স্যামসন চৌধুরী ১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার আরুয়াকান্দিতে জন্ম নেন। বাবা ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী ছিলেন ডাক্তার। মায়ের নাম লতিকা চৌধুরী। বাবার পোস্টিং চাঁদপুর মিশন হাসপাতালে হওয়ায় শিশু স্যামসনের স্কুল জীবন শুরু হয়েছিল চাঁদপুর মিশন স্কুলে। ১৯৩৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায় তার পরিবার। কলকাতা থেকে প্রায় ১৫ মাইল দূরত্বে বিষ্ণুপুরে শিক্ষাসংঘ হাইস্কুলে ভর্তি হন স্যামসন। ১৯৪২ সালে নিজ গ্রামে ফিরে এলো স্যামসনের পরিবার। আতাইকুলা হাইস্কুলে নতুন করে পড়ালেখা শুরু করলেন স্যামসন। এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।
মাত্র ১৭ বছর বয়সেই কাউকে কিছু না বলে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ছাড়েন স্যামসন। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় নৌবাহিনীতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান। নেভিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাকে সিগন্যাল বিভাগে দায়িত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু তিনি ‘রাডার অপারেটর’ হওয়ার জন্য আবেদন করলেন। রাডার বিভাগে নিয়োগ দিলে স্যামসন চৌধুরী সব মিলিয়ে তিন বছর রয়েল ইন্ডিয়ান নেভিতে চাকরি করেছেন।
১৯৪৭-এ পাবনায় ফিরে স্যামসন চৌধুরী সরকারের ডাক বিভাগে যোগদান করলেন । ওই বছর ৬ আগস্ট ১৫ বছরের কিশোরী অনীতা চৌধুরীকে বিয়ে করেন স্যামসন। স্যামসন এইচ চৌধুরীর তিন ছেলে— অঞ্জন চৌধুরী, তপন চৌধুরী ও স্যামুয়েল চৌধুরী। একমাত্র মেয়ের নাম রত্না পাত্র। ১৯৫২ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। চাকরি ছাড়ার পর বাবার ইচ্ছায় তার ডিসপেনসারিতেই বসতে শুরু করলেন স্যামসন চৌধুরী।
১৯৫৬ সালে স্যামসন তার বাবার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ওষুধ কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। কোম্পানির নাম রাখলেন ই-সনস (ইয়াকুব হোসেন অ্যান্ড সনস্)। বাবার ওষুধের দোকানেই স্যামসন চৌধুরীর ব্যবসার হাতেখড়ি। ওই সময় ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী ওই অঞ্চলের একজন খ্যাতনামা ডাক্তার ছিলেন।সিরাপ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে তিনি কোম্পানির যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে এই কোম্পানির মালিক, শ্রমিক, পরিবেশক এবং বাজারজাতকারক ছিলেন তিনি একাই। আর তার এই ফ্যাক্টরির একমাত্র সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী অনীতা।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি, মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্টেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস’র (এমআইডিএএস) চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন তিনি। তিনি ঢাকা ক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান ছিলেন ২০০৪-২০০৭ সাল পর্যন্ত। শাহবাজপুর টি এস্টেট ও মিউচুয়াল স্ট্রাস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যানও ছিলেন স্যামসন চৌধুরী। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি ৮৬ বছর বয়সে তিনি সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্যামসান এইচ চৌধুরীর নেতৃত্বে চার বন্ধু ডা. কাজী হারুনার রশিদ,ডা. পিকে সাহা এবং রাধা বিনোদ রায় মিলে পাবনা শহরে শালগাড়িয়া এলাকায় ১৯৫৮ সালে যে প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্কয়ারের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার নাম ছিল স্কয়ার ফার্মা। পুঁজির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার টাকা। একটি বসত বাড়ীতে স্থাপন করা সেই কারখানায় শ্রমিক ছিল মাত্র ১২ জন। ১৯৬৪ সালে স্কয়ার ফার্মা নাম পরিবর্তন করে করা হয় স্কয়ার ফর্মাসিউটিক্যাল লিঃ। ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ছিমছাম ছিল কারখানাটি।
১৯৬৪ সালে স্কয়ার পাবলিক লিঃ কোম্পানীতে পরিণত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সাল ছিল স্কয়ারের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। ওই বছর কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে স্কয়ারের চুক্তি হয়। স্কয়ারকে সম্পূর্ণ আধুনিক রূপ দিলেন স্যামসন চৌধুরী। আশির দশকে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থান দখল করে নেয় স্কয়ার। ১৯৮৭ সালে স্কয়ার প্রথম তাদের তৈরি ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করে।নব্বই দশকের শুরুতে কোম্পানিটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে বাজারে শেয়ার ছাড়ে। কয়েক বছর পরেই স্কয়ার ন্যাশনাল এক্সপোর্ট ট্রফি অর্জন করে ও ১৯৯৮ সালে আইএসও-৯০০১ সনদ লাভ করে।
স্যামসন চৌধুরী নামের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আমরা চার বন্ধু মিলে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করায় এর নাম দিই স্কয়ার। চতুর্দিকে সমান হলেই কেবল তা বর্গক্ষেত্র বা স্কয়ার হতে পারে, যেটির অন্তরালে ‘সঠিকতা’ ও ‘পরিপূর্ণতা’ নিহিত। আর এ কারণেই এ কোম্পানির নাম স্কয়ার।১৯৫৮ সালের সেই ছোট উদ্যোগ বর্তমানে বিশাল গ্রুপে পরিণত। ২৭ হাজার কর্মীর এই বিশাল পরিবারের বার্ষিক আয় ৩০ কোটি ডলার।
১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে ‘স্কয়ার টয়লেট্রিস’। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্কয়ার টেক্সটাইল লিমিটেড।কয়েক বছর পর স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ‘এগ্রো কেমিক্যালস ভ্যাটেরিনারি’ ইউনিট খোলা হয়। স্যামসন চৌধুরীর ব্যবসায়িক দক্ষতায় কয়েক বছরের মধ্যেই একে একে যাত্রা শুরু করে স্কয়ার স্পিনিং লিমিটেড, স্কয়ার নিট ফেব্রিকস্্ লিমিটেড, স্কয়ার ফ্যাশন লিমিটেড, স্কয়ার কনজিউমার প্রডাক্ট লিমিটেড, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, স্কয়ার ইনফরমেটিক্স এবং স্কয়ার হসপিটাল ।প্রতিষ্ঠিত হয় সান কমিউনিকেশন লিমিটেড, মিডিয়া কম লিমিটেড, রেডিও দিন রাত, ওরাকল ট্রাভেলস লিমিটেড, মাছরাঙা কমিউনিকেশনস লিমিটেড, স্কয়ার সিকিউরিটিস ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
তথ্যসূত্র: দি প্রোফাইলস ডট ইনফো স্যামসাং এইচ চৌধুরী।