জীবনের জন্য সফলতা নাকি সফলতার জন্য জীবন। আচ্ছা, পরীক্ষাই কি জীবনের সব? ‘আমি জিপিএ ৫ পাব না। আমাকে ক্ষমা করে দিও, বাবা। আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না’-কথাগুলো বলেই না ফেরার দেশে চলে গেছে এইচএসসিতে অংশ নেওয়া শেফা। একজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষার সময় মানসিকভাবে চাপে থাকে। তার একজন নিকটাত্মীয়ের সাথে কথা বলে বিষয়টি জানা যায়।
ওই আত্মীয় বলেন, ‘পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের অদ্ভুত কিছু আচরণ শেফার মানসিক চাপকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই সে তার পরীক্ষা ভালো করে দিতে পারেনি। অবশেষে সে নিজের মানসিকতা ঠিক রাখতে না পেরে আত্মহত্মার পথ বেছে নেয়। সে তার পরীক্ষার পর ভেবেছিল সে এ+ পাবে না। তাই সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এরপরও ফেসবুকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে সমাজের কতজন সুশীল ব্যক্তি অনেক কথা বলেছেন। কেউবা বাস্তবে কেঁদেছেন। আমি কখনোই তাদেরকে ভুল বলব না। কারণ তারা যে সমস্ত যুক্তি দিয়েছেন, তা যে একেবারে ভুল, তা-ও কিন্তু নয়। হায়রে মানুষ!! জিপিএ ৫-এর জন্য কি না নিজের জীবনটাই দিয়ে দিলো।
এটির পরে মনে পড়ে, এই তো কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া দিনাজপুরের ঘটনা। আমি যখন এই পোস্টটি লিখছি, তখন ছোট্ট বোন মল্লিকার নিথর শরীরটি দিনাজপুরের ফুলতলা মহাশ্মশান ঘাটে দাউদাউ করে জ্বলেপুড়ে ভস্ম হয়ে গিয়েছে।
মল্লিকা দিনাজপুর শহরের সুইহারী আশ্রমের বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মচারী সুরেশ বৈশ্যর কনিষ্ঠ কন্যা। দিনাজপুর সিটি কলেজে পড়াশুনা করা মল্লিকা এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলো। চলতি এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে সর্তকতামূলক লেখাটি (আমার পরীক্ষা, আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না) মল্লিকা নিজে তার স্টাডি রুমের দরজায় টাঙিয়ে দিয়েছিল।
আমি যতটুকু শুনেছি, ও অত্যন্ত মেধাবী ছিল। হায়রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, গেল এসএসসি পরীক্ষায় সব প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার চক্করে এবার চলতি এইচএসসি পরীক্ষা এতটাই কঠোর করে প্রশ্নপত্র তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এতটাই ভয়াবহ নিয়মাবলীর মধ্য দিয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যার ভার বইতে না পেরে মেধাবী ছোট্টবোন মল্লিকাকে আজ সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হলো।
মল্লিকার সুইসাইডাল নোটে এমনটাই দাবি করে সে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলে আজ নিজে অন্তরালে চলে গেল সারা জীবনের জন্য। এখানেও প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা। আচ্ছা, পরীক্ষাই কি জীবনের সব? দেশের শিক্ষাবব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য কঠিন প্রশ্নের জন্য কি জীবন দিয়ে দিতে হবে? ভালো পরীক্ষার কি অপর নাম জীবন নাকি একটু খারাপ পরীক্ষাই জীবনের সব শেষ? একটু পরেই আসছি এসবের উত্তরে।
কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম, একটি মাস্টার্স পাস করা মেয়েকে তার পরিবার থেকে প্রতিদিন ফোন করে বলা হতো, ‘কিরে তোর চাকরি হলো?’ বারবার এই কথা শোনার পর, মেয়েটি অনেকবার চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে হাপিয়ে যায়। কিন্তু কোনো চাকরির কূল-কিনারা পায় না। পরবর্তী সময়ে সে ভাবে, তার বুঝি সব শেষ। তাই সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তখনো দেশের কিছুসংখ্যক মানুষ দেশের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেক যুক্তির মাধ্যমে বারবার সাবলীলভাবে অপরাধী বানিয়ে শুদ্ধ ভাষায় গালি দিয়েছেন। আমি কখনোই বলব না, যারা যুক্তি দিয়েছেন, তারা তাদের দিক থেকে ভুল। সৃষ্টিকর্তার কী লীলা! সেই মেয়েটি মারা যাওয়ার কিছুদিন পরই বাংলাদেশ ব্যাংকে তার চাকরির লেটার আসে। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটি চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমি নিজেও যুক্ত। তাই কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন গ্রুপের বিভিন্ন পোস্টে দেখছি, ‘পরীক্ষা খারাপ হয়েছে’ নামে একটি যুক্তি সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কেউ বা প্রশ্ন পদ্ধতিতে দোষ দিচ্ছে, কেউ বা পরীক্ষার হলের ব্যবস্থাকে দোষ দিচ্ছে, কেউ আবার শিক্ষাব্যবস্থাকে দোষ দিচ্ছে। কেউ আবার একজন বিশেষ ব্যক্তিকে দোষারোপ করছে। তবে এই যুক্তির পক্ষে ও বিপক্ষেও অবস্থান দেখা যাচ্ছে। কেউ বা পোস্ট করছে জীবন বুঝি শেষ হয়ে গেল, জীবনে মনে হয় আমার অমুক জিনিসটা আমি আর পেলাম না, জীবনে বুঝি আমি অমুক জিনিসটা হারিয়ে ফেললাম। এগুলো ছাড়াও জীবনে হতাশা ভরা আরও অনেক পোস্ট বা কমেন্ট আমার চোখে বারবার পড়ছে।
সেদিন একজন সমাজপতি ব্যক্তির কাছ থেকে একটি কথা শুনলাম। তিনি বললেন, ‘টাইটানিক ধ্বংসের কারণ আইসবার্গ আর পড়ালেখা ধ্বংসের কারণ জুকারবার্গ।’ তিনি অবশ্য এর পক্ষে বিশেষ কিছু যুক্তি উপস্থাপনের সাথে তার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের আইডিতে পোস্ট করেছেন। কমেন্ট বক্সে এই পোস্টেও পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানের দেখা মিলল।
তবে সব বিষয়ের মূল আলোচ্য বিষয় হলো, ‘পরীক্ষা খারাপ হয়েছে’ নামক বিষয়। এই একটা বিষয়ের জন্যই অনেক ব্যক্তি আজ হতাশ। কেউ বা হতাশা নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। কেউ বা হতাশাকে আপন করতে না পেরে পরপারেই চলে যাচ্ছেন।
হতাশা জীবনে আসবে। আমাদের জীবনে হতাশা ভাগিদার হিসেবে সবসময় পিছু লেগে থাকবে। তাই বলে কি আমরা হতাশার কাছে কাপুরুষের মতন হার মেনে নেব, নাকি হতাশাকে পেছনে ফেলে জীবনের সামনের ধাপে এগিয়ে যাওয়াই প্রত্যেকের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
সময় সবার ভালো যায় না। এটা আপনি আমি সকলে জানি। কিন্তু তাই বলে কি সব জেনেশুনে আমরা তবুও না জানার মতন করে থাকব?সেদিন যদি ওই মাস্টার্স পাস করা আপু সৃষ্টিকর্তার ওপর একটু বিশ্বাস স্থাপন করে কষ্ট করে কিছু সময় বেঁচে থাকতেন, তবে হয়তো বা তিনি আজ বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতেন।
