পড়াশোনা, খেলাধুলা, হৈহুল্লোড় আড্ডা সব মিলিয়ে এই হচ্ছে তারুণ্যময় সময়। প্রতিটি মুহূর্ত পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করাই হচ্ছে তারুণ্যের ধর্ম। তাই ব্যস্ততার শেষ নেই তরুণদের। হঠাত্ যদি কোনো অবসর মিলে যায় তখন আবার চিন্তা—কী করে কাটাই সময়! কিন্তু সময় তো কারও জন্য বসে থাকে না। সময় কেটে যায় হয়তো দ্বিধায় নয়তো অবহেলায়। অথচ একটু পরিকল্পনা করলেই অবসরটা কাজে লাগানো যায়। এবারের আয়োজনে এ বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন রিয়াদ খন্দকার
নাই কাজ তো খই ভাজ—অনেক আগে এ কথাটা খুব চালু ছিল। কারণ তখন অবসরে ভাজা খইয়ের মজা নিতে নিতে সময় কেটে যেত। এখন অবশ্য ভাজা খইয়ের মজা নয়, কথার খই ফোটাতেই ব্যস্ত থাকে তরুণ-তরুণীরা। তাও মুখোমুখি নয়; মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছে, নয়তো চ্যাটিং করছে। সময়ের সাথে বদলে যাচ্ছে তরুণদের অবসর সময় কাটানোর প্রক্রিয়া। ডাকটিকেট সংগ্রহ, বিমানের মডেল বানানো, বাগান করা বা পোষা প্রাণীটার যত্ন নেওয়ার জায়গায় এখনকার তরুণেরা ফেসবুক, কম্পিউটার গেমস ও টিভি দেখা নিয়েই অবসরে অনেক ব্যস্ত থাকে।
নব্বইয়ের দশকে যেখানে প্রতি ছয় জনের মধ্যে একজনের কাছে ডাকটিকেট জমানোটা শখ হিসেবে ছিল, সেখানে বর্তমানে প্রতি ২০ জন তরুণের মধ্যে একজন তরুণ শখ হিসেবে ডাকটিকেট জমান। দুরবিনে চোখ লাগিয়ে পাখি দেখার মতো কাজগুলোও বর্তমান তরুণরা হয়তো সেভাবে গ্রহণ করে না। কিন্তু প্রতি দশজন তরুণের মধ্যে আট জন তরুণের অবসরের প্রধান কাজ হচ্ছে টিভি দেখা। আবার প্রতি পনের জনের মধ্যে দশ জনের কাজ হচ্ছে কম্পিউটার গেমস খেলা। অন্যদিকে ৫৮ ভাগ তরুণের চোখ পাখি বা প্রাচীন কোনো স্ট্যাম্পের উপর পড়ে না। তাদের চোখ পড়ে কম্পিউটারের পর্দায় ফেসবুকে। তরুণদের সময় কাটানোর ধরন নিয়ে ক্যাডেট ফোর্স কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপ থেকে এসব তথ্য জানা যায়। অথচ অবসর সময়টা অযথা ব্যয় না করে কাজে লাগানোটাই বুদ্ধিমানের পরিচয়। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই সময়ের গুরুত্বটা জানা বেশি প্রয়োজন।
মূলত দৈনন্দিন জীবনে সময়কে বোঝার জন্যে আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব দৈনন্দিন জীবনে তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না। সময়ের ব্যাপারে সার্বজনীন মূলনীতি হচ্ছে প্রতিদিন আমাদের প্রত্যেকের জন্যই সমপরিমাণ ঘণ্টা ও মিনিট বরাদ্দ রয়েছে। এই ঘণ্টা ও মিনিটগুলোকে আপনি জমা রাখতে পারবেন না, অন্য কার সাথে বিনিময়ও করতে পারবেন না। সময় অত্যন্ত মূল্যবান।কিন্তু এ মূল্যের সাথে টাকা-পয়সার মূল্যের পার্থক্য রয়েছে।
টাকা-পয়সা সঞ্চয় করা যায়, ধার দেওয়া যায়। প্রয়োজনে ধার নেওয়া যায়। কিন্তু সময় ধারও দেওয়া যায় না, ধার নেওয়াও যায় না। যে সময় চলে গেল তা আর কখনও ফেরত আসে না। সময় আর অর্থের ব্যাপারে একটি মৌলিক সত্য হলো দুটোই আমাদের খুব বেশি প্রয়োজন। এত বেশি প্রয়োজন যে সে চাহিদা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আমাদের এই তরুণ প্রজন্মের মাঝেই সময়ের অভাবজনিত হাহাকার সবচেয়ে বেশি। হাহাকার যতই থাকুক এই ব্যাপারে সময় ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে গেলে আপনার জীবন এত বেশি যান্ত্রিক হয়ে উঠবে যে আপনি হাঁপিয়ে উঠবেন। এজন্য নিজের মতো করে অবসর সময়টাকে সঠিক ব্যবহারের প্রস্তুতি নিন।
