1. editor@islaminews.com : editorpost :
  2. jashimsarkar@gmail.com : jassemadmin :

’মেইড ইন চায়না’ নয় এখন ’মেইড ইন বাংলাদেশ’র যুগ

আজ থেকে ২২ বছর আগে চীনের ব্যবসায়ী লিও ঝুয়াং লিফেং যখন ঢাকায় আসেন, তখন এখানকার বিমানবন্দরে মাত্র দুটি মালপত্র বহনকারী বেল্ট সক্রিয় ছিল। বিমানবন্দরে আলোক ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত ছিল না। তখন বাংলাদেশে আসা অনেক চীনা ব্যবসায়ী রাজধানী ঢাকার বিমানবন্দরে নেমে এমন অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। এসময় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিল। এদেশে ঘনঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতো, অবকাঠামো ছিল অপর্যাপ্ত।

বর্তমানে এলডিসি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঝুয়াংয়ের বয়স ৫১ বছর। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে আসেন এখানে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করতে। এখানকার সস্তা শ্রম এবং শ্রমিকের আধিক্য তাকে এখানে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী করে। এলডিসি ফ্যাক্টরিগুলো গাজীপুরে অবস্থিত।

এই বিষয়ে তিনি হংকংয়ের সংবাদপত্র সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে জানান, তখন প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অভাব ছিল। তাৎক্ষণিক নুডলস কেনাও সহজ ছিল না। কিন্তু কয়েক বছরে বাংলাদেশে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছে। যদিও এসব পরিবর্তনকে চীনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বাংলাদেশে তার কোম্পানিতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ কর্মরত আছে। এই ফ্যাক্টরির কম্পাউন্ড দেখে মনে হয় যেন একটি গ্রাম।

এখানকার চিকিৎসকরা কর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিনামূল্যে পরামর্শ দেয়। এছাড়া তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য আছে ডে-কেয়ার সেন্টার। চীনা এবং অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখায় এদেশের সব জায়গায় এখন এমন কম্পাউন্ড আছে। তাদের বিনিয়োগ এই দেশকে একটি ৩.৫ মিলিয়ন শ্রমিকের ম্যানুফ্যাকচারিং পাওয়ারহাউসে পরিণত করেছে।

এসব শ্রমিক H&M ও ইউনিকলো’র মতো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করেছে। মাইকেল কর্সের মতো শৌখিন ব্র্যান্ডগুলোরও বাংলাদেশে তৈরি পণ্য আছে। চীনে মজুরি বাড়ায় বেশিরভাগ পোশাকে ‘মেইড ইন চায়না’ নয় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ লাগানোর সময় চলে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ঝুয়াংয়ের মতে, ২২ বছর আগে এদেশে মাত্র ২০ থেকে ৩০টি চীনা কোম্পানি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় তুলনামূলক নবীন দেশটিতে এই সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে মোটামুটিভাবে ৪০০ তে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে চীনের ঋণ।

গত এক দশকে এটি গড়ে ৬ শতাংশ বেড়েছে কিন্তু চলতি বছর ৮.১৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের এমন দ্রুত ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সক্ষমতা সকলের নজরে এসেছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ায় প্রশাসন এই ঋণ সামলাতে সক্ষম। তথ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করেছেন যে ঢাকা কোনও দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না এবং তার প্রশাসন বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়তা করতে আগ্রহী যেকোনো দেশকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে।

তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে চমৎকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে আমাদের। বাংলাদেশকে দেয়া ভারতের কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণের বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা (চীনের) ঋণ শোধ করতে পারবো কিনা এমন প্রশ্নে আমার উত্তরে হলো এটি বাংলাদেশের জন্য কোনও দুশ্চিন্তার বিষয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথাকথিত চীনের ঋণের ফাঁদ নিয়ে মোটেও দুশ্চিন্তা করছে না বাংলাদেশ। কারণ দেশটি চীনের পাশাপাশি অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব অব্যাহত রেখেছে।

চীন থেকে বাংলাদেশে: দ্রুতগামী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও ঢাকা ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা, ফিলিপিন্সের ম্যানিলা, কম্বোডিয়ার নমপেনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে। হাইওয়েসহ অবকাঠামোর অভাবে ঢাকার সড়কে ব্যস্ত সময়ে এতো যানবাহন থাকে যে ৫০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে তিন ঘণ্টা লেগে যেতে পারে।

কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশকে উন্নত করার জন্য প্রচুর সুযোগ আছে। তাই দেশটি অধিক সংখ্যক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এসব বিনিয়োগকারীর একজন হলেন হংকংয়ের ব্যবসায়ী এবং ফেলিক্স চ্যাং ইয়োই-চোং।

তিনি বিশ্বের অন্যতম পরচুলা প্রস্তুতকারী কোম্পানি এভারগ্রিন প্রোডাক্টস গ্রুপের চেয়ারম্যান। এই ফ্যাক্টরি চীনের মূলভূমি থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার পর এতে এখন ১৮ হাজার কর্মী কাজ করেন। উত্তরা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে অবস্থিত ফ্যাক্টরিটিতে মাসে তিন থেকে চার লাখ পরচুলা তৈরি হয়।

এই ২১৩ একর আয়তনের জোনে ২০টির মতো কোম্পানি আছে। এগুলোর মধ্যে ছয়টি হংকংয়ের। বাংলাদেশ জুড়ে এই ধরনের আটটি জোন আছে। এসব জোনে কোম্পানিগুলো প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করে কম বা শূন্য হারে কর দিয়ে পণ্য তৈরি করতে পারে। এই কর নীতি এসব কোম্পানির পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