জীবনে কি জিপিএ ৫ সব? জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর জন্যই তো জিপিএ ৫। আর যদি জীবনটাই না থাকে, তবে কী লাভ? পরীক্ষা খারাপ হয়েছে বলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গালিগালাজ করে নিজের জীবন আত্মাহুতি দিয়ে কি লাভ হলো? তুমি যদি বেঁচে থেকে সবাইকে একতাবদ্ধ করে সমাজকে পরিবর্তন করতে কাজ করো, তবেই তো তোমার সফলতা আসবে।
বিল গেটসকে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কোথায়, তিনি তো সেদিন ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গালিগালাজ করে আত্মাহুতি করেননি, বরং তিনি তার জীবনকে নতুন জায়গা থেকে শুরু করে সফল হয়ে একদিন সেই প্রতিষ্ঠানেই গিয়েছিলেন একজন বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় গায়ে নিয়ে। আইনস্টাইন কীভাবে জীবনে সফলতা পেয়েছেন, যা আপনারা সবাই কম-বেশি জানেন।
বিশ্বের নামকরা ফুটবল খেলোয়ার ব্রাজিলিয়ান তারকা রোনালদোর কথা কম-বেশি সকলে জানেন। তার বাবা তাকে খেলার জন্য ফুটবল কিনে দিতে পারেননি। কাপড় আর কাগজ দিয়ে বল বানিয়ে দিয়েছিলেন। রোনালদোর গ্রামের এক মেলায় রোনালদো তার বাবার কাছে বায়না ধরেছিল একটি ফুটবল কিনে দিতে। কিন্তু তার বাবার সেদিন কোনো সামর্থ্য ছিল না একটি ফুটবল কিনে দেওয়ার। তাই রোনালদোর বাবা সেদিন রোনালদোকে ফুটবল কিনে দিতে পারেননি। কোথায় রোনালদো তো সেদিন পরিবারের দারিদ্র্যকে গালি দিয়ে আত্মাহুতির পথ বেছে নেননি, বরং তিনি তার না পাওয়ার অবস্থান থেকেই শুরু করে হয়ে গেছেন একজন ফুটবল লিজেন্ড।
ওজিল নামের ফুটবলের মহাতারকাকে সেদিন মাঠের মধ্যে রুটি ছুড়ে মেরেছিলেন এক দর্শক। তিনি সেদিন সেই রুটি কুড়িয়ে নিয়ে তাতে চুমু খেয়েছিলেন। পরে জানান, সৃষ্টিকর্তার নিয়ামত এই খাবার, যা মাটিতে পড়ে ছিল। তাই সৃষ্টিকর্তাকে সম্মান দেখাতেই তিনি রুটিতে চুমু খেয়েছেন, যার বদৌলতে তিনি পেয়েছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের সম্মান। তিনি যদি তা না করে উল্টো সেই রুটিকেই দর্শকের দিকে ছুড়ে মারতেন, তবে তিনি আজ কিছুসংখ্যক ব্যক্তির কাছে ঘৃণার পাত্র বলে গণ্য হতেন। কিন্তু তা না হয়ে ওজিল পেয়েছেন সম্মান, যা তাকে তার সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর সিড়ি হয়েছে।
তুমি বাকস্বাধীনতার কথা বলে দেশের সমাজকে গালি দিতে পারো, সমাজকে পরিবর্তনের সুর গাইতে পারো যদি তুমি বেঁচে থাক। কিন্তু তুমি যদি বেঁচেই না থাকো, তাহলে এত পরিবর্তন করার দায় তো তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ।সফলতা তোমার আর পাওয়া হবে না। তোমার হতাশাগ্রস্থ অবস্থান থেকে তোমাকে উঠে আসতে হবে। সফলতার দ্বারপ্রান্তে তোমার নিজেকেই পৌঁছাতে হবে। তুমি সফল হতে পারবে না বলে সমাজের দায় অবহেলা করে চলে যাবে, তা হবে না।মনে রাখতে হবে যারা এখন সফল হয় না, পরে কিন্তু সফল হতেও পারে। কারণ জীবনের জন্যই সফলতা, সফলতার জন্য জীবন নয়।
জীবন থেকে রেজাল্ট বড় না। তোমার জীবনের দাম মা-বাবার কাছে রেজাল্টের চেয়েও লাখ গুণ বেশি। তাই রেজাল্টের সাথে কেউ জীবনকে তুলনা করবা না। জীবনটা এত ছোট নয়, অনেক কিছুই করার আছে জীবনে।
প্রতিবারই পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক আত্মহত্যা হয়। এ ধরনের আত্মহনন থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে হবে।
লেখক: এ.এস.এম মাহমুদুল হাসান অনিক
তথ্যসূত্র: প্রিয় ডটকম।