1. editor@islaminews.com : editorpost :
  2. jashimsarkar@gmail.com : jassemadmin :

মাস্টার্স তো শেষ, চাকরি-বাকরির কী খবর?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েরা ভর্তি হয় কেন? আমি তো তাও সরল প্রশ্ন করলাম। কয়েকদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে একটা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে এসেছিলেন সাংবাদিক মাহফুজ আনাম। জানতে পেরে আমি বাংলা বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকদের সাথে মিশে গিয়েছিলাম। সভাপতির কক্ষে বসে, মাহফুজ আনাম অনানুষ্ঠানিক কথা বলছিলেন। আমরা শুনছিলাম। তিনি কথা বলতে বলতে মন্তব্য করলেন-‘বিশ্ববিদ্যালয় জিনিস টা কী? এটা কি স্কুল না কলেজ? না কি আরও বড় কিছু?

বিশ্ববিদ্যালয় তো গবেষণা করবে, জাতিকে, রাষ্ট্রকে পথ দেখাবে। তাইনা? মাহফুজ আনামের প্রশ্নের তাৎপর্য খানিকটা বোধহয় টের পেয়েছিলাম, তাই চুপচাপ ছিলাম, আলোচনায় অংশ নিইনি। আমরা বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘স্যার, গবেষণা হয় ঠিকই, কিন্তু কে কার খবর রাখে? কিন্তু গবেষণায় আমার অবদান এতই নগণ্য যে, বহু কষ্টে নিজের মুখ বন্ধ রাখলাম। না হলে, কথা বলা যে আমার একটা প্রিয় বিষয় সেটা পরিচিতরা কে না জানে!

তবে আজকের এই নন-একাডেমিক লেখার মূল উদ্দেশ্য গবেষণা নয়, ছাত্র-ছাত্রীদের রুটি-রুজির চিন্তা এবং প্রয়াস নিয়ে কিছু বাতচিত করতে চাই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধুমাত্র গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকলে চলে না। নতুন বিভাগ হলে তো যাচ্ছে-তাই অবস্থা। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শিক্ষকদের বসার জায়গা ছিল না বহুদিন, নিজেদের কোনো ক্লাসরুম ছিল না, ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস করত দুপুরের পর। এই এক/দেড় বছর আগেও আমি বিভিন্ন ইয়ারের ৬টি পূর্ণ কোর্স পড়িয়েছি। একজন সহকারী অধ্যাপক হয়ে আমি বা আমার সহকর্মীরা কী এমন কাবিল হয়ে গেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিদ্যাপীঠে সব পরিণত বয়সের ছেলে-মেয়েকে একেকজন ৫/৬ টা করে কোর্স পড়াব? কিন্তু আমরা প্রত্যেকে পড়িয়েছি। একটা সময় ছিল, বিভাগে ব্যাচ ৫ টা, টিচার ৪ জন!

বর্তমান উপাচার্য আমাদের বিভাগকে আলাদা জায়গা দেয়ায় অবকাঠামো এখন মাশাল্লাহ বেশ ভালো। ৪ টা ক্লাসরুম, সেমিনার রুম, নির্মাণাধীন ল্যাব, শিক্ষকদের বসায় জায়গা সব আছে এখন। শিক্ষকের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ এ। মাঝে মাঝে মনে হয়, বিভাগ যে আমরা চালু রাখতে পেরেছি, তাতেই আল্লাহর কাছে হাজার শোকর।

ক্লাসরুমে, পরীক্ষার হলে এবং খাতায় যে সময় আমরা দিয়েছি, তার মূল্যায়ন কেউ করতে পারবে না। মূল্যায়ন করার কোনো মানদণ্ড নেই। কারণ এটি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ক্লাসরুম, পরীক্ষার হল, খাতার মূল্যায়নের বিনিময়ে বেতন এবং কিছু অর্থ পুরস্কার পাওয়া গেলেও গবেষণা এবং প্রফেশনাল ডিগ্রিই মুখ্য বিষয়। এমনকি ডিগ্রি কি দেশি না বিদেশী, নর্থ আমেরিকান না ইউরোপের, ইত্যাদি বিষয়ও মুখ্য হয়ে উঠে কখনো কখনো। আর দেশের কোনো জিনিসেই তো আমাদের ভরসা নাই।

তার উপর কোন কোন শিক্ষকের গবেষণা নিবন্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ নিয়ে ফেসবুক এবং মূলধারার এতটাই গরম হয়ে উঠেছে, তার আঁচ থেকে গা বাঁচিয়ে চলাফেরা সম্ভব হয়ে উঠছে না। হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পাওয়া এক ছোটভাই সেদিন বলল, ভাগ্যিস সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয় নাই, তাহলে সবাই তাঁকে চোর বলত। আমি বললাম, ভেরি গুড, সবাইকে নিজের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। সন্তুষ্ট থাকতে হলে, কারণ খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কারও চৌর্যবৃত্তি যদি দেশের কোনো নবীন হাইস্কুল শিক্ষকের মনোতুষ্টির কারণ হয় তাতে মন্দ কী?

যাইহোক, ছাত্র-ছাত্রীদের কথায় আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সবচেয়ে বড় দিক হল , এরা কিন্তু স্যার/ম্যাডামদের আশায় বসে থাকে না। নিজেরাই নানাবিধ সমাজ কল্যাণমূলক কাজের পাশাপাশি রুটি-রুজির তালাশ জারী রাখে। যদিও ক্লাসে রুটি-রুজি নিয়ে লেকচার মারতে গিয়ে কোনো কোনো ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের কারও কারও কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। আমাকে খুব পছন্দ করে এমন একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে’-‘স্যার বিশ্ববিদ্যালয় কি শুধু চাকরি-বাকরির যোগ্যতা অর্জনের জায়গা?’ প্রশ্ন যেমন কঠিন, উত্তর আরও কঠিন। আমি তখন তাঁকে বুঝিয়ে বলেছি, বাংলাদেশে গবেষণা-ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বীকৃতি দেয়া যায়। কারণ এদেশে কৃষি বিজ্ঞানীরাই শুধু নিজেদের গবেষণা দিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রকে সম্মানের সাথে টিকে থাকতে সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণা হয়, তবে এগুলো রুটিন ওয়ার্ক।

আমাদের প্রমোশনের জন্য কিছু গবেষণা, কিছু ডিগ্রি নিতে হয়। বড় বড় স্যারদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি এবং এখন নিজেরা বুঝি, পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম এমন গবেষণা করতে হলে প্রচুর টাকা দরকার, যা রাষ্ট্র থেকে আসে না। তাছাড়া তোমাদের মত ছেলে-মেয়েরা একসময় ভাষা আন্দোলন করেছে, ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে, সামরিক শাসক এরশাদের পতনও ঘটিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরাই। মুক্তিযোদ্ধা রুমি উচ্চ শিক্ষা এবং নিশ্চিত ক্যারিয়ার ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। তোমাদের বা আমাদের কয়জন এমন মহান হতে পারব বা পারছি? দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য রুমির মত বীরযোদ্ধা চরম অনিশ্চয়তাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন।

আর আমরা, তোমরা, স্বাধীন দেশে ক্যারিয়ারে নিশ্চিত নিশ্চয়তা চাই। সবার শুধু সরকারি চাকরি চাই, বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেয়া ছেলে-মেয়েদের সবাই না হলেও অধিকাংশই বিসিএস ক্যাডার হতে চায়। যে ক্যাডার হতে পারছে, সে সমাজে বিশেষ সম্মান পাচ্ছে। আর যে পারছে না, সে অন্য চাকরি বা কাজ করলেও একধরনের অসন্তুষ্টি নিয়ে দিন পার করছে। রাষ্ট্রও কিছু ক্যাডার সার্ভিস বা বাহিনীর চাকরিতে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে রেখেছে যাতে সবাই সারাজীবন বিদ্যমান সিস্টেমকেই টিকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করে।

বদন কিতাবে জনপ্রিয় তরুণ কথা-সাহিত্যিক আব্দুল্লাহ আল ইমরানের পোস্ট দেখে চোখ আটকে গেল। সবাই যেভাবে শুধু বিসিএস ক্যাডার হতে চাচ্ছে, তাতে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিসিএস দিতে, বিসিএস অফিসার হতে কোনো দোষ বা বাধা নেই। অত্যন্ত পরিশ্রমী আর মেধাবীরাই কেবল বিসিএস অফিসার হতে পারে। তার মানে তো এই না যে, অন্য প্রফেশনের লোকজন কম পরিশ্রমী আর কম মেধাবী। এমনও অনেক আছেন যারা ম্যাজিস্ট্রেট এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় চলে এসেছেন এবং খুব ভালো করছেন।

অভিনেতা হাসান মাসুদ এর কথা বলা যায়। আর্মির অফিসার এর চাকরি ছেড়ে তিনি সাংবাদিকতা এবং অভিনয়কে বেছে নিয়েছেন। এমন নজির ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে বিলীন হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়। সৃজনশীল, চ্যালেঞ্জিং কাজে নিয়োজিত হতে ইচ্ছুক ছেলে-মেয়ের সংখ্যা মনে হয় কমে যাচ্ছে। পাবলিক লাইব্রেরিতে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে গেলে বোঝা যায়, বিসিএস জব এখনকার দিনে কত জনপ্রিয়। সরকারি চাকরিতে বেতন বেড়ে যাওয়ায় এবং প্রাইভেট চাকরিতে অনিশ্চয়তার ফলে বোধহয় এই অবস্থা।

সরকারি বা বিসিএস জব নিয়ে ছেলে-মেয়েদের আকাঙ্ক্ষা কোন পর্যায়ে গেছে সেটি আমরা ইমরানের বদনকিতাব-পোস্ট দেখে অনুধাবন করতে পারি। ইমরান লিখেছেন, ‘প্রথম ঘটনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের। ভালো প্রস্তুতির পরও ৩৬তম বিসিএসের রিটেন পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। অনুত্তীর্ণ হবার সম্ভানাই বেশি। সেই শোক না কাটতেই ৩৭তম প্রিলি হাজির। নানা দুশ্চিন্তায় পরীক্ষার আগের রাতে অসুস্থ্য হয়ে পড়লো ছেলেটি। হঠাৎ উদ্ভট আচরণ শুরু করায় বন্ধুরা তাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছে। যার জন্য গত আড়াই-তিন বছর কঠোর পরিশ্রম করলো, সেই পরীক্ষাটাই আর দিতে পারেনি!

দ্বিতীয় ঘটনাটি পরিচিত এক ছোই ভাইয়ের। চমৎকার পরীক্ষা দিয়েও ৩৬তম বিসিএসে টেকেনি। ৩৭তমের জন্য নিয়েছিল আরো ভালো প্রস্তুতি। আত্মবিশ্বাসে টই-টম্বুর হয়ে পরীক্ষা হলে ঢুকলেও বের হয়েছে একেবারে ঘেমে-নেয়। বাজে পরীক্ষার ধাক্কা সামলাতে না পেরে বাসায় ফিরেই বিছানায়। নিতে হয়েছে হাসপাতাল পর্যন্ত। তৃতীয় ঘটনাটি এক কপোত-কপোতীর।

বিসিএসই ছিল তাদের ধ্যান-জ্ঞাণ। সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকে পার করে দিয়েছে জীবনের কয়েকটি বসন্ত। গত দুই বিসিএসে ভাইভা পর্যন্ত গিয়েও বাদ পড়েছে। বিয়ের চাপ উপেক্ষা করে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতীক্ষায় ছিল ৩৭ বিসিএসের। দুজনেরই পরীক্ষা মন মতো হয়নি। প্রশ্ন নাকি বিগত দুই বিসিএসের চেয়েও কঠিন হয়েছে। দুশ্চিন্তার আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে মাথায়! বিসিএস বিসিএস করে বিকল্প চাকরির যে চেষ্টাই করেনি কোনদিন!’

সাংবাদিক, লেখক ইমরান বর্ণিত তিনটি ঘটনায় আমরা বুঝতে পারি, কী এক নিদারুণ মনোযাতনার ভেতর দিয়ে আমাদের ছেলে-মেয়েদের যেতে হয়। অথচ একটা সভ্য সমাজে সরকারি কর্ম কমিশনের চাকরি ছাড়াও যে আরও অনেক ধরনের সম্মানজনক পেশা থাকে। আমরাও নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি। আমার ছাত্র যে অসাধারণ একজন বংশী বাদক, সেও বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দোয়া করি তাঁর বিসিএস হোক, কিন্তু আজকাল শিক্ষকদের দোয়া-বদদোয়া কোনটাই কাজে লাগে না। আমার এ প্রিয় ছাত্রের মত নিশ্চয় বাকি সবাইও বিসিএস জব পেতে চাচ্ছে।

এখন তো ছেলে-মেয়েদের একটা অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শুধু বিসিএসের পড়াশুনা করে। আমি খালি ভাবি, সবাই বিসিএস ক্যাডার হলে, গান লিখবে কে? সুর দিবে কে? গাইবে কে? কবিতা লিখবে কে? কবিতা আবৃত্তি করবে কে? রাজনীতি করবে কে? ব্যবসা করবে কে? বিজ্ঞানী হবে কে? বড় সাংবাদিক হবে কে? আমাদের সাকিব-তামিম কিংবা মুশফিক-মোস্তাফিজ যদি বিসিএস ক্যাডার হতেন তাহলে কেমন হত? রুনা লায়লা যদি আজ গান না পেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি হতেন, তাহলে কেমন হত? প্রাইভেট জবে কেন নিশ্চয়তা থাকবে না?

সবাই বিসিএস অফিসার হতে পারবে না, হওয়ার সুযোগও নেই। তাহলে রাষ্ট্র কেন একটু সিরিয়াসলি ভাবে না। রাষ্ট্র কেন সব চাকরিতে পেশাগত নিশ্চয়তার বাস্তবতা সৃষ্টি করে না। রাষ্ট্রনায়কদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। না হলে আমাদের সোনার ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে আমরা সমাজের জন্য বেশী কিছু আশা করতে পারব না।

লেখকঃ শিক্ষক ও সাংবাদিক, তথ্যসূত্র: ইয়ুথ জার্নাল।

More News Of This Category