সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার মধ্যে যেসব দেশ উল্লেখ্যযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত সফলতার গল্প শুনিয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। এক সময় এ দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দরিদ্র দেশ বলা হতো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার পর এই অভিযোগ বহুদিন ধরেই শুনতে হয়েছে। কিন্তু ২০০৬ সালের পর থেকে প্রেক্ষাপট পাল্টেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর বরাতে ওয়াল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ করে বাড়তে থাকে। এ বছর প্রবৃদ্ধিতে ভারতকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বছরে ১ দশমিক ১ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ২ শতাংশ। এর অর্থ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা ৩ দশমিক ৩ শতাংশ করে। মাথাপিছু আয়ের হিসেবে ২০২০ সাল নাগাদ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলবে বাংলাদেশ।
কিন্তু কী করে এমন উন্নতি হলো বাংলাদেশের? ইতিহাসের যেকোনো ঘটনার মতোই এখানে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না, শুধু কিছু সূত্র পাওয়া যায়।এ বিষয়ে কৌশিক বসু বলছেন, এই উন্নতির পেছনে বড় একটি কারণ হলো নারীর ক্ষমতায়ন। যা সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই শুরু হয়।
নারীর ক্ষমতায়নের পেছনে সরকারি উদ্যোগ এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ অন্যতম। নারীদের শিক্ষাদান এবং তাদের সোচ্চার করে তুলতে এ ভূমিকা কাজে লেগেছে। এতে শিশুস্বাস্থ্য এবং শিক্ষার উন্নতি হয়েছে। ফলে গড় আয়ু বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর, যেখানে ভারতের ৬৮ বছর এবং পাকিস্তানের ৬৬ বছর।
আর্থিক খাতে অন্তর্ভূক্তিতে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বব্যাংক থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য থেকে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যেমন বাংলাদেশের যেসব মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী তাদের ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ ডিজিটাল লেনদেন করেছেন। পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে যার হার ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে, বাংলাদেশে যেখানে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ অ্যাকাউন্টে এক বছর কোনো লেনদেন হয়নি, সেখানে ভারতে এ ধরনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ৪৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির আরেকটি আংশিক ব্যাখ্যা হচ্ছে- গামের্ন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে সফলতা। এই সফলতাটি বেশ কিছু কারণে এসেছে। একটি উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট হচ্ছে- বাংলাদেশে প্রধান গামের্ন্টস প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য ভিন্ন শ্রম আইন প্রবর্তন করা হয়। ভারতের মতো দেশে যেটা করা হয়নি।
সব শ্রমবাজারের জন্য আইন প্রণয়নের দরকার। কিন্তু ১৯৪৭ সালে শ্রমিক আইন ভারত বা পাকিস্তান তেমন পরিবর্তন করেনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে শ্রমিকদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করা হয়। তবে এখন শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য আরও উপযুক্ত আইন প্রণয়ন জরুরি, বর্তমানে যে আইন আছে তা নতুন কর্মসংস্থান এবং শিল্প ক্ষেত্রে উন্নতির যথেষ্ট কাজে এসেছে।
এ পর্যায়ে এসে একটি প্রশ্ন- তা হলো, বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা কি বজায় থাকবে? বর্তমানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছু ঝুঁকিও রয়েছে, যা নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় নিতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং বৈষম্য বাড়তে থাকে। এসব অন্যায় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে উন্নতির গতি থেমে যেতে পারে। বাংলাদেশেও ঘটতে পারে এমন ঘটনা।
এর চেয়েও বড় একটি সমস্যা দেখা দিতে পারে বাংলাদেশে, আর তা হলো সামাজিক উন্নয়নের বিপক্ষে গোঁড়া সনাতনপন্থী এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদের অবস্থান। এ ব্যাপারটি মোটেও অবহেলা করবার মতো নয়। সামাজিক উন্নয়ন থেমে গেলে অর্থনীতি ধ্বংস হতে সময় লাগবে না।
কৌশিক বসু বলছেন, এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার নেয়া পদক্ষেপে আগামীতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি অপার সম্ভাবনার দেশে পরিণত হবে।
তথ্যসূত্র: আরটিভি অনলাইন।