আচ্ছা, আপনি কি অফিসের জিনিস চুরি করে বাসায় নিয়ে যান?’ অফিসে বসে কাজ করার সময় বস যদি আপনাকে ডেকে এমন প্রশ্ন করে বসেন, কী হবে তখন? হকচকিয়ে তো যাবেনই, গোসসাও হতে পারে। সে রকম চিড়বিড়ে মেজাজ হলে কিছু গরম বাতচিতও হতে পারে। তবে এক জরিপ বলছে, অনেক কর্মীই প্রতিষ্ঠানের টুকটাক জিনিস নিজের সম্পদ বানিয়ে বগলদাবা করে বাড়ি ফেরেন।
লেখালেখির উপকরণ প্রস্তুতকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পেপারমেট সম্প্রতি একটি নতুন কলম বাজারে এনেছে। কলমটির উদ্বোধন উপলক্ষে সেই জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। জরিপের তথ্যের বরাতে বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, অফিসের শতভাগ কর্মী তাঁদের কর্মস্থল থেকে কলম নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। অন্য এক প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ কর্মী অফিসের ছোটখাটো নানা জিনিস লুকিয়ে নিয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এমন ঘটনা অমূলক নয়। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা ঘটে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ বিষয়ে মনোচিকিৎসক ও মনোশিক্ষাবিদ মোহিত কামাল বলেন, সবাই যে অফিস থেকে জিনিসপত্র বাড়িতে নিয়ে যান, সেটা অস্বাভাবিক। কেউ কেউ হয়তো তাৎক্ষণিক তাড়না থেকে অফিসের টুকিটাকি জিনিস নিয়ে যান। সেটা আসলে উদ্দেশ্যমূলক চুরি নয়। এটা একধরনের রোগ। মূলত ইমপালস কন্ট্রোল ডিসওয়ার্ডের কারণে এমনটা হয়ে থাকে।
মনোচিকিৎসক মোহিত কামাল বলেন, যেকোনো জিনিস ভালো লাগলে কেউ কেউ নিজের মধ্যে সেটার পাওয়ার তাড়না অনুভব করেন। ফলে সেটা না পাওয়া পর্যন্ত তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে। সেটা পেতে তিনি উদ্গ্রীব হয়ে যান। তা থেকেই বড় বড় দোকানে গয়না চুরি বা অন্য কোনো জিনিস চুরির ঘটনা ঘটে। অবশ্য এটাকে উদ্দেশ্যমূলক চুরি বলা যাবে না। দেখামাত্র তাড়না সামাল দিতেই কেউ কেউ সেটা নিজের করে নিতে এমন কাজ করতে বাধ্য হন।
মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল বলেন, এ ধরনের কাজ দুটি কারণে ঘটতে পারে। প্রথমত, মানসিক সমস্যা বা ক্লেপটোম্যানিয়ার কারণে। দ্বিতীয়ত, নৈতিকতার অভাব। তিনি বলেন, কেউ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলে এমন চুরি করতে পারেন। আবার নৈতিকতার অভাবে এ রকম হতে পারে। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে যারা এ ধরনের চুরি করেন, পরবর্তী সময় তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা অপরাধবোধ কাজ করে না। তবে মানসিক সমস্যায় এ ধরনের চুরি যারা করেন, পরবর্তী সময়ে তাদের অপরাধবোধ হয়। এমনকি চুরি করা জিনিস আবার ফিরিয়ে দিয়ে আসেন। কারও মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
কলম, পাতা, খাতা, প্যাড, ফাইল, পত্রিকা, কলমদানি, প্রিন্টারে প্রিন্ট করা পাতাসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস অফিস থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি হিসেবে ধরা হয়েছে। বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, অফিসের কর্মীদের ছোটখাটো জিনিস সরানোর এই আচরণের কারণে বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে বছরে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়। এ ধরনের কাজ মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মজুত ৩৫ শতাংশ সংকোচনের জন্য দায়ী এবং এতে বার্ষিক গড় মোট ১ দশমিক ৪ শতাংশ মুনাফা কমে যায়। কাজেই অফিসের কর্মীদের এ ধরনের আচরণ আমাদের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে কর্মীদের এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আপনি যখন নতুন চাকরি শুরু করেন, তখন আপনার নিয়োগকর্তা সততা, স্বচ্ছতা, নিষ্ঠা ও দায়বদ্ধতা-সংবলিত বিভিন্ন চুক্তিনামায় সই নিয়ে থাকেন। ফলে এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় চুরি আপনার নীতি ও চুক্তিনামার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অপর দিকে নিয়োগকর্তা আপনাকে নমনীয় কর্মঘণ্টা ও সহকর্মীবান্ধব কর্মপরিবেশ দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। একই সঙ্গে নিয়োগকর্তা আপনার কাছে আপনার কাজের পাশাপাশি ইতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সুন্দর আচরণ প্রত্যাশা করেন।
বাস্তবে অবশ্য অনেক চাকরিজীবী তাঁদের নিয়োগকর্তার মূল চুক্তি ভঙ্গ করতে দেখেন। প্রকৃত অর্থে, প্রায় ৫৫ শতাংশ কর্মী তাঁদের নিয়োগের প্রথম দুই বছরের মধ্যে অঙ্গীকার ভঙ্গের কথা বলেন এবং ৬৫ শতাংশ কর্মী গত বছর অফিসের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শিকার হয়েছেন।
তথ্যসূত্র: প্রথমআলো ডটকম।