দেশের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজারে (এফএমসিজি) সুগন্ধি সাবানের ব্র্যান্ড লাক্সকে হারিয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছে শ্যাম্পুর ব্র্যান্ড সানসিল্ক। অবশ্য এ দুটি ব্র্যান্ডই দেশের এফএমসিজির বাজারে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশের। পণ্য বিক্রি, ক্রেতার পছন্দ ও বাজার বিস্তারের দিক দিয়ে শীর্ষে সানসিল্ক। দুই নম্বর অবস্থানে লাক্স।
বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে এ তালিকা করেছে স্প্যানিশ কোম্পানি কান্ডার ওয়ার্ল্ড প্যানেল, যারা বিশ্বব্যাপী পণ্যবাজার ও ব্র্যান্ড নিয়ে গবেষণা করে। চলতি মাসে প্রতিষ্ঠানটি ‘ব্র্যান্ড ফুটপ্রিন্ট-২০১৮’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ড ও দেশভিত্তিক সেরা ব্র্যান্ডের তালিকা করা হয়।
এবার বাংলাদেশে এফএমসিজির শীর্ষস্থানীয় ৫০টি ব্র্যান্ডের তালিকায় স্থান পেয়েছে ২৫টি দেশীয় ব্র্যান্ড। বাকি ২৫টি এ দেশে কর্মরত বিদেশি ও আমদানি পণ্যের ব্র্যান্ড। তবে এফএমসিজির উপখাত খাদ্য ও পানীয় শ্রেণিতে শীর্ষস্থান পেয়েছে দুটি বাংলাদেশি ব্র্যান্ড। এর মধ্যে একটি খাদ্যশ্রেণিতে সিটি গ্রুপের তীর এবং অন্যটি পানীয় শ্রেণিতে চায়ের ব্র্যান্ড ইস্পাহানী। খাদ্য, পানীয়, প্রসাধন, গৃহ পরিচর্যা ও দুধ মিলিয়ে এফএমসিজির বাজার।
স্পেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কান্তার ২০১৩ সাল থেকে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এ বছর ৪৩টি দেশের ১৮ হাজার ব্র্যান্ড প্রতিবেদনের আওতায় এসেছে। কান্তার বলছে, বৈশ্বিক এফএমসিজি খাত কয়েক বছর ধরে কঠিন সময় পার করছে। ২০১৭ সালে বিশ্বে এফএমসিজির বাজারে প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এফএমসিজির বাজার যুক্তরাষ্ট্রে গেল বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। লাতিন আমেরিকার বাজারে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে মূল্যস্ফীতির কারণে।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (বিক্রয় ও বিপণন) শোয়েব মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের ব্র্যান্ড মূল্য তৈরিতে জোর দিতে শুরু করেছে বেশি দিন নয়। আগে তারা বেশি জোর দিত পণ্যের গুণাগুণ অথবা সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর। এ কারণে দেশীয় কোম্পানি ব্র্যান্ডিংয়ে পিছিয়ে।
তবে দেড় দশক ধরে দেশি কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে জোর দিচ্ছে বলে দাবি করে শোয়েব মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কয়েক বছর আগেও সেরার তালিকায় এতগুলো দেশীয় ব্র্যান্ড ছিল না। আগামী পাঁচ বছর পর হয়তো দেখা যাবে, শীর্ষ ব্র্যান্ডের তালিকায় দেশীয় ব্র্যান্ডের সংখ্যাই বেশি। কারণ, দেশীয় কোম্পানি এখন শুধু ব্র্যান্ড তৈরির জন্য বিনিয়োগ করছে, জনবল নিয়োগ দিচ্ছে।
কান্তার প্যানেল সেরা ব্র্যান্ডের তালিকা করতে কনজিউমার রিচ পয়েন্ট (সিআরপি) নম্বর ব্যবহার করেছে। একটি দেশের মোট জনসংখ্যা, ওই জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষ পণ্যটি ব্যবহার করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্য কতবার কেনে—এসব মিলিয়ে তৈরি হয় সিআরপি। একটি ব্র্যান্ডের অধীনে বেশিসংখ্যক পণ্য থাকলে এবং সেসব পণ্য ভালো বিক্রি হলে কান্তারের তালিকায় এগিয়ে থাকা সম্ভব হয়।
প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছে ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত, এক বছর ধরে। বাংলাদেশে তাদের পক্ষে কাজ করেছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আইএমআরবি।
খাতভিত্তিক সেরা
খাদ্যশ্রেণিতে সেরা ব্র্যান্ড সিটি গ্রুপের তীর। এ ব্র্যান্ডের অধীনে প্রতিষ্ঠানটির ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, সুজি, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। কান্তারের হিসাবে বাংলাদেশের মোট পরিবারের ৩৯ শতাংশ তীর ব্র্যান্ডের পণ্য কেনে। বছরে গড়ে ৩ দশমিক ৭ বার একেকটি পরিবার তীরের পণ্য কেনে। এ খাতে সেরা পাঁচে রয়েছে নুডলসের ব্র্যান্ড কোকোলা, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা ও নেসলের ম্যাগি।
পানীয় শ্রেণিতে সেরা চায়ের ব্র্যান্ড ইস্পাহানী। বাংলাদেশের প্রায় ৪৩ শতাংশ পরিবারে পণ্যটি কেনা হয়। পানীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয় সেরা কোমল পানীয়ের ব্র্যান্ড সেভেন আপ। এটি কেনা হয় দেশের ৩৩ শতাংশ পরিবারে। পানীয়ের শ্রেণিতে সেরা পাঁচের মধ্যে বাকি তিন ব্র্যান্ড হলো ব্রুক বন্ড, সিলন ও হরলিকস।
প্রসাধনের ব্র্যান্ডে সেরা পাঁচে আছে সানসিল্ক, লাক্স, প্যারাস্যুট, পেপসোডেন্ট ও ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি। এর মধ্যে প্রথম হওয়া সানসিল্ক কেনা হয় দেশের প্রায় ৯১ শতাংশ পরিবারে। হোমকেয়ার পণ্যে সেরা ব্র্যান্ড রিন, হুইল, ভিম, তিব্বত বল সাবান ও ফাস্ট ওয়াশ। এর মধ্যে সেরা ডিটারজেন্ট ব্র্যান্ড রিন কেনা হয় ৮৮ শতাংশ পরিবারে। দুধের বাজারে সেরা ব্র্যান্ড মার্কস। এটি কেনা হয় প্রায় ২১ শতাংশ পরিবারে। এ ছাড়া এ খাতের সেরা পাঁচে আছে ডিপ্লোমা, ফ্রেশ, ডানো ডেইলি পুষ্টি ও মিল্ক ভিটা।
সেরা দেশি ব্র্যান্ড
সেরা ৫০টি ব্র্যান্ডের তালিকায় ২৫টিই দেশি ব্র্যান্ড। এগুলো হলো তিব্বত বল সাবান (১০তম), ফাস্ট ওয়াশ (১১), ইস্পাহানী (১৩), ফ্রেশ (১৪), তীর (১৬), স্যান্ডালিনা (১৭), কোকোলা (১৮), চাকা (২২), তিব্বত (২৩), কেয়া (২৪), মার্কস (২৫), আলমের পঁচা সাবান (২৯), মি. নুডুলস (৩১), প্রাণ (৩২), রাঁধুনী (৩৪), মেডি প্লাস (৩৫), চমক (৩৭), মেরিল (৩৮), পুষ্টি (৩৯), সিলন টি (৪০), এসিআই (৪২), কিউট (৪৫), স্যাভলন (৪৭), তিব্বত ৫৭০ (৪৮) ও ম্যাজিক (৫০)।
বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ। তাদের এফএমসিজির ১৩টি ব্র্যান্ড সেরা ৫০-এ স্থান পেয়েছে। সেরার তালিকায় দেশীয় শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে কোহিনূর কেমিক্যালস, এসিআই, স্কয়ার, মেঘনা, আবুল খায়ের ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পণ্যের ব্র্যান্ড সংখ্যা বেশি।
বৈশ্বিক সেরা ব্র্যান্ড
কান্তারের হিসাবে বিশ্বব্যাপী সেরা ব্র্যান্ডের মধ্যে এক নম্বর অবস্থানে আছে কোকাকোলা। বিশ্বের ৪১ শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে কোকাকোলা। একেকজন বছরে গড়ে প্রায় ১৩ বার কোকাকোলা কিনেছে। বিশ্বের সেরা ১০ ব্র্যান্ডের তালিকায় আরও রয়েছে কোলগেট, ম্যাগি, লাইফবয়, লেইস, পেপসি, নেসক্যাফে, ইন্দোমি, সানসিল্ক ও নর।
তথ্যসূত্র: প্রথমআলো ডটকম।