জুমভিত্তিক চাষাবাদ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসছেন পাহাড়িরা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির বাজার তৈরি, লাভজনক ফল-ফসলের ব্যাপক ফলন, প্রাচীন বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও যেখানে পরিবহন ব্যবস্থা তুলনামূলক সহজ হয়েছে, সেখানে বাড়ছে আম, কফি, কাজু বাদামসহ বিভিন্ন অর্থকরী ফসলের আবাদ।
স্থানীয় ভাষায় ‘তাম’ বা কাজু বাদাম এমন একটি ফসল। দামি ফল হিসেবে কাজুর পরিচিতি সবার কাছে। আমদানি নির্ভর এ ফলটি নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে পাহাড়ে। বাধা শুধু সংরক্ষণে সমস্যা আর পোস্ট প্রসেসিং বা উৎপাদনের পর খাওয়ার উপযোগী করে প্রস্তুতকরণে। উৎপাদন ও চাষাবাদ যে হারে বাড়ছে তাতে খুব শিগগিরই পাহাড়ে কাজু ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বান্দরবান থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা থানচির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় অন্য ফসলের পাশাপাশি ব্যাপকহারে বেড়েছে কাজু বাদামের চাষ। পাহাড়িরা যে চাষাবাদে লাভ বেশি সেটা ঝোঁকেন বেশি। এমনকি জমিতে অন্য ফসল থাকলেও তা কেটে নতুন অর্থকরী ফসলে মনোযোগ দেন। ৪০-৫০ বছর ধরেই বান্দরবানের পাহাড়ে কাজু চাষ হচ্ছে। তবে বাণিজ্যিক চাষাবাদ বেড়েছে সম্প্রতি। বিশেষ করে সবশেষ দুই বছরে।
পাহাড়ে কাজু বাদাম চাষ বাড়তে দীর্ঘদিন কাজ করছেন রুমা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান। কথা হলে তিনি বলেন, পাহাড়ি মাটি, আবহাওয়া সবই কাজু বাদাম চাষের বিশেষ উপযোগী। তাছাড়া পরিচর্যা ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় অতিরিক্ত কোনো খরচ নেই। আর আগে দাম না পাওয়ার যে বিষয়টি ছিল সেটি এখন নেই।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রথমে পাহাড়ের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে কিছু কফি ও কাজু বাদামের চারা সরবরাহ করে। সেটা আগের কথা। কিন্তু ২০১৬ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রপ্তনিযোগ্য অগ্রাধিকার কৃষিপণ্য হিসেবে কাজু বাদাম চাষে গুরুত্ব দেয়। থানচিতে একটি সচেতনতামূলক সেমিনারও করা হয়। এতে মন্ত্রণালয়ের সচিবও উপস্থিত ছিলেন। এরপর থেকে এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে থাকে। একই সঙ্গে যে বাদাম মণপ্রতি ১ হাজার টাকা বিক্রি হতো তার দাম গিয়ে ঠেকে ৪ হাজার টাকায়।’
এ বিষয়ে কথা হয় বান্দরবান জেলা কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ড. আক্কাস মাহমুদ, থানচি উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। হুমায়ুন কবির বলেন, ২০১৫ সালের আগে কাজু বাদামের বেশি পরিচিতি ছিল এলাকায়। সবাই একে ‘তাম’ বলতো। তখন দামও ছিল ২০-২৫ টাকা কেজি। ২০১৬ সালের পর সেই দাম গিয়ে ঠেকেছে কেজিপ্রতি ১২৫ টাকা পর্যন্ত।
অথচ এই কাজু সাধারণ মানুষকে কিনতে হয় কেজিপ্রতি ১২শ থেকে ২ হাজার টাকা দরে। এর কারণ কি জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর বলেন, কাজু বাদামের মূল চ্যালেঞ্জ পোস্ট প্রসেসিং ও সংরক্ষণ। আমাদের দেশে কোনো মেশিন নেই, যাতে পোস্ট প্রসেসিংয়ের কাজ করা যায়। তাছাড়া সংরক্ষণও কেউ ঠিকমতো জানতো না। কাজু এমন একটি ফল যেটি কাঁচা বেশি খেতে পারবেন না। ফলটি হয় দুই স্তরে। উপরের অংশটুকু মোটা। নিচের অংশে বাদাম। এর ভিতরে এক ধরনের আঠাজাতীয় জিনিস থাকে। এটা মুখে বা হাতে লাগলে ঘা হতে পারে। আবার উপরের অংশটি প্রসেস করতে পারলে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল পাওয়া সম্ভব।
‘বর্তমানে রুমা আর থানচি উপজেলায় বেশি পরিমাণ কাজুর চাষ হচ্ছে। জুম চাষিরা আগে একটি পাহাড় পরিষ্কার করলে পরে কয়েকবছর আর সে জমিতে চাষ করতে পারতো না। আমরা পরামর্শ দিচ্ছি ওইসব জমিতে কাজু বাদাম লাগানোর। এতে তারাও লাভবান হচ্ছে। এখন প্রায় ৩শ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। আর পুরো পাহাড় ধরলে হয়তো ৫শ হবে। বীজ থেকে চারা হয়। চারা লাগানোর তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ফল ধরে। ফেব্রুয়ারি-মার্চে ফুল ধরে। ফল সংগ্রহ করা হয় মে মাসে।
রোগ-বালাইও কম। আর একটি গাছে জাতভেদে ৪ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত বাদাম হয়। সাধারণত পেকে নিচে পড়ে গেলে সংগ্রহ করে শুকানো হয়। আর শুকালে ১ বছর রাখা সম্ভব।’ পোস্ট প্রসেসিংয়ের কাজ করা যায় না বলে পাইকাররা ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করেন। আবার প্রসেসিং হয়ে আমাদেরেই এগুলো কিনতে হয় কয়েক গুণ বেশি দামে। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বাদাম চাষে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রণালয় প্রসেসিং মেশিনের ও ইন্ড্রাস্ট্রি তৈরির বিষয়ে আগ্রহী। এর জন্য দরকার ৪-৫ কোটি টাকা। আর যদি আরও এক হাজার কৃষকের মাধ্যমে এক হাজার হেক্টর জমিতে কাজু বাদামের চাষ করা যায় তাহলে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব। উল্টো রপ্তানির চিন্তা করা যেতে পারে। এখন অপেক্ষা শুধু সরকারি যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার।
তথ্যসূত্র: বাংলানিউজ২৪ ডটকম।