1. editor@islaminews.com : editorpost :
  2. jashimsarkar@gmail.com : jassemadmin :

‘অথৈ জলে’ পড়ে আছে মূল্যবান সাগরের গ্যাস!

দেশে গ্যাসের ঘাটতি নতুন কোনো বিষয় নয়। শিল্প, বাণিজ্য, আবাসিকসহ সব খাতেই এই জ্বালানির জন্য হাহাকার চলছে বছরের পর বছর। অবশেষে এই ঘাটতি মেটাতে চার গুণ বেশি দামে গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম নেই। স্থলভাগেও অনুসন্ধান কাজ চলছে কচ্ছপগতিতে।

বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মিয়ানমার তাদের অংশে ব্যাপক পরিমাণ গ্যাসের সন্ধান পেয়ে তা তোলা শুরু করেছে। বাংলাদেশ সাগরে এখনও জরিপকাজই করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অংশেও বিপুল পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কার্যকর উদ্যোগের অভাবে গভীর সাগরের গ্যাস এখনও ‘অথৈ জলেই’ থেকে যাচ্ছে।

জানা যায়, সাগরের তলদেশে মাটির নিচে কোথায় তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তা জানার জন্য এক ধরনের জরিপকাজ করতে হয়। এ জরিপ-তথ্যের ওপর নির্ভর করে তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। গত চার বছরে এই জরিপকাজ শুরুই করতে পারেনি বাংলাদেশ। দুবার দরপত্র ডেকেও নির্বাচিত কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রভাবশালী একটি মহলের পছন্দের কোম্পানি কাজ না পাওয়ায় দরপত্র কার্যক্রম আটকে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ওই জরিপের তথ্য ছাড়া সমুদ্রের ব্লকগুলোতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে চাইছে না সরকার। কারণ, এর আগে কয়েক দফা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেও ভালো কোম্পানির কাছ থেকে সাড়া মেলেনি। ওই জরিপের জন্য জাহাজ কেনা বা ভাড়া নেওয়ার বিষয়টিও দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে বলে জানা গেছে।

আন্তর্জাতিক আদালতে ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সর্বমোট এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের মালিক হয় বাংলাদেশ। এর পর কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বিশাল এই সমুদ্র এলাকার সম্পদ আহরণে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম তার এক প্রবন্ধে বলেছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কারণে বাংলাদেশ সাগরে এখনও জরিপই শুরু করতে পারেনি। বদরুল ইমাম এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, একটি কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। আর এখন সেই সংকটের মাশুল দিতে হচ্ছে। গত ১৫ বছরে প্রতিবছর গড়ে একটি গ্যাসকূপও খনন করা হয়নি। নতুন গ্যাসের সন্ধান না পাওয়ায় এখন এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে, যা দেশের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার আমদানির পাশাপাশি দেশের ভেতরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দিয়েছে। স্থলভাগে শতাধিক কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সমুদ্রে অনুসন্ধান কার্যক্রমে অনেকটাই পিছিয়ে থাকার কথা স্বীকার করে প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘জ্বালানি বিভাগ সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে এগোতে পারছে না।

সাগরে জরিপকাজটি জ্বালানি বিভাগের কারণেই ঝুলে আছে।’ এ অভিযোগের বিষয়ে সদ্য বিদায়ী জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রতিটি প্রকল্প সরকারের বিধিবিধান মেনে বাস্তবায়ন করা হয়। সাগরের জরিপকাজটির (মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে) বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনার বাইরে তিনি বা তার বিভাগ কোনো কাজ করেনি।

সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান : বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে অগভীর অংশে ব্লক ১১টি। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক ১৫টি। অগভীর সমুদ্রের ৯ নম্বর ব্লকে ১৯৯৬ সালে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার করে কেয়ার্নস এনার্জি, যা দেশের একমাত্র সামুদ্রিক গ্যাসক্ষেত্র। ১৯৯৮ সালে সেখান থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়। মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে গ্যাসক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত হয়। এ ছাড়া কুতুবদিয়ার সাগরবক্ষে গ্যাসের সন্ধান মিললেও তা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য বিবেচিত হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র্রভিত্তিক তেল-গ্যাস কোম্পানি কনোকোফিলিপস ২০০৮ সালের দরপত্র প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ নম্বর ব্লক ইজারা নিয়েছিল। দুই বছর অনুসন্ধান কাজ করার পর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মতভেদের কারণে ২০১৪ সালে ব্লক দুটি ছেড়ে দেয় কনোকো। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ডাকা অন্য আরেক আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১ এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ও স্টেট অয়েল।

