থেকে ২০ বছর আগেও আমাদের এলাকা ছিল অনেকটা গ্রামের মতোই। সেখানে অন্য ১০ জনের মতো আমাদেরও সংসার চলত কৃষিকাজ করে। বাবা মৌসুমি ব্যবসার পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন। অভাবের সংসারের কারণে আমার পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায়। আমি ছোটবেলা থেকেই পড়ার পাশাপাশি শখ করে হাঁস-মুরগি পালতাম। সেগুলো বিক্রির টাকা দিয়ে দুই হাজার ৫০০ টাকায় একটি ষাঁড় বাছুর কিনি। এক বছর লালন-পালন করার পর সেটি বিক্রি করে দিই।
ষাঁড় বিক্রির টাকার সঙ্গে আরো কিছু টাকা যোগ করে ছোট্ট একটি বাছুরসহ শংকর জাতের গাভি কিনি। মূলত সেই গাভি আর বাছুর দিয়েই বাড়তে থাকে আমার গরুর সংখ্যা। খামারের পরিসরটা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাবাও নানাভাবে আমাকে সাহায্য করে। যার ফলে পাশাপাশি আমি লেখাপড়াটাও পুরোদমে চালিয়ে যেতে শুরু করি। বর্তমানে আমি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা আঞ্চলিক শাখায় সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক পড়ছি।’
সাথীর বাবা ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। বাবার যৎসামান্য আয়ে কোনো রকম টেনেটুনে সংসার চলত। কষ্টের সেই দিনগুলো নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বাবার আয় ছিল খুব সামান্যই। সেই সামান্য আয়ে এক রকম সংসার চলে যেত। দুই ভাইয়ের কেউই সংসারের কাজে তেমন কোনো সহযোগিতা করত না। ফলে আমাকেই মা-বাবার সঙ্গে মাঠের কাজ করতে হতো।
এমনকি যখন আমাদের গরু কেনা হয়, তখন থেকে আমি নিজেই মাঠে গিয়ে ঘাস কেটে আনতাম। প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে জমানো ভাতের ফেন বালতিতে বয়ে এনে গরুকে খাওয়াতাম। তখন আমাকে অনেকেই অনেক কথা বলত, তাতে আমি কিছুই মনে করতাম না। এমনও দিন গেছে, খেয়ে না খেয়ে সারা দিন গরুর খামারে কাজ করতাম। গোয়ালঘর পরিষ্কার করা, গোবর পরিষ্কার করা, গরুর খড়-বিচালি দেওয়া, নিয়মিত গোসল করানোসহ নানা ধরনের কাজ করতাম।
এভাবেই হাড়ভাঙা খাটুনির মধ্য দিয়ে গরুগুলো লালন-পালন করতাম।’ শুরুর সেই দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একটু একটু করে শুরুটা ছিল ১৯৯৮ সালে। এরপর ২০১৫ সালে এসে ফার্মের নাম দিলাম ‘মা-বাবার দোয়া ডেইরি ফার্ম’। একই বছর ট্রেড লাইসেন্সও নিলাম। ফার্মের একেকটা গাভি প্রায় ২০ কেজির মতো করে দুধ দেয়। এতে সার্বিক খরচ বাদ দিয়ে সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকার বেশি থাকে।
একজন নারী উদ্যোক্তা কিভাবে একটি ডেইরি ফার্ম গড়ে তুলল, সেটা দেখতে আমার ডেইরি ফার্ম পরিদর্শনে এসেছিল সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন কেন্দ্রের মাধ্যমে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের প্রতিনিধিদল। এ ছাড়া যুব উন্নয়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ফিজিশিয়ানও দেখে গেছেন আমার ফার্মের কার্যক্রম।’ ফার্মের পরিসর বৃদ্ধির পাশাপাশি ফার্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সাথী বেশ কিছু প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে আমি সাভারের শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি পালন, প্রাথমিক চিকিৎসা, মৎস্য চাষ ও কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিই। প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাভার থেকে ২০১৩ সালে গাভি পালন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এবং ২০১৫ সালে একই কেন্দ্র থেকে গরু মোটাতাজাকরণে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়েও প্রশিক্ষণ নিই। মূলত প্রশিক্ষণই আমাকে অনেকটা বদলে দিয়েছে। কারণ প্রশিক্ষণ থেকে শিখে আমি বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে পেরেছি।’
এখন ফার্মে আছে মোট পাঁচটি গরু। এর মধ্যে শংকর জাতের চারটি এবং একটি হলেস্ট্র্রিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের গরু। গত বছর ঈদে বেশ কিছু গরু বিক্রি করে দিয়েছি। এখন গরুর সংখ্যা কম হলেও কিছুদিনের মধ্যেই আনা হবে আরো বেশ কিছু গরু। তবে ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই গরুর সংখ্যা বাড়ানো হয়।
ফার্মে গরুর সংখ্যা বাড়াতে ২০১৬ সালে সোনালী ব্যাংক, সাভার থেকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছিলাম দুই লাখ টাকা ঋণ। সেই ঋণের টাকা দিয়ে কিনেছিলাম বেশ কয়েকটি গরু। আমি পরিশ্রমী। কাজ করতে আমি ভালোবাসি। সব সময় স্বাবলম্বী হতে চেয়েছি। জানি, এক দিনে অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। তাই ধীরে ধীরে নিজের আয়ের পথ তৈরি করেছি।
সেই আয় দিয়ে নিজেদের পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছি। এ ছাড়া আলাদা করে পাঁচ রুমের একটি বাড়ি বানিয়েছি। সেখান থেকেও বেশ কিছু টাকা ভাড়া বাবদ আসে। এখন বাড়িভাড়া আর খামারের আয়ের টাকা দিয়েই চলে আমাদের সংসার।’ ভবিষ্যৎ পরিকল্পানার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আমার খামারটি আরো বড় খামারে রূপান্তরিত করতে চাই। যাতে করে নিজের এলাকার মানুষদের দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণ করতে পারি।
এ ছাড়া দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যেন আমার খামারের সুনাম বিদেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেই লক্ষ্যেই আমার এগিয়ে যাওয়া। এতে নিজেদের আয়ের পাশাপাশি এ খামারে যাতে অন্যদেরও কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারি।’ সব শেষে নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে সাথী বলেন, ‘নতুন যদি কেউ এ পেশায় আসতে চান তাঁদের উদ্দেশে এটুকুই বলব, কোনো কাজকেই ছোট মনে করা যাবে না। নিজের কাজের জায়গাটাকে ভালোবাসতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে। পরিশ্রম করলে সব বাধাই অতিক্রম করা সম্ভব।’
তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ ডটকম।