মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে একজন শিক্ষানবিশ কর্মী হিসেবে বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসে (বিএসআরএম) যোগ দিয়েছিলাম আমি। সেটা ২০০০ সাল। পাঁচ-ছয় বছর কারখানায় কাজ করেছি। এরপর ধীরে ধীরে সরবরাহ-ব্যবস্থা, বিপণন এবং হিসাব ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে কাজ করেছি। প্রায় নয় বছর কোম্পানির বিভিন্ন শাখায় কাজ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই আমাকে এ অবস্থানে আসতে হয়েছে। শিক্ষাজীবনে আমি অর্থনীতিতে স্নাতক করেছি কানাডায়, পরে লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করি।
আসলে বাপ-দাদার প্রতিষ্ঠান বলে শুরুতেই বড় পদে নিয়োগ পাব—এমন আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে কখনোই ছিল না। কারণ, আমি জানি, এই সংস্কৃতি আমাদের পরিবার বা প্রতিষ্ঠানে নেই। আমার বাবা বা মামাকেও আমার মতো কাজ করে সক্ষমতা প্রমাণ করে শীর্ষ পদে উঠতে হয়েছিল। তাঁদের পথ ধরে তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমি এ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়েছি।
প্রসঙ্গক্রমে আমাদের ৬৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় বাংলার ১৮টি ইস্পাত কারখানার সব কটিই পড়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ইস্পাতের মতো অন্যতম মাতৃশিল্প-বঞ্চিত (mother industry) এ ভূখণ্ডের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম ইস্পাত কারখানা বিএসআরএম। আমার পূর্বপুরুষ তাহের আলী আফ্রিকাওয়ালা ও আকবর আলী আফ্রিকাওয়ালা চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে এ দেশের প্রথম রোলিং মিলটি গড়ে তুলেছিলেন। বলে রাখি, একসময় আফ্রিকায় ব্যবসা করতেন বলে তাঁদের নামের সঙ্গে ‘আফ্রিকাওয়ালা’ পদবিটি যুক্ত হয়ে গেছে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নির্মাণশিল্প ও প্রবৃদ্ধিতে বিএসআরএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন সব কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণ হচ্ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বিএসআরএমের কারখানাটি উদ্যোক্তা-পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আমার বাবা ও মামা যথাক্রমে আলীহুসাইন আকবর আলী ও জোহাইর তাহের আলী এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন।
বর্তমানে আমরা নিয়মিত এই পরীক্ষা করিয়ে যাচ্ছি। আইএসও-বিডিএস ৬৯৩৫ অনুযায়ী বিএসআরএম এক্সট্রিম ৫০০ গ্রেড রডের সব নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যই অর্জন করেছে। এভাবে বিশ্বের ১০টিরও বেশি দেশের কনস্ট্রাকশন স্টিলের মান বিএসআরএম ইতিমধ্যেই অর্জন করেছে আধুনিক প্রযুক্তি এনে, উন্নততর ইস্পাতপণ্য উৎপাদন করে দেশের স্থাপনাশিল্পকে যুগোপযোগী ও নিরাপদ করতে বিএসআরএম অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছে। শুধু প্রথম কারখানাই নয়, বাংলাদেশের ইস্পাতশিল্পের প্রায় সব অর্জনই এসেছে বিএসআরএমের হাত ধরে। দেশে উচ্চশক্তির কোল্ড-টুইস্ট স্টিল বার (রড) ১৯৮৪ সালে প্রথম নিয়ে আসে বিএসআরএম। এরপর ৬০ গ্রেড রড প্রথম উৎপাদন ও জনপ্রিয় করে এই প্রতিষ্ঠান। সেটা ১৯৮৭ সালের ঘটনা। ১৯৯৬ সালে সেই সময়ে দেশের বৃহত্তম বিলেট ফ্যাক্টরি স্থাপন করি আমরা।
আমি যখন এর দায়িত্বভার বুঝে নিই, তখন আমার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সেদিক থেকে কিছুটা সাফল্যের দাবি হয়তো আমি করতে পারি। আমার দায়িত্ব গ্রহণের সময় প্রতি মাসে এ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ছিল সাড়ে তিন হাজার টন, বর্তমানে এর পরিমাণ ৬০ হাজার টন।
২০০৬ সালে সাশ্রয়ী নির্মাণের উপযোগী মাইক্রো-রিইনফোর্সড ওয়্যার রডের প্রচলনও করে বিএসআরএম। আধুনিক নির্মাণকাজে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের রড গ্রেড ৫০০ স্টিল ‘এক্সট্রিম ৫০০ ডব্লিউ’ দেশে প্রথম আমরা নিয়ে আসি ২০০৮ সালে। ঘনবসতির শহরগুলোয় বহুতল ভবন নির্মাণে এটি বিশ্বে নিরাপদ ও জনপ্রিয় রড। ২০০৯ সালেই আরও বৃহত্তর উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিলেট কারখানা ‘বাংলাদেশ আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’ স্থাপন করেছি আমরা। সম্প্রতি বিএসআরএম দেশে প্রথম উচ্চশক্তির অ্যাঙ্গেল ও চ্যানেল পণ্য এক্সট্রং ৩৪৫ নিয়ে আসে, যা এএসটিএম ৫৭২ গ্রেড ৫০ মান স্বীকৃত। এএসটিএম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মান নির্ধারণ-পদ্ধতি। বর্তমানে দেশের বৃহত্তম ইনডাকশন ফার্নেস-নির্ভর বিলেট কারখানা নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। অল্প সময়ের মধ্যে বিএসআরএমের এই প্ল্যান্ট উৎপাদনে যাবে আশা করছি।
আমরা সব সময় বিশ্বব্যাপী মান নির্ধারণের সর্বশেষ সংস্করণের একই কাতারে নিজেদের পণ্যকে রাখতে চেয়েছি। ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ অনেক আন্তর্জাতিক মান অর্জন করে বিএসআরএম আজ দেশের ইস্পাতশিল্পকে উন্নত বিশ্বমানের সমান্তরালে নিয়ে এসেছে। জাপান, নিউজিল্যান্ড ও ইতালির মতো ভূমিকম্পপ্রবণ দেশের জন্য নির্ধারিত মানও অনুসরণ করছি আমরা। এ ক্ষেত্রে উচ্চতর শক্তি ও ডাকটাইলিটিকে রডের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য ধরা হয়। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডে সরকার অনুমোদিত ল্যাবে ব্যয়বহুল ফ্যাটিগ পরীক্ষায় বিএসআরএমের রড ৫০ লাখ সাইক্লিক লোডিংয়ে সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়। বর্তমানে আমরা নিয়মিত এই পরীক্ষা করিয়ে যাচ্ছি। আইএসও-বিডিএস ৬৯৩৫ অনুযায়ী বিএসআরএম এক্সট্রিম ৫০০ গ্রেড রডের সব নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যই অর্জন করেছে। এভাবে বিশ্বের ১০টিরও বেশি দেশের কনস্ট্রাকশন স্টিলের মান বিএসআরএম ইতিমধ্যেই অর্জন করেছে ।
তিন বছর ধরেই বিএসআরএম দেশের সেরা রড ব্র্যান্ডের সম্মাননা পেয়ে আসছে। এমন অনেক ‘সেরা’ আর ‘প্রথম’-এর স্বীকৃতি পাওয়া এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে যুগোপযোগী রেখেছে। যুগ যুগ ধরে দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যবহৃত হয়ে বিএসআরএমের পণ্য এখন ‘সময়-পরীক্ষিত’।
পণ্যের গুণমানের পাশাপাশি সততা ও প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিও লক্ষ রেখেছি আমরা। এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতিবিষয়ক কর্মকাণ্ড বা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণদের সৃজনশীল উদ্যোগে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে বিএসআরএম। ইস্পাত খাতে দেশের সর্বোচ্চ করদাতা প্রতিষ্ঠান যেমন বিএসআরএম, তেমনি ব্যক্তি হিসেবেও চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ করদাতা নির্বাচিত হয়েছি আমি।
আসলে এই অর্জনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মীর আন্তরিকতা ও অঙ্গীকারের কথাও উল্লেখ করতে হবে। আমি মনে করি, যদি কর্মীদের আমরা প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত না করি, তাঁরাও তাঁদের সেরাটা দেবেন। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছি। যেমন নতুন কোনো প্রকল্প হাতে নিলেই বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ও কর্মী নিয়ে আসি। তাঁরা আমাদের কর্মীদের হাতে-কলমে কাজ শেখান। পরে তাঁরা ফিরে গেলেও আমাদের কর্মীরাই কাজ চালাতে পারেন। এভাবে প্রশিক্ষিত কর্মীরা আজ শুধু আমাদের কারখানাতেই নয়, সারা দেশের বিভিন্ন ইস্পাত কারখানায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন।
আমাদের এখানে শ্রমিক ইউনিয়ন আছে। কিন্তু শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কারখানা বন্ধ থাকেনি কখনো। যেকোনো সমস্যা আমরা তাঁদের সঙ্গে বসে সুরাহা করি। আবার ইউনিয়নের সদস্য বলে কেউ বাড়তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন না, তাঁরাও কিন্তু অন্য কর্মীদের মতো নিজের কাজটা ঠিকই করে যান। এই সবকিছুই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিএসআরএমের কর্মকর্তা, শ্রমিক-কর্মচারী সবাই প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের বলে মনে করেন। প্রতিষ্ঠানের ভালো চান তাঁরা। প্রতিষ্ঠানের উন্নতি মানে নিজের উন্নতি—এই বিশ্বাস তাঁদের মধ্যে আছে। এই সবকিছুই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আমি নিজে খুব সাদামাটা জীবন যাপন করি। শুধু আমি কেন, আমার পুরো পরিবারে ছোট-বড় সবাই খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। নিত্যনতুন গাড়ির শখ, বিলাসদ্রব্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ বা চাহিদা আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এটা আমাদের পারিবারিক শিক্ষা ও ঐতিহ্যের কারণেই সম্ভব হয়েছে। আমার ধারণা, মাটিতে পা না থাকলে মানুষ বাস্তবকে চিনতে শেখে না, বাস্তবকে না চিনলে তার পক্ষে বড় স্বপ্ন দেখাও সম্ভব হয় না। স্বপ্ন ও বাস্তবের এই নিবিড় সম্পর্কের কারণেই আমরা তিন পুরুষ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে বলে আশা করি, সেভাবেই বেড়ে উঠছে তারা।
আমের আলীহুসাইন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএসআরএম গ্রুপ।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।