বিশ্বায়নের এ যুগে ইংরেজি ভাষার চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। তাই শিখে ফেলা যায় এ আন্তর্জাতিক ভাষা। ব্রিটিশ কাউন্সিলে এর জন্য বেশকিছু স্পোকেন কোর্স আছে, যা ভবিষ্যতের জন্য বেশ সহায়ক। এ ছাড়া আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষার এ কোর্স চালু রয়েছে। ইংরেজি ভাষা ছাড়াও শিখে নেওয়া যায় যেকোনো বিদেশি ভাষা। স্প্যানিশ ভাষার কদরও এখন কম নয়। ইচ্ছা থাকলে করে নেওয়া যেতে পারে ফটোগ্রাফির ওপর শর্ট কোনো কোর্সও। পাঠশালায় রয়েছে ফটোগ্রাফির ওপর বেসিক অনেকগুলো কোর্স। পছন্দসই যেকোনো কোর্স বেছে শুরু করা যেতে পারে ফটোগ্রাফি।
যারা গান, নাচ, ছবি আঁকা খুব পছন্দ করেন তারা পারেন এ সময়ে এদিকে বেশি মনোযোগ দিতে। বাফা কিংবা ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে এসবের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা। ইচ্ছা করলেই শিখে ফেলা যায় শরীরচর্চা বিষয়ক সাঁতার কিংবা কারাতে। করা যেতে পারে ইয়োগা কিংবা মেডিটেশনের কোনো কোর্স। সাঁতার, ইয়োগা, কারাতে—এ ধরনের প্রশিক্ষণ তরুণদের জন্য খুবই সহায়ক। এ ধরনের প্রশিক্ষণ আপনার শরীরকে রাখবে সবল ও তরতাজা। যারা খেলাধুলা করতে পছন্দ করেন তারা এ সময়টাকে বেছে নিতে পারেন খেলাধুলার উপযুক্ত সময় হিসেবে। যারা শুধু ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন তাদের জন্যও হতে পারে এটি উপযুক্ত একটি সময়। বাংলাদেশে দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। ইচ্ছা করলে বানিয়ে ফেলতে পারেন পছন্দমতো জায়গার তালিকা। আর বের হয়ে যেতে পারেন শুধু ঘোরাঘুরি করতে।
প্রয়োজনীয় কিছু
অবসরকে কাজে লাগানোর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের তালিকা তৈরি। প্রতি মুহূর্তেই হাজারটি ভিন্ন ধরনের কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোন কাজটি বিশেষভাবে করা প্রয়োজন তা নিরূপণ করতে পারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সব সময় দেখবেন জরুরি কাজ করতে করতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের প্রয়োজন পূরণ করার পর সুদূরপ্রসারী কাজের জন্য সময় পাওয়া যাচ্ছে না। সুদূপ্রসারী লক্ষ্যের জন্য প্রতিদিন আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টা সময় ব্যয় করুন। পরবর্তী জীবনে দেখবেন এই আধঘণ্টা-একঘণ্টা সময়ই আপনাকে বড় ধরনের তৃপ্তি দিচ্ছে।
জীবনে অলস সময় নানাভাবে আপনার কাছে ধরা দেবে। অলস সময়ের দৈর্ঘ্যকে দীর্ঘায়িত করা আর তাকে নিজের সঙ্গী ভেবে নেওয়া একই কথা। যারা এ বিষয়টিকে প্রশ্রয় দেন, তারাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন আজকের কাজ কালকে হলেও করা সম্ভব। কিন্তু কালকের কাজ যে কালকে করা সম্ভব নাও হতে পারে এটি অলস সময় ভাবতে দেয় না।
তারুণ্যের সবচেয়ে বড় শক্তি গতি। গতিকে কেন্দ্র করে যে কেউ আবর্তন করতে পারে একটি লক্ষ্যের দিকে। মনে রাখতে হবে, সময় ও স্রোত কারও জন্য বসে থাকে না। আপনার অবর্তমানে আরেকজন সময়কে ব্যবহার করতে পারলে আপনারও তা করার ক্ষমতা থাকা উচিত।
শুধু পরিকল্পনা নয়, চেষ্টা করতে হবে তা বাস্তবায়ন করার। প্রথমদিকে রুটিনমাফিক কাজ করা অসুবিধা হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে সময়কে শাসন করতে হবে নিজের মনমতো।
খেলাধুলা একজন তরুণকে দিতে পারে নির্ভেজাল আনন্দ। তাই প্রতিদিনের রুটিনে থাকা উচিত খানিকটা খেলাধুলা, খানিকটা আড্ডা কিংবা একটু ইন্টারনেটে দুনিয়াটা দেখে নেওয়া ইত্যাদি। এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে খেতে গেলেও অনেক কিছু আবিষ্কার করা যায়, যা জীবনে কাজে লাগতে পারে।
তারুণ্য জীবনের সবচেয়ে জ্বলজ্বলে সময়। তাই বয়স যতই বাড়ুক না কেন স্মৃতির মণিকোঠায় তারুণ্য বরাবরই থাকে উজ্জ্বল। তারুণ্যের প্রতিটি ক্ষণই অনেক যত্ন করে কাটানো উচিত, পরবর্তীতে যেন সময়টিকে নিয়ে কোনো আফসোসের অবকাশ না থাকে। তাই আপনার এ সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত কাটুক আনন্দে।
তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক।