মাস তিনেক হলো চা বিক্রি করছেন নাজমুল। দিনে ক্লাস করেন। সন্ধ্যার পর ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চা বিক্রি করেন। প্রতিদিন দুই থেকে তিন শ টাকা আয় হয়।
যিনি চায়ের কাপ হাতে এসেছেন, সেই ঘোর আড্ডায় তাঁর দিকে আলাদা দৃষ্টি দেওয়ার কারণ ছিল না। কিন্তু পাশে বসা একজনের প্রশ্নে শুধু তাকাতেই হলো এমন নয়, হকচকিয়েও উঠতে হলো। তিনি চা বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কী, ছোট ভাই, আজকে ক্লাস ছিল না?’ কাপ হাতে ধরিয়ে দিতে দিতেই মৃদু হেসে চা বিক্রেতা বললেন, ‘ছিল ভাই।’ এই সংক্ষিপ্ত কথোপকথনেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের আগ্রহ জেগেছিল।
মো. নাজমুল হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই তিনি চা বিক্রি করেন। সেই রাতে যেমন ছিলেন বিজয় একাত্তর হলের সামনে। চা বিক্রির এই উপার্জনেই নাজমুল নিজে চলেন, সহায়তা করেন পরিবারকে। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হলো, মানুষ শুধু মুখেই বলে—কোনো কাজকেই ছোট করে দেখা ঠিক নয়। কিন্তু কেউ কেউ তা করে দেখায়। এই করে দেখানো মানুষদের একজন নাজমুল হোসেন।
মাস তিনেক হলো চা বিক্রি করছেন নাজমুল। দিনে ক্লাস করেন। সন্ধ্যার পর ভ্যান নিয়ে বেরোন। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চা বিক্রি করেন। হয়তো সে রাতে দুই থেকে তিন শ টাকা আয় হয়। ক্লাসে পরীক্ষা থাকলে আগের দুই সন্ধ্যায় বের হন না।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে অনেকের মতো নাজমুলও টিউশনি শুরু করেছিলেন। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেননি। মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিলেন বলে সম্মানী পেতেন কম। সেমিস্টার ফাইনাল কিংবা জরুরি প্রয়োজনেও অনেক সময় ছুটি পেতেন না। ঠিক এই ব্যাপারগুলোই মানতে পারেননি নাজমুল। তিনি চিন্তা করলেন এমন কিছু করা উচিত, যেখানে তাঁর নিজের স্বাধীনতা থাকবে। ইচ্ছে হলে কাজ করবেন, না হলে করবেন না। তাঁর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার কেউ থাকবে না।
মায়ের জমানো হাজার চারেক টাকা আর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সহায়তা নিলেন। প্রথমে মুঠোফোন রিচার্জের কাজ শুরু করলেন। বসতেন মিরপুর ১০ নম্বরের কাছেই। কিন্তু প্রতিদিন মিরপুরে যাওয়া-আসা, দোকান চালানো, পড়াশোনা…ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তা ছাড়া ফুটপাতে ব্যবসারও আছে অনেক ঝামেলা। সব মিলিয়ে মুঠোফোন রিচার্জের দোকান বন্ধ করে দিলেন।
অভাব–অনটনের কারণে একবার ভেবেছিলেন, পড়াশোনা ছেড়ে দেবেন। নাজমুল হোসেন ভাবলেন, ‘না, যেভাবেই হোক টিকে থাকতে হবে! শেষ করতে হবে পড়াশোনা।’ তখন চিন্তা করে বের করলেন, তিনি মোটামুটি চা বানাতে পারেন। তাহলে তা-ই সই! মুঠোফোন রিচার্জের কাজ ছেড়ে জমানো টাকায় এই বিশেষ ভ্যানটি বানিয়ে নিলেন আর কিনলেন চা বানানোর সরঞ্জাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে যেখানে সন্ধ্যার পর অনেকে আড্ডা দিতে আসে, সেখানে আরও দু–চারটি দোকানের পাশে ভ্যান নিয়ে বসে গেলেন নাজমুল।
প্রথম দিন তাঁকে দেখে বন্ধু, পরিচিতজনেরা অবাক হয়েছিলেন। নানা জন নানা কথা বলেছিলেন। চা বিক্রি না করে কারও সহায়তা নেওয়ারও পরামর্শ দিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সাহায্য চাওয়ার চেয়ে কাজটাকেই তিনি বেছে নিলেন। সব মিলিয়ে ভালো আছেন নাজমুল। নিজের মতো চলছেন। নাজমুল বললেন, ‘টাকা জমাতে পারলেই কিস্তিতে একটা মোটরবাইক কিনে নেব। কোনো একটি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের হয়ে দিনের একটা সময় মোটরবাইক চালাব।’ তবে যত দিন না তা হচ্ছে, তত দিন চা বিক্রি ছাড়া উপায় কী? স্বাধীনচেতা মন নিয়ে লেখাপড়া আর পেট—দুই যে তাঁকে চালাতে হবে!
নদী গিলেছে বসতভিটা: শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাটের এক নিভৃত গ্রামে নাজমুল হোসেনদের বাড়ি। তবে এখন আর সেই বসতভিটা নেই। ২০১২ সালে নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে ভিটাবাড়ি। নিরুপায় হয়ে নাজমুলের বাবা সাত্তার হাওলাদার ও মা নাজমা বেগম পাড়ি জমান গাজীপুরে। চার সন্তান নিয়ে ঘোর সংকটে পড়েছিলেন নাজমুলের মা-বাবা। সামান্য পুঁজি নিয়ে বাবা একটা ছোট মুদিদোকান দেন।
এখনো সেই দোকানে কোনোরকমে সংসার চলে তাঁদের। নাজমুল হোসেন সবার বড়, কষ্টেসৃষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছেন। গাজীপুর সদরের হাতিমারা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এখন থাকছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে।
তথ্যসূত্র: প্রথমআলো ডটকম।