বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার আগে একটা চিন্তাই শুধু মাথায় ছিল, বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এসে নতুন কিছু একটা করব। খুব খ্যাতনামা একজন অধ্যাপক আমাদের বলেছিলেন, গবেষণায় দেখ গেছে, গড়ে দুই-তৃতীয়াংশ পারিবারিক ব্যবসা প্রথম প্রজন্ম থেকে দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার পর দেউলিয়া হয়ে পড়ে। তাই তিনি কয়েকটি উপদেশ দিয়েছিলেন কীভাবে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়। তার মধ্যে প্রধান ছিল এই যে দ্বিতীয় প্রজন্মের উচিত পারতপক্ষে পারিবারিক ব্যবসায় সরাসরি না আসা। Join Somewhere else to learn & make mistakes (শেখা ও ভুলটুল করার জন্য অন্য কোথাও যোগ দাও), উনি বলেছিলেন। এবং তা না পারলে, ব্যবসায় সরাসরি আসতে চাইলে যেন যা প্রতিষ্ঠিত, সেখানে যোগ না দিয়ে নতুন কিছু করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে আমি একটা প্রজেক্ট করি জুতার কোম্পানি নিয়ে। তুলনা করি বিশ্বের তিনটি বিখ্যাত জুতার ব্র্যান্ড ও তাদের ভবিষ্যৎ। সেখান থেকেই হয়তো মুচি হওয়ার চেতনার জাগরণ। যা-ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় পাস করলাম ১৯৯০ সালের মে মাসে। বাবা বললেন, তোমাকে একটা চাকরির সন্ধান দিই। নতুন একটা কোম্পানি তৈরি করার সুযোগ। নতুন একটা ব্যবসা। বাংলাদেশে ১০০ শতাংশ রপ্তানিমুখী জুতার কারখানা। আমরা চামড়ার জুতা তৈরি করে বিদেশের বাজার জয় করব।
এক দশকের বেশি সময় ধরে আমরা বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত (Finished) চামড়া রপ্তানি করছি ইতালি, স্পেন, ব্রাজিল, হংকং, চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশের জুