তালাক কি : তালাক শব্দটির উৎস আরবী ভাষা থেকে, যার অর্থ কোনো কিছু ভেঙ্গে ফেলা বা ছিন্ন করা। মুসলিম আইনের বিধান মতে তালাক স্বামী-স্ত্রীর একটি বৈধ ও স্বীকৃত অধিকার যখন স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, দুইজনের পক্ষে একত্রে বসবাস করা সম্ভব হয় না তখন যে কোন পক্ষ থেকে বা উভয়ে কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে তালাকের মাধ্যমে তাদের এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন।
মুসলিম আইন অনুযায়ী তালাক ও তালাকের পদ্ধতি:
আইনের বিধানমতে তালাক দেবার ক্ষমতা বা অধিকার স্বামী ও স্ত্রীর সমান নয়৷ স্বামীর এক্ষেত্রে প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতা রয়েছে। স্বামী বা স্ত্রী যে কোন এক জনের ইচ্ছেতে (কিছু আইনগত শর্ত পূরণের মাধ্যমে) তালাক হতে পারে৷ মুসলিম আইন অনুযায়ী নিম্নলিখিত ভাবে তালাক দেওয়া যায়:
স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক: আমাদের দেশে প্রচলিত মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পূর্ন বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিস্কের মুসলিম ব্যক্তি যে কোন সময় কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। আইনের কাছে তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয়না এবং স্ত্রী, তাকে কেন তালাক দেওয়া হল তা জানতে চাইতে পারেনা। তবে এক্ষেত্রে এখনও অনেকে মনে করেন “এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক” বা বায়েন তালাক উচ্চারণ করা মাত্র তালাক হয়ে যায়। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা৷ স্বামী যেকোন সময় তালাক দিতে পারলেও তাকে আইনগত ভাবে নিয়ম মেনেই তালাক দিতে হয়।
স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক: স্ত্রী তিন উপায়ে তালাক দিতে পারেন: (ক) আদালতের মাধ্যমে, (খ) তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে, (গ) খুলার মাধ্যমে। এছাড়া স্বামী-স্ত্রী দুই জনই নিজেদের ইচ্ছাতে নিজেদের সম্মতিক্রমে সমঝতার মাধ্যমে তালাকের ব্যবস্থা করতে পারেন। যদিও তালাক টি রেজিস্ট্রেষন করা এখন আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। তালাক প্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রী কি পুনরায় বিয়ে করতে পারবে: হাঁ পারে৷ সেক্ষেত্রে নতুন করে বিয়ে করতে হবে।
তালাকের পর সন্তান কার কাছে থাকবে: তালাকের পর সন্তান মায়ের কাছে থাকবে। এক্ষেত্রে ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বয়ঃসদ্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে৷ তবে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবা বহন করবে৷ যদি বাবা দায়িত্ব পালন না করে সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যান সালিসীর মাধ্যমে আলাপ আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা করতে পারেন। তালাক কখন প্রত্যাহার করা যায়: ৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগেই তালাক প্রত্যাহার করা যায়৷
তালাকের আইনগত পদ্ধতি:
১. কোন ব্যক্তি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথা শীঘ্রই সম্ভব স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌর/সিটি চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিসের নকল প্রদান করতে হবে। ২. নিম্নের (৫) উপ-ধারার ব্যবস্থাবলীর মাধ্যম ব্যতিত প্রকাশ্য অথবা অন্যভাবে প্রদত্ত কোন তালাক, পূর্বাহ্নে বাতিল না হলে চেয়ারম্যান নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ হবে না।
৩. নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিসী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিসী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার (পুনর্মিলনের) জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে। ৪. তালাক ঘোষণা কালে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে বা অন্তঃসত্ত্বা থাকলে তালাক বলবৎ হবে না। ৫. কার্যকরী তালাক দ্বারা যার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে, সে স্ত্রী এ জাতীয় তালাক তিন বার কার্যকরী না হলে অন্য কোন ব্যক্তিকে বিবাহ না করে পুনরায় একই স্বামীকে বিবাহ করতে পারবে। ৬. যে কোন ধরণের তালাক রেজিষ্টেশনের ক্ষেত্রে নিকাহ রেজিষ্ট্রার বা কাজী সাহেবকে ২০০ (দুই শত) টাকা ফি প্রদান করে তালাক রেজিস্ট্রী করতে হবে।
নোটিশ ছাড়া তালাক দিলে শাস্তি: ধারা – ৭(২) অনুযায়ী নোটিশ ছাড়া তালাক দিলে এক বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার শাস্তি হবে।
স্ত্রী তিন ভাবে স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চাইতে পারে। ১. তালাক-ই-তৌফিজ, ২. খুলা, ৩. আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ।
