টাকা জমিয়ে মানুষ সম্পদ গড়ে। নাজমুন নাহার জমানো টাকায় ছুটে যান নতুন কোনো দেশে। ভ্রমণই তাঁর শখ। এ শখই তাঁকে নিয়ে গেছে ৯৩টি দেশে। পা ফেলেছেন ক্যারিবীয় সাগরের বেশ কয়েকটি দ্বীপপুঞ্জেও।
আলাপের একপর্যায়ে বললেন, ‘আই ওয়াজ বর্ন টু ট্রাভেল।’ কথাটার মর্মার্থ আরও স্পষ্ট হলো আলাপের উপসংহারে। ততক্ষণে জেনেছি, ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। ৩৮ বছর পেরোনো নাজমুন নাহার ঘুরে ফেলেছেন ৯৩টি স্বাধীন দেশ। গিয়েছেন ক্যারিবীয় সাগরে যুক্তরাজ্যের কয়েকটি ঔপনিবেশিক দ্বীপপুঞ্জেও। বেশির ভাগ ভ্রমণই একা একা। আলাপের শেষে তাই মনে হলো, ‘আমি যেন ভ্রমণের জন্যই জন্মেছি।’ কথাটি নাজমুন নাহারের মুখেই মানায়।
বাংলাদেশের এই নারী ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ঘুরেছেন ৩৫টি দেশ। এ তালিকায় আছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু, চিলি, প্যারাগুয়েসহ দক্ষিণ আমেরিকার ১০টি দেশ। এই দুই সাল মিলিয়ে এটাকে তাঁর ‘ভ্রমণবর্ষ’ বলা যায়!
দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে সুইডেনপ্রবাসী নাজমুন নাহার বাংলাদেশে এসেছেন গত ডিসেম্বরে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে আবার ব্যাকপ্যাক কাঁধে তুলবেন কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তানসহ মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ ভ্রমণে। আপাতত ঢাকাতেই আছেন। ১৪ জানুয়ারি এসেছিলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। কথায় কথায় শোনা হলো তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত। শুধু কি শোনা? দেখারও তো সুযোগ হলো অনেক কিছু।
‘এই যে দেখুন এই ছবিটা, এটা মুন ভ্যালি। চিলির সান পেদ্রো দ্য আতাকামা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। অভিযাত্রীরা নাকি চাঁদে যাওয়ার আগে এখানে আসেন, গবেষণা করেন।’ টিলার মতো একটা জায়গায় বসে আছেন নাজমুন নাহার—ছবিটা দেখাতে দেখাতে বলছিলেন এ কথা। তাঁকে ছাড়া ক্যামেরার লেন্স ধরেছে ধু-ধু লালচে ছোটখাটো টিলা।
স্মার্টফোনের পর্দায় আঙুল ছুঁয়ে আরেকটা ছবি দেখালেন তিনি। এই ছবি অবশ্য চেনা, পেরুর মাচুপিচু শহরের ধ্বংসাবশেষ। পরেরটায় স্বচ্ছ কাচের মতো একটা জায়গা, সেখানে দাঁড়িয়ে নাজমুন নাহার। বললেন, ‘এটা বলিভিয়ার সালার দ্য উইনি। একসময় সমুদ্র ছিল, এখন জমাট লবণ।’ এটার ওপর দিয়ে নাকি হাঁটাও যায়। ছবিটা দেখে স্বপ্নে দেখা কোনো জায়গা বলে মনে হলো। আকাশের নীল মিশে একাকার সে লবণ সাগর।
তাঁর মুঠোফোন ভরা এমন অজস্র ছবি। সেসব ছবি বিনে পয়সায় বিভিন্ন দেশ ও শহরের সঙ্গে পরিচয় ঘটাল। এরপর মুঠোফোন পাশে রেখে নাজমুন নাহার বলতে শুরু করলেন তাঁর ভ্রমণকন্যা হয়ে ওঠার কথা।
বইয়ের স্বপ্ন, বাবার প্রেরণা
বইয়ের পোকা বলতে যা বোঝায়, নাজমুন নাহার ছোটবেলা থেকে ঠিক তা-ই। সব ধরনের বই পড়েন, তবে ভ্রমণবিষয়ক বইয়ে ঝোঁক একটু বেশিই। তা পাঠ্যবইয়ের ভ্রমণকাহিনি হোক কিংবা পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো ভ্রমণকাহিনি, বুঁদ হয়ে তিনি পড়েন সব।
