মুকিম আহমেদ একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি উদ্যোক্তা ও সমাজসেবক। ৪০ বছর ধরে বাস করছেন টাওয়ার হ্যামলেট এ। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। ১৯৭০সালে লন্ডনের ব্রিক লেনে নিজ মালিকানায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাজ সিনেমা হল’। ২৬বছর বয়সে নিজেকে নিয়ে যান মিলিয়নিয়ার এর কাতারে।
বেড়ে ওঠা
১৯৫৪ সালের ১সেপ্টেম্বর সিলেটে জন্ম মুকিম আহমেদের। বাবা মোবারক আহমদ ও মা ওমরজান বিবি। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বন্টু বার্ড স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যাচের ছাত্র মুকিম আহমদ।সেখানে থেকে এসে ভর্তি হলেন কুমিল্লার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আওয়ার লেডি ফাতিমা কনভেন্ট-এ। সে সময় স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন মার্কিন নাগরিক সিস্টার লিও। ভালো ছাত্র বলে এই শিক্ষিকার নজরে পড়েন মুকিম। সিস্টার লিও স্বদেশে চলে যাওয়ার সময় মুকিম আহমদকে যশোরের দাউদ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যান। সেই স্কুল থেকে ১৯৬৯ সালে চারটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে সিলেট সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক এবং পরে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকে ভর্তি হন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার আগেই ১৯৭৪ সালে প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়তে চলে আসেন ব্রিটেন।
মিলিয়নিয়ার হওয়ার গল্প
বাংলাদেশে ছিলো মুকিম আহমেদের বাবার ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা।তাই ব্রিটেনে লেখাপড়ার পাশাপাশি ধীরে ধীরে পা বাড়ান ব্যবসার দিকে। প্রথমে ব্রিটেন থেকে দেশে আমদানি-রপ্তানি শুরু করেন। নিজেদের ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসার লন্ডনের বায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ছাড়াও ব্রিটেন থেকে বেডফোর্ড ট্রাক এবং জাপান থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি শুরু করেন। সে সময় গড়ে প্রতি মাসে ব্রিটেন থেকে পাঁচটি এবং জাপান ও হল্যান্ড থেকে দুটি কনটেইনার বাংলাদেশে পাঠাতেন মুকিম আহমেদ।
এভাবেই ১৯৭৭ সালে মুকিম আহমদ পুরোপুরি ব্যবসায় লেগে যান। আর সে বছরই তাঁর নামের সঙ্গে লেগে যায় মিলিয়নিয়ার তকমাটা। মাত্র ২৬বছর বয়সে ব্রিকলেনের প্রথম বাংলাদেশি মিলিয়নিয়ার হন তিনি। যদিও স্বীকৃতিটা আসে অনেক পরে। ১৯৮৫ সালে ব্রিটিশ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আইটিভি প্রথম বাংলাদেশি ‘মিলিয়নিয়ার’ হিসেবে ঘোষণা করে তাঁর নাম। এরপর শুধু ব্রিটেনই নয়, ইউরোপসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলো থেকেও হরেক রকম যন্ত্রপাতি আমদানি-রপ্তানির কাজ শুরু করেন।
হরেক রকম ব্যবসা
সত্তরের দশকেই একের পর এক ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন মুকিম আহমদ। কারি ব্যবসা থেকে শুরু করে প্রপার্টি ব্যবসা, ট্রাভেলস ব্যবসা, আমদানি-রপ্তানি, বিনোদন, প্রকাশনা, রিটেইলিং ব্যবসা- সব ক্ষেত্রেই তিনি সফল। এই নানামুখী ব্যবসার সাফল্য আর নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে খ্যাতির শিখরে। একসময় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ বিমানের সর্ববৃহৎ অপারেটর হিসেবে।বিনোদনের প্রতি রয়েছে মুকিম আহমেদের বাড়তি ঝোঁক। আর তাই ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে বাংলা সংস্কৃতি চর্চার একটি দ্বারও উন্মোচোন করেন তিনি।১৯৭৮ সালে শুরু করেন মিউজিক প্রোডাকশন ব্যবসা।
বাংলাদেশ থেকে শিল্পীদের এনে নিজের স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং ও সেগুলো ইংল্যান্ডের বাজারে ছাড়তে শুরু করেন মুকিম আহমেদ। নিজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে এ ব্যবসায় নেমেছিলেন বলেও জানান তিনি। আর ১৯৭৮ সালে কিনে নেন পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেনে একটি ফ্রি হোল্ড সম্পত্তি (ওডিয়ন হল)। সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন নাজ সিনেমা। এটি ছিলো বিলেতে এশীয় মালিকানাধীন প্রথম সিনেমা হল। তিনি বাংলাদেশ থেকে চলচ্চিত্র আমদানি করে সেখানে বড় পর্দায় দেখাতে শুরু করেন। সত্তরের দশকে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র তৎকালীন ব্রিটেন প্রবাসীদের কাছে পৌঁছে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। যথাযথ নিয়মের মাধ্যমে দেশীয় চলচ্চিত্রের ভিডিও ক্যাসেট তৈরি ও বাজারজাত করার মাধ্যমে সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোকে ব্রিটেন প্রবাসীদের হাতে পৌঁছে দিতেন।
