‘স্বল্পভাষি বলে মানুষের সাথে মেশা হয় না খুব একটা। তারপরও নিজ থেকে কিছু করার চেষ্টা সব সময় মাথায় ঘুরপাক খেত। মনে-মনে ভাবতাম, আশেপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে কিছু একটা যায় কি না। ভাবনাগুলোকে জড়ো করে স্বপ্ন দেখতাম।’ তখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে কেউই চেনেন না তাকে। তিনি বললেন, সময়টা ১৯৯২ সাল।
হিসাব বিজ্ঞানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.কম শেষ করে এস. আহমেদ অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টে সি.এ (সিসি) শেষ করি ১৯৯২ সালে। এই সময়টাতেই একটু-একটু করে নিজের জীবন চালানোর একটা গন্তব্য খোঁজা শুরু করলাম। বলতে গেলে- মানুষের সাথে মেশার, কাছে আসার সেতুটি তৈরি করে দেয় ‘চন্দনাইশ সমিতি’। এই সমিতির সভাপতিও আমি।
তখনও চট্টগ্রামের মানুষ ফ্ল্যাট ক্রয়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। খুব বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেনি ফ্ল্যাট ব্যবসা। তিনি ভাবতে লাগলেন, চট্টগ্রামের মানুষকে কিভাবে ফ্ল্যাট ক্রয়ে আগ্রহী করা যায়। সাধ্যের মধ্যে মানুষকে ফ্ল্যাট কেনার ব্যবস্থা করে দেয়া যায়। যে চিন্তা সেই কাজ। সিদ্ধান্ত নিলেন ফ্ল্যাট ব্যবসা শুরু করবেন। সেই থেকে বেসরকারি আবাসনের চাহিদা পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন ‘এয়ারবেল ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজিস লিমিটেড’ নামে আবাসন প্রতিষ্ঠান। দেশের পর্যটন শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করে তুলতে তিনি কক্সবাজারের সি বিচ এলাকায় গড়ে তুলেন, আধুনিক হোটেল ‘দি কক্স টুডে’।
প্রিয় পাঠক- এতোক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন, চট্টগ্রামের আবাসন শিল্পের অন্যতম ও অনন্য উদ্যোক্তা আবদুল কৈয়ুম চৌধুরী। চট্টগ্রামে পরিকল্পিত নগরায়ন ও আবাসন এবং আবাসন শিল্পের নেতৃত্বেও দিচ্ছেন তিনি। রিহ্যাবের ভাইস -প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম জোনাল কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীর নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে বসবাস করলেও ১৯৬৮ সালের ৩১ জানুয়ারি চন্দনাইশ উপজেলার দক্ষিণ হাসিমপুর সম্ভ্রান্ত সৈয়দাবাদ চৌধুরী বাড়িতে জন্ম গ্রহন করেন তিনি। পাঁচ ভাই সাত বোনের মধ্যে আবদুল কৈয়ুম চৌধুরী পঞ্চম।
সহধর্মিনী সায়রা জাফরিন। তিন কন্যা নেইলা চৌধুরী, নাসরা চৌধুরী, নৌশরিন চৌধুুরীকে নিয়ে সুখের সংসার তাঁর। ভাত ও মাছ খেতে পছন্দ করেন কৈয়ুম চৌধুরী। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন যেকোন পোশাকে। প্রিয় মানুষ মা মরহুমা আলতাজ খাতুন ও বাবা মরহুম মোকলেসুর রহমান চৌধুরী।
কৈয়ুম চৌধুরী ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন এয়ারবেলসহ হোটেল দি কক্স টুডে, ফাইভ স্টার স্ট্যান্ডার্ড লাক্সারি হোটেল, সুইট ড্রিম ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, স্কাইল্যাব এগ্রো ফার্মস লিমিটেড, চন্দনাইশে। চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন গ্ল্যাসিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড, ঢাকা। এর বাইরে ‘চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ’র স্বত্বাধিকারী এবং গ্লাক্সি ইঞ্জিনিয়ারস অ্যান্ড বিল্ডার্সের ম্যানেজিং পার্টনার তিনি। চট্টগ্রামের পিপলস হসপিটাল লিমিটেড এবং মিডপয়েন্ট হসপিটাল অ্যান্ড ম্যাটারনিটি সেন্টার লিমিটেড’র পরিচালকও তিনি।
শুধু যে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি ঈর্ষণীয় হয়েছেন তাই নয়, নেতৃত্বে অসাধারণ গুণাবলীর কারণে একজন ব্যবসা ও ব্যবসায়ীবান্ধব সফল নেতা হিসেবেও তিনি সবার কাছে জনপ্রিয়। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত আবদুল কৈয়ুম চৌধুরী, আর সেই গুণাবলী তাঁকে দিয়েছে এক অন্যরকম মহিমা।