লক্ষ্মীপুর জেলা সদরে তাঁদের বাড়ি। স্কুল-কলেজের পাঠটুকুও এ শহরেই নেওয়া। মাধ্যমিকে পড়ার সময় মাসুদ রানা সিরিজে ডুবেছিলেন। বই পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতেন অজানা কোনো দ্বীপে, রঙিন কোনো শহরে। নাজমুন নাহার বললেন, ‘আমার ভ্রমণ করার স্বপ্ন জাগে বই পড়েই। সৈয়দ মুজতবা আলীসহ দেশ-বিদেশের লেখকদের ভ্রমণবিষয়ক বইগুলো আমাকে ভ্রমণের উৎসাহ জুগিয়েছে।’
এখনো সেই উৎসাহ জোগাচ্ছে জ্যাক কেরুয়াকের অন দ্য রোড, এরিক উইনারের দ্য জিওগ্রাফি অব ব্লিস, সুজান রবার্টসের অলমোস্ট সামহোয়্যার: টোয়েন্টি–এইট ডেজ অন দ্য জন মেওর ট্রেইল, শেরিল স্ট্রেইডের ওয়াইল্ড: ফ্রম লস্ট টু ফাউন্ড অন দ্য প্যাসিফিক ক্রেস্ট ট্রেইলসহভ্রমণবিষয়ক ব্লগারদের লেখা।
তবে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন বাবা মোহাম্মদ আমীনের কাছে। কোনো বিষয়ে মেয়ে এক পা এগোলে বাবা এগিয়ে দিতেন আরও পাঁচ পা। তাই স্কুল থেকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে কাজ করেছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন জায়গা। বাবার সেই প্রেরণা সাহস জুগিয়েছে সব সময়। তাঁর বড় সাত ভাইবোনের সমর্থনও পেয়েছেন অকুণ্ঠ। বললেন, ‘শুধু স্বপ্ন দেখলেই তো হবে না, সেটা সত্যি করতে একটা কথা ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম। ভ্রমণ করতে হলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আমি সে চেষ্টাই করেছি।’
সে চেষ্টায় তিনি হয়তো সফলও। সুইডওয়াচসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন। রোজকার খরচ বাদে যা জমান, তা নিয়েই পা বাড়িয়েছেন নতুন কোনো দেশে। নাজমুন নাহার বললেন, ‘একসময় হয়তো আমার টাকা হবে। কিন্তু ঘুরে বেড়ানোর শক্তি কিংবা মন থাকবে না। তাই এখন আমি যতটুকু অর্থ সঞ্চয় করতে পারি, তা নিয়েই ঘুরে বেড়াই।’
তবে প্রথম দেশ ভ্রমণের গল্পটা ছিল অন্য রকম। কেমন সেটা?
পাঁচমারির স্মৃতিকথা
২০০০ সালের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন নাজমুন নাহার। বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য হিসেবে সুযোগ পেলেন আন্তর্জাতিক অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার। তাঁর নেতৃত্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল গেল ভারতে। বিশ্বের ৮০টি দেশের গার্লস গাইড আর স্কাউটদের এই সম্মেলন ছিল মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারিতে। কত রকম স্মৃতি জড়িয়ে প্রথম সেই বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গে। নাজমুন নাহার বললেন, ‘সে এক রোমাঞ্চকর মুহূর্ত ছিল। প্রথম বিদেশে যাওয়া বলে কথা। যাওয়ার আগে কত যে জল্পনা-কল্পনা করেছি। পাঁচমারিতে দারুণ সময় কেটেছিল আমাদের।’
সে-ই শুরু। তারপর সমুদ্র থেকে সমুদ্রে, পাহাড় থেকে পাহাড়ে, এক শহর থেকে আরেক শহরে শুধু ঘুরেই বেড়াচ্ছেন!
পরিচয় তাঁর বাংলাদেশি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে ঢাকায় চলে আসেন নাজমুন। কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন এক বিনোদন সাময়িকীতে। ২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে চলে যান সুইডেন। সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন। পড়াশোনার ফাঁকে খণ্ডকালীন কাজও করতেন তখন। কয়েক মাসের জমানো টাকায় জাহাজে ভ্রমণ করেন ফিনল্যান্ড। তারপরই শুরু হয় তাঁর ভ্রমণ অধ্যায়ের অন্য পর্ব।
এ পর্বে কখনো একা, কখনো বন্ধুদের সঙ্গে, কখনো কোনো সম্মেলনে অংশ নিতে চলে যান নতুন নতুন দেশে। তবে যেখানেই যান, লাল-সবুজের ছোট্ট একটা পতাকা সঙ্গেই থাকে। নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে পরিচয়ে নির্দ্বিধায় বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’
একলা চলো রে…
অধিকাংশ দেশে একাই ভ্রমণ করেছেন তিনি। কোনো দেশে গেলে থাকার জন্য বেছে নেন পর্যটকদের ইয়ুথ হোস্টেল। এসব হোস্টেলেই বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের সঙ্গে পরিচিত হন, তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়েন! এভাবে পৃথিবীর প্রকৃতিকে যেমন জেনেছেন, দেখেছেন, তেমনি ভিন্ন দেশের মানুষগুলোকেও কাছ থেকে জানার সুযোগ তাঁর হয়। তাঁদের সঙ্গেই কখনো দলে ভিড়ে চলে যান পাহাড় ডিঙাতে, সমুদ্র পেরোতে, এক শহর থেকে আরেক শহরে!
এখনো অনূঢ়া নাজমুন নাহার তাই একা ভ্রমণ করলেও কখনোই নিজেকে একা মনে করেন না। তিনি বললেন, ‘একা ভ্রমণ করেছি পথ হারিয়ে নতুন পথের সন্ধান পেতে, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে!’
মাকে নিয়ে ১৪ দেশ
ব্যবসায়ী বাবা আগেই গত হয়েছেন। তাই পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখে মাকে খুব মনে পড়ত তাঁর! মনে হতো, মাকেও যদি সঙ্গে নিতে পারতেন। সেই অনুভূতি থেকেই মা তাহেরা আমীনকে নিয়ে গেছেন সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালা থেকে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাকে সঙ্গে নিয়ে ১৪টি দেশ ভ্রমণ করেছেন!
ওদের জন্য ভ্রমণগল্প
‘ইনসপিরেশন গ্লোবাল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করতে যাচ্ছেন নাজমুন নাহার। এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন স্কুল ও অনাথ আশ্রমে যাবেন। বর্ণনা করবেন নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। বললেন, ‘অসহায় শিশুদের মানুষ খাবার দেয়, নতুন জামা দেয়। কিন্তু আমি তাদের স্বপ্ন দেখাতে চাই। পৃথিবী দেখার স্বপ্ন। নিজেকে বড় ভাবার স্বপ্ন। আমি ভ্রমণের সময় অনেক মানুষ পেয়েছি, যারা কষ্ট করে বড় হয়েছে। তাদের দৃষ্টান্ত আমি শিশুদের শোনাব।’ এ জন্য তিনি তথ্যচিত্রও বানাবেন। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের প্রায় আট হাজার ভিডিও ক্লিপ তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। তিনি চান এসব শিশুদের দেখালে তারা বাস্তব জ্ঞান পাবে।
৩৯-এ শত দেশ
শত দেশ ঘোরার মাইলফলক তিনি এ বছরই ছুঁতে চান। এ বছর তাঁর ৩৯ বছর পূর্ণ হবে, ৪০-এ পা দেবেন। এ নিয়ে আলাদা পরিকল্পনাও আছে তাঁর। তিনি চান আফ্রিকার কোনো দেশে শততম দেশ ভ্রমণ উদ্যাপন করতে। কেন? বললেন, ‘আফ্রিকার দেশগুলোয় আমি কম গিয়েছি। সব দিক বিবেচনায় এগিয়ে রাখছি দক্ষিণ আফ্রিকাকে।’
কবীর সুমন গেয়েছেন, ‘চল্লিশ পেরোলেই চালশে’। নাজমুন নাহারের স্বপ্ন চল্লিশের আগেই সেঞ্চুরি। চরৈবেতি চরৈবেতি।
তথ্যসুত্র: প্রথমআলো ডটকম।