হংকং এবং মূলভূমি চীনে শ্রমের মূল্য বেড়ে যাওয়ার এখানকার যেসব উদ্যোক্তা গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাদের একজন হলেন চ্যাং। এই ৫৩ বছর বয়সী ব্যবসায়ী বলেন, এশিয়ার যেকোনো জায়গায় আমাকে আমার ফ্যাক্টরি সরিয়ে নিতেই হতো। কারণ হংকং এবং মূলভূমি চীনে শুধু মজুরি নয়, কর্মীদেরকে দেয়া সামাজিক কল্যাণ সুবিধাগুলোর পরিমাণও বেড়ে গিয়েছিল।

এক দশক আগে চীনের হেনান প্রদেশের শেনঝেন, গুয়াংঝৌ ও কুনমিং শহরে চ্যাংয়ের কোম্পানির ফ্যাক্টরি ছিল। তিনি গুয়াংঝৌয়ের ফ্যাক্টরিটি বন্ধ করে দেন এবং অন্য ফ্যাক্টরিগুলোও অনেকাংশে গুটিয়ে নেন। এখন তার কোম্পানির ৯৩ শতাংশ পরচুলা তৈরি হয় বাংলাদেশে।

চ্যাং তার ফ্যাক্টরিগুলো বাংলাদেশে সরিয়ে নেয়ার আগে চীনা কর্মীদেরকে এক মাসে ২৮৯ ডলার করে মজুরি দিতেন। কিন্তু ফ্যাক্টরিগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তরের পর এখানকার কর্মীদেরকে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৫ ডলার করে মজুরি দিতে হয় তার।

বাংলাদেশে এক মাসে একজন শ্রমিকের মজুরি সর্বোচ্চ ৯৫ ডলার, যা এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় কম। এক মাসে একজন শ্রমিকের মজুরি কম্বোডিয়ায় ১৮২ ডলার, ভিয়েতনামের হ্যানয় ও হো চি মিন সিটিতে ১৮০ ডলার। মিয়ানমারে একজন শ্রমিকের এক দিনের মজুরি ৩.৬০ ডলার।

সস্তা শ্রম এই গার্মেন্ট সেক্টরকে একটি ৩০ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করেছে, যা বাংলাদেশে রপ্তানির ৮০ শতাংশ। তবে শ্রমিকরা তাদের আয়ে সন্তুষ্ট নন। গত জানুয়ারিতে কয়েক হাজার শ্রমিক তাদের সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় নামে। এসময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহত এবং কয়েক ডজন শ্রমিক আহত হন।

এলডিসি গ্রুপের ঝুয়াং জানান, কম্বোডিয়ার ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো মাত্র ১৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশের শ্রমিক ইউনিয়ন খুবই শক্তিশালী। অন্যদিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬০ মিলিয়ন।

তিনি জানান, ভিয়েতনামে উৎপাদন খরচ এবং মজুরি দ্রুত বাড়ায় দেশটি তার জন্য অনুকূল ছিল না। দেশটিতে দুর্নীতি একটি সাধারণ বিষয়। জনসংখ্যা কম এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলো তুলনামূলকভাবে খুবই শক্তিশালী।

ঝুয়াং বাংলাদেশে আসার পর গত ২২ বছরে এদেশে চীনা কোম্পানির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তবু ফিলিপিন্স ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর রাজধানীগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের রাজধানীতে চীনের ব্যবসায়ী এবং কর্মীর সংখ্যা কম। এসব দেশে যখন চীন থেকে আসা ব্যবসায়ী ও কর্মীরা অস্বস্তি এবং ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন বাংলাদেশে এই ধরনের সেন্টিমেন্ট এখনও গড়ে ওঠেনি।

অপর্যাপ্ত অবকাঠামো: এভারগ্রিন প্রোডাক্টসের চ্যাং এক দশক আগে যখন বাংলাদেশে আসেন, তখন এখানে বর্ষাকাল। তিনি বলেন, এতো বৃষ্টি হয়েছিল যে ঢাকা পানিতে ডুবে গিয়েছিল। রাস্তায় এতো পানি জমেছিল যে আমার গাড়ির চাকাগুলো দেখা যাচ্ছিল না।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। আমি যতবার ঢাকার অফিসে এসেছি সবসময় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার হয়েছি। প্রতিবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পর সংযোগ পেতে এক ঘণ্টা লেগে যেতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট নেই বললেই চলে। তার ফ্যাক্টরিগুলোতে সড়কপথে যেতে নয় থেকে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যেতো। এটাও নির্ভর করতো ট্র্যাফিকের অবস্থার ওপর।

বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদেরকে একটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছে তাদের পণ্য জাহাজে পাঠাতে গিয়ে। বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৭ সালে ২.৫৬ মিলিয়ন কন্টেইনার (প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ) কার্গো ওঠানো-নামানো সম্ভব হয়েছে।

এছাড়া সংকীর্ণতার জন্য এই বন্দর বড় ধরনের কন্টেইনার জাহাজগুলো সামলাতে পারে না। তাই হংকং এবং চীন থেকে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় উপকরণ আনতে চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ লেগে যায় বলে জানান এভারগ্রিন প্রোডাক্টসের চেয়ারম্যান চ্যাং। তথ্যসূত্র: আরটিভি অনলাইন।

More News Of This Category