তালাক-ই-তৌফিজ: নিকাহনামার ১৮ নং ঘরে স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করে থাকে, সে ক্ষমতার বলে স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চায় তাহলে সে বিচ্ছেদকে তালাক-ই- তৌফিজ বলে। খুলা: স্বামী এবং স্ত্রীর আলোচনা সাপেক্ষে নিজেদের সমঝোতার মাধ্যমে যে বিচ্ছেদ হয় তাকে ‘খুলা’ বিচ্ছেদ বলে, তবে স্বামীকে ‘খুলা’ বিচ্ছেদে রাজী করানোর দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীর (প্রয়োজনে কোন কিছুর বিনিময়ে)। এ ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে ইদ্দত কালীন ও গর্ভস্থ সন্তানের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ: তালাক-ই-তৌফিজ ও খুলার মাধ্যমে স্ত্রী যদি বিচ্ছেদ না নিতে পারে এবং স্ত্রী যদি বিচ্ছেদ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন মনে করে তাহলে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কি কি কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে। কারন গুলো হলো: ১. চার বৎসর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে। ২. দুই বৎসর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হলে। ৩. স্বামীর সাত বৎসর কিংবা তার চেয়েও বেশী কারা দন্ড হলে। ৪. স্বামী কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত তিন বছর যাবৎ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
৫. বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে। ৬. স্বামী দুই বৎসর ধরে পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিতে বা মারাত্মক যৌন ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলে। ৭. বিবাহ অস্বীকার করলে। কোন মেয়ের বাবা বা অভিভাবক যদি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেন, তা হলে মেয়েটির ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে, তবে যদি মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক (সহবাস) স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনি কোন বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে। ৮. স্বামী ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে। ৯. স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে।
আদালত স্বীকৃত নিষ্ঠুর ব্যবহার সমূহ:
ক) অভ্যাসগত ভাবে স্ত্রীকে আঘাত করলে বা নিষ্ঠুর আচরণ করলে, উক্ত আচরণ দৈহিক পীড়নের পর্যায়ে না পড়লেও, তার জীবন শোচনীয় করে তুলেছে এমন হলে। খ) স্বামী খারাপ মেয়ের সাথে জীবন যাপন করলে। গ) স্ত্রীকে অনৈতিক জীবন যাপনে বাধ্য করলে। ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করলে। ঙ) স্ত্রীকে ধর্মপালনে বাধা দিলে। চ) একাধিক স্ত্রী থাকলে সকলের সাথে সমান ব্যবহার না করলে। ছ) এছাড়া অন্য যে কোন কারণে (যে সকল কারণে মুসলিম আইনে বিয়ের চুক্তি ভঙ্গ করা হয়)।
আদালতে উপরিউক্ত অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে স্ত্রী বিবাহ-বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারে, আদালত ডিক্রি দেবার পর সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবে। চেয়ারম্যান উক্ত নোটিসকে তালাক সংক্রান্ত নোটিস হিসেবে গণ্য করে আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নিবে এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবে সে দিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্ত ভাবে কার্যকর হবে।
হিন্দু আইনে যা বলা হয়েছে: সনাতন হিন্দু আইনে সরাসরি বিবাহ বিচ্ছেদের কোনো বিধান নেই। তবে ভারতে ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইনে কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্রে আনীত অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব হলেও বাংলাদেশে এ আইন প্রযোজ্য নয়। স্ত্রী যদি একান্তই মনে করেন যে, স্বামীর সঙ্গে বসবাস করা দুর্বিসহ, তা হলে তিনি পিত্রালয়ে বা অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে পৃথক থাকতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হন। ১৯৪৬ সালে বিবাহিত নারীর পৃথক বাসস্থান এবং ভরণপোষণ আইন পাস হওয়ার পর, এ আইন অনুযায়ী- এক স্ত্রীর বর্তমানে স্বামী অন্য স্ত্রী গ্রহণ করলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পৃথক থাকলেও স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকবেন।
খ্রিষ্টান ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদ: খ্রিষ্টানদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় আইন রয়েছে, তা ব্রিটিশ কর্তৃক প্রবর্তিত, যা ১৮৬৯ সালের ক্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্ট নামে পরিচিত। কিন্তু এ আইনের কোনো ক্যাথলিক খৃষ্টান বিবাহবিচ্ছেদ ঘটালে তা গ্রহণীয় নয়। প্রোটেষ্ট্যান্ট খ্রীষ্টান সম্প্রদায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বৈধ বিয়ের বিচ্ছেদ মেনে নেয়। তবে, বিশেষ বিবেচনায় অথবা চার্চের হস্তক্ষেপে কিছু ক্ষেত্রে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হতে দেখা যায়।
উল্লেখ্য, ১৮৬৯ সালের ক্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্টের বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে নারীকে অধিকার প্রদান করা হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর ক্ষমতা ও অধিকারকে স্বামীর পাশাপাশি সমুন্নত রাখা হয়েছে এবং স্ত্রীকেও স্বামীর পাশাপাশি সমতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
লেখক: সোয়েব রহমান, অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, কুমিল্লা।
তথ্যসূত্র: ফ্রিডম বিডি টুয়েন্টিফোর ডটকম।