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, গাছবাড়িয়া গভর্মেন্ট কলেজের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে গাছবাড়িয়া এন জি মডেল স্কুল, চন্দনাইশ, চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম’র চেয়ারম্যান তিনি। জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কক্সবাজার, চন্দনাইশ সমিতি, চট্টগ্রাম-এ। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন, চন্দনাইশ এর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন। চন্দনাইশ অটিস্টিক অ্যান্ড ডিসঅ্যাবল অ্যাসোসিয়েশন, চন্দনাইশ-এরও প্রধান উপদেশ্টা তিনি।আজীবন সদস্য হিসেবে আছেন, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হসপিটাল, ডায়াবেটিক হসপিটাল, কদম মোবারক এতিমখানা, চট্টগ্রাম-এ। এছাড়া চট্টগ্রাম ক্লাবেরও সম্মানিক একজন সদস্য তিনি।
চট্টগ্রামের আবাসন শিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলাপ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আবাসন ব্যবসার ক্রান্তিকাল ছিল। ওই সময়টাতে আবাসন ব্যবসায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়- যারা রিহ্যাবের মেম্বার নন তারাও এই ব্যবসা শুরু করেন। পেশাগত দায়বদ্ধতা না থাকার কারণে গুণগত মান রক্ষা করতে না পারায় ক্রেতাদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। ওইসব প্রতিষ্ঠান রিহ্যাবের সদস্য না হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া যায়নি। ফলশ্রুতিতে আবাসন ব্যবসায় ধস নামা শুরু করে।
তিনি বলেন, তবে আমি মনে করি ২০২১ সালের মধ্যে যখন সবাই রিহ্যাবের মেম্বার হয়ে যাবে। তখন এই আবাসন ব্যবসায় কেউ প্রতারণা করার সুযোগ পাবে না। আর তখন মানুষ কোন ধরনের শঙ্কা ছাড়াই ফ্ল্যাট ক্রয় করবে। চাঙ্গা হয়ে উঠবে এই ব্যবসা।
কৈয়ুম চৌধুরী বলেন, বহুতল ভবন নির্মাণে সরকারের ইতিবাচক ভূমিকার কারণে বর্তমানে আবাসন ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, প্লট হলে বেশি জায়গায় কম মানুষকে আবাসনের ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু বহুতল ভবন হলে কম ভূমিতে অনেক মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা যায় যার মাধ্যমে আমাদের মতো জনঘনত্বপূর্ণ দেশে ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। তিনি বলেন, অবশ্যই আগের তুলনায় এখন ফ্ল্যাটের দাম কম। খুলশী এলাকায় একসময় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় প্রতি বর্গফুট বিক্রি হলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকায়।
আগ্রাবাদ ও হালিশহর এলাকায় প্রতি বর্গফুট ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় যেমন মেলে তেমনিভাবে এই এলাকায় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা বর্গফুটেও ফ্ল্যাট পাওয়া যাচ্ছে। আবাসন ব্যবসাকে সহজ করতে হলে ফ্ল্যাট কেনায় সরকারি ভোগান্তি অচিরেই দূর হবে হবে বলেও জানান তিনি। এছাড়া কালো টাকা সাদা করার জন্য বিনিয়োগ করা হলেও দুদক তা জানতে চাইতে পারে। এতে অনেকে ফ্ল্যাট কিনতে চাইলেও সরকারের নজরদারির কারণে পারছে না। তিনি বলেন, ফ্লাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি কমানো হলে ক্রেতারা ফ্লাট কিনতে সাহস পাবে।
কৈয়ুম চৌধুরী বলেন, ক্রেতারা যাতে সহজ শর্তে ঋণ পায়, সেজন্য একটি তহবিল করার জন্যও প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে স্বল্প সুদে ঋণ ও সরকারের পক্ষ থেকে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের মাধ্যমে এই শিল্প এগিয়ে যেতে পারে। তহবিল গঠন হলে মানুষ সহজ সুদে ঋণ পাবে। বর্তমানে ব্যাংক থেকে ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পেলেও, তহবিল গঠন হলে তা পাওয়া যাবে ৫ থেকে ৭ শতাংশ সুদে। এতে এই শিল্প আরও এগিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আজন্ম বুকে ধারণকারী এই সফল ও সার্থক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন সবসময়। বলেন, কলেজ জীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। আগামীতে চট্টগ্রাম -১৪ (চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া) সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামীলীগের হয়ে নির্বাচনে লড়ার সপ্ন দেখি। মানুষের আরও কাছাকাছি যেতে চাই। ওখানেই সত্যিকারের ভালোবাসা থাকে।
হাকিম মোল্লা
তথ্যসূত্র: দ্যা ক্লিক ম্যাগাজিন ডটকম।