বেতার বাংলা‘র চেয়ারম্যান
ব্রিটেনের বেতার বাংলার চেয়ারম্যান মুকিম আহমদ। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২৪ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে রেডিওটি। বেতার বাংলা সম্পর্কে মুকিম আহমদের অভিমত হলো, এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেটা আমাদের মাতৃভূমিকে মনে করিয়ে দেয়। বেতার বাংলা যখন শুনি, তখন মনে হয় দেশেই আছি। এর মধ্য দিয়ে আমাদের আগামী প্রজন্ম, বাংলাদেশ, এর সংস্কৃতি, সংগীত ও নাটক সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে।’
ব্যবসায় হাতের যশ
সত্তরের দশকের শেষের দিকে পূর্ব লন্ডনে মুকিম আহমেদ প্রতিষ্ঠা করেন ‘সিলটো ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি’। প্রতিষ্ঠানটি রেডিও, টেলিভিশন, ক্যাসেট, ক্যালকুলেটর ইত্যাদি ব্রিটেনজুড়ে বাজারজাত করত। আশির দশকে প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক আয় ছিল প্রায় ২০হাজার পাউন্ড। সিলটো ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি পরে সিলটো পিএলসিতে (প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি) রূপান্তরিত হয়ে বৈদ্যুতিক গৃহসামগ্রী লন্ডন থেকে স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, ইতালি ও নিউ ইয়র্কে রপ্তানি শুরু করে। এই সিলটো পিএলসি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ব্রিটেনে প্রথম প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। ভাইদের সঙ্গেও যৌথভাবে তিনি শিপিং ব্যবসাও পরিচালনা করেন।
১৯৯৬ সালে মুকিম আহমদ ব্যবসার ধরন পাল্টে যুক্ত হন ক্যাটারিং ব্যবসায়। ব্রিকলেনে ‘ক্যাফে নাজ’ নামে রেস্তোরাঁ চালু করেন। এখানেও পান সাফল্যর হাতছানি। ‘ক্যাফে নাজ’ হয়ে ওঠে ব্রিকলেনের সবচেয়ে বড় রেস্তোরাঁ। ধীরে ধীরে মুকিম আহমদ এই ব্যবসার পরিধি আরো বাড়িয়েছেন। এখন খ্যাতনামা ছয়টি রেস্তোরাঁর মালিক তিনি। ক্যামব্রিজ, কার্ডিফ, চেমসফোর্ড, হরশ্যাম- এসব এলাকায় শাখা স্থাপনের মাধ্যমে ক্যাফে নাজ ছড়িয়ে পড়েছে ব্রিটেনজুড়ে। ২০০০ সালে লন্ডন সিটিতে ৩৫০আসনের একটি রেস্তোরাঁ কিনে অন্য রেস্তোরাঁগুলোর সমন্বয়ে চেইনশপ চালু করেন। তাঁর রেস্তোরাঁগুলো পুরো ব্রিটেনে জুড়ে পায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
ঝড়ঝাপটাও গেছে
২০০১ সালে ব্রিকলেনে ক্যাফে নাজ রেস্তোরাঁয় বর্ণবাদী সন্ত্রাসীদের বোমা হামলা হয়।এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রেস্তোরাঁটি। আহত হয় ১৩ জন।সুপ্রসন্নভাগ্যে বেঁচে যান মুকিম আহমদ ও তাঁর পরিবার। তবে এটি ছিলো তার ব্যবসায় বড় রকমের ধাক্কা। কিন্তু স্বল্প সময়েই তা কাটিয়ে ওঠেন। এখন সেখানে তিনি নির্মাণ করছেন একটি পাঁচতারা হোটেল।বর্তমানে মুকিম আহমদ ব্রিটেনের শত বছরের পুরনো মার্শালস বেকারি অ্যান্ড রেইনার্স বেকারি কিনে; ব্রিটেনের স্কুল, হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তৈরি খাবার সরবরাহ করছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর বিনিয়োগ প্রায় দুই মিলিয়ন পাউন্ড।
রাজনীতি ও পারিবারিক জীবন
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে ও মেয়ের বাবা। সপরিবারে এখন ব্রিটেনেই আছেন। একজন সফল ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও কমিউনিটি নেতা হিসেবে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতিতেও সক্রিয় মুকিম আহমদ। কনজারভেটিভ পার্টির রাজনীতির সঙ্গে তিনি জড়িত।মুকিম আহমেদ কনজারভেটিভ ফেন্ডস অব বাংলাদেশ গ্র্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।তার ব্যবসা-বাণিজ্যে ও ইস্টলন্ডনের কম্যূনিটিতে অসামন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ম্যারি কুইন কলেজ তাকে অনারারি ফেলো নির্বাচিত করা হয়। তিনি ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের ৩বার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন।
পুরস্কারের ঝুলি
১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে এশিয়ার শীর্ষ ২০০ ধনীর একজন নির্বাচিত হন মুকিম আহমদ। ২০০৫ সালে তাঁকে কিং অব ব্রিকলেন এবং ২০০৭ সালে কারি কিং হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্রিটেনের শতবর্ষের পুরনো প্রোপার্টি জার্নাল ‘এস্টেট গেজেট’। অনেক আবার তাঁকে প্রপার্টি কিং নামেও ডাকেন। ২০১২ সালে ক্ষমতাধর ১০০ ব্রিটিশ-বাংলাদেশির তালিকায় যুক্ত হন মুকিম আহমেদ। ১৯৯১ সালে বিবিসি টেলিভিশন তাঁর ওপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রচার করে।
লেখক: মুতাসিম বিল্লাহ নাসির
তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট।