এক বিকেলে রাজশাহীর উপশহর নিউমার্কেট এলাকায় হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে হঠাত্ চোখ পড়ল নানারকম রঙ-বেরঙের মশলার পসরা সাজিয়ে একজন লোক কী যেন বিক্রি করছেন। একটু কাছে যেতেই চোখ পড়ল দোকানের পাশে টাঙিয়ে রাখা ব্যানারে বড় করে লেখা ‘পান গার্ডেন’। সঙ্গে হরেকরকম পানের নাম।
পানের নামগুলো দেখে বিস্ময়ে নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘এ-ও কী সম্ভব?’ চকলেট পান, অরেঞ্জ পান, স্ট্রবেরি পান, লেমন পান, আইস পান, টক-মিষ্টি পান, ম্যাজিক পানসহ আরো বাহারি নামের দেখা মিললো এই পান গার্ডেনে। তবে সেই তালিকায় যখন দেখলাম ‘ফায়ার পান’ নামের বিশেষ এক ধরনের পান তখন বিস্ময়টা বেড়ে গেল আগের তুলনায়।
বেশ কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম রাজধানীর বেশকিছু জেন্টস পার্লারে আগুনের মাধ্যমে চুল কাটা হয়। নাম ফায়ার কাট। কিন্তু তাই বলে ফায়ার পান! ফায়ার পান নিয়ে কৌতুহল মেটানোর জন্য ভাবলাম দোকানির সঙ্গে কথা বলা যাক। কিন্তু সেই উপায় নেই। দোকানিকে ঘিরে রেখেছেন বিভিন্ন বয়সী ক্রেতা।
একেকজন একেকরকম পানের অর্ডার দিচ্ছেন, আর দোকানি ঝটপট পান বানিয়ে ক্রেতাদের মুখে পুড়ে দিচ্ছেন। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর দোকানের ভিড় কমলো। নাম জিজ্ঞেস করতেই বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন, মো. মামুন ইসলাম চঞ্চল। পানের ব্যবসার সঙ্গে চঞ্চলের জড়িয়ে পড়া খুব বেশিদিনের নয়। তিন-চার বছর হবে।
এর আগে তিনি একজন কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন মুদি দোকানে। তখন থেকেই স্বপ্ন বুনতেন নিজের একটি ব্যবসা দাঁড় করানোর। অতঃপর পান গার্ডেন নিয়ে শুরু হয় তার স্বপ্নের পথচলা। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় কোন পান? প্রশ্নের জবাবে চঞ্চলের এক কথায় উত্তর, ‘ফায়ার পান।’
ফায়ার পানের গল্পটি একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। আজ থেকে প্রায় চার-পাঁচ মাস আগের কথা। একদিন টেলিভিশনের পর্দায় খাবারের একটি অনুষ্ঠান দেখে চঞ্চল জানতে পারেন ইন্ডিয়ায় ফায়ার পান নামে বিশেষ এক ধরনের পান বিক্রি করা হয়। যে পানে যাবতীয় মশলা দিয়ে ওপরের আস্তরণে আগুন ধরিয়ে মুখে পুড়ে দেওয়া হয় আগুনসহ।
বিষয়টি চঞ্চলের নজরকাড়ে। সঙ্গে নতুন এই পানের প্রতি বেশ কৌতুহল জন্মে তার। একদিন মশলা কিনতে গিয়ে চঞ্চল তার কৌতুহলের কথা জানান দোকানিকে। দোকানি বলেন, ‘ফায়ার পানের বিশেষ মশলাটি পাওয়া যায় ইন্ডিয়াতে। অর্ডার দিলে এনে দেওয়া সম্ভব।’ চঞ্চল বিন্দুমাত্র দেরি না করে সেদিনই সেই মশলার অর্ডার দিয়ে দেন।
এরপর ইন্ডিয়া থেকে ফায়ার পানের সেই বিশেষ মশলা আসে। চঞ্চলের পান গার্ডেনে যুক্ত হয় ভিন্নধর্মী এক পান, ফায়ার পান। প্রথমদিকে ফায়ার পান সম্পর্কে কারোর তেমন কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু একদিন এক ভদ্রমহিলা ফায়ার পান খাওয়ার ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করলে ফায়ার পানের বেচা-বিক্রি হঠাত্ করেই বেড়ে যায়। ফায়ার পান খাওয়ার জন্য শহরের দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই ভিড় জমাতে শুরু করেন চঞ্চলের পান গার্ডেনে।
ফায়ার পানের জন্য বিভিন্ন বয়সী ক্রেতাদের ভিড় জমলেও এই পান সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তরুণ-তরুণীদের কাছে। জ্বলন্ত আগুনসহ মুখে পুড়ে দেওয়া পানের ভিডিও বন্ধুরা ধারণ করছেন মোবাইলে। পরবর্তীতে সেই ভিডিও স্থান পাচ্ছে ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রামে। তবে পানে আগুন দেওয়ার বিশেষত্বটা কী?
চঞ্চলের ভাষ্য ম্যতে, ‘ফায়ার পানে ব্যবহার করা হয় দেশি-বিদেশি প্রায় ৩০ ধরনের মশলা। আগুনের আঁচে এই মশলাগুলো হালকা গলে যায় এবং নরম হয়। ফলস্বরূপ তা আগের তুলনায় বেশ মুখরোচক হয়ে ওঠে।’ বিভিন্ন ধরনের পানের পাশাপাশি পান গার্ডেনে রয়েছে চঞ্চলের নিজের বানানো পান, নাম টক-মিষ্টি পান।
এছাড়াও চঞ্চলের দোকানে রয়েছে পান বানানোর প্রায় ৬০টি আইটেম। রয়েছে ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি মশলাও। সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পান বিক্রি করেন চঞ্চল। তার প্রতিদিনের আয় প্রায় ২৫০০-৩০০০ টাকা। ২৮ বছর বয়সী চঞ্চলের পড়াশোনা ক্লাস এইট পর্যন্ত। এরপর জীবিকার তাগিদে আর সুযোগ পাননি পড়াশোনা করার।
মা, ভাই-ভাবির ছোট্ট সংসারে এখন বেশ সুখেই জীবনযাপন করছেন তিনি। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি বেকার যুবকদের পান বানানো শিখিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন চঞ্চল। তিনি মনে করেন, পান বানানো একটি শিল্প। আর শিল্পীর সৃষ্টি তখনই পূর্ণতা লাভ করে যখন তা শিল্পীর হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তথ্যসূত্র: ইত্তেফোক।