পরবর্তী সময়ে কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় ব্লকগুলো ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। একই সময়ে অগভীর সমুদ্র্রের ব্লকগুলোর জন্য ভিন্ন একটি দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এই দরপ্রক্রিয়া একমাত্র প্রস্তাবদাতা হিসেবে এসএস ১১ নম্বর ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং এসএস ৪ ও এসএস ৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুটি কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া (ওআইএল) ইজারা নিয়েছে।

এরপর জ্বালানি বিভাগ বিশেষ আইনে দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই বাকি ব্লকগুলো ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এ জন্য ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আগ্রহপত্র চায় পেট্রোবাংলা। সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি, দক্ষিণ কোরিয়ার পোসকো দাইয়ু ও নরওয়ের স্টেট অয়েল আগ্রহ প্রকাশ করে। পরে প্রস্তাব চাওয়া হলে ১২ নম্বর ব্লকের জন্য শুধু দাউয়ু প্রস্তাব দাখিল করে। দীর্ঘ আলোচনার পর গত ডিসেম্বরে ডিএস ১২ নম্বর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে উৎপাদন-অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) সই করে পেট্রোবাংলা। দাইয়ু এই ব্লকের পাশেই মিয়ানমারের একটি সমুদ্র ব্লকে গ্যাস তুলছে।

মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে : বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্রে ভালো সাড়া না মেলায় সরকার পুরো সমুদ্রসীমায় একটি পূর্ণাঙ্গ বহুমাত্রিক জরিপ বা মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সার্ভের কাজ করার জন্য ২০১৫ মালে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। দরপত্র জমা পড়ে পাঁচটি। দরপত্র মূল্যায়নে নরওয়ের কোম্পানি টিজিএস এবং ফ্রান্সের স্কামবার্জার কনসোর্টিয়াম যোগ্য বলে নির্বাচিত হয়।

এরপর পেট্রোবাংলা প্রস্তাব চূড়ান্ত করে চুক্তিপত্র অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নিতে জ্বালানি বিভাগে ফাইল পাঠায়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া হঠাৎ বাতিল করে আবার দরপত্র আহ্বানের জন্য পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দেওয়া হয় জ্বালানি বিভাগ থেকে। অভিযোগ রয়েছে, পছন্দের কোম্পানি কাজ না পাওয়ায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। পরে আবারও পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হলে এবারও পাঁচটি প্রস্তাব জমা পড়ে। এবারও দরপ্রক্রিয়ায় টিজিএস-স্কামবার্জার কনসোর্টিয়াম প্রথম হয়।

এরপর চুক্তির প্রস্তাবনা জ্বালানি বিভাগের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উত্থাপন করা হয়। সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, সেখানেও দরপত্র প্রক্রিয়া সঠিক হয়নি বলে আপত্তি জানানো হয়। পরে দরপত্র মূল্যায়নের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, নয় মাস আগেই এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।

জরিপ জাহাজ (সার্ভে ভেসেল) ক্রয় : মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে প্রকল্প নিয়ে এ জটিলতার কারণে নিজেরাই জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনা করে জ্বালানি বিভাগ। এ জন্য এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর আওতায় ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু প্রায় দুই বছরেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ বলেন, সার্ভে জাহাজ ভাড়ার চেষ্টা চলছে। জ্বালানি বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলেই কার্যক্রম শুরু করা হবে।

ব্লু ইকোনমি সেল : সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির পর বিশাল সমুদ্রসম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান, গবেষণা ও উত্তোলনে তদারকির জন্য গত বছরের ৫ জানুয়ারি ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করা হয়। এ সেলের জনবল নিয়োগ এখনও পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ছয় কর্মকর্তাসহ বর্তমানে মোট জনবল ১০ জন। কয়েকটি বৈঠক ছাড়া এ শাখার তেমন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার কার্যালয় পেট্রোসেন্টারের নবম তলায় অবস্থিত সেলটির অফিসে সম্প্রতি ঘুরে দেখা যায়, এখনও পুরোপুরি গোছানো হয়নি। কয়েকটি কক্ষে বিভিন্ন কর্মকর্তা নামফলকযুক্ত হলেও দু-একজন ছাড়া কারও দেখা মেলেনি।

মিয়ানমার গ্যাস তুলছে : ২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার দ্রুত গ্যাস ব্লকগুলোতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। ২০১৬ সালে থালিন-১ নামক ব্লকে এ গ্যাসপ্রাপ্তির ঘোষণা দেয় মিয়ানমার। থালিন-১-এ সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আছে। এখান থেকে গ্যাস তোলা শুরু হয়েছে।

পিছিয়ে নেই ভারতও : বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশের কৃষ্ণা-গোদাভারী বেসিন এলাকায় প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে বলে আশা করছে ভারত। ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি, গুজরাট এস্টেট পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বেসরকারি গ্রুপ রিলায়েন্স এই এলাকায় জোরালো অনুসন্ধান কাজ করেছে।

তথ্যসূত্র: সমকাল ডটকম।

More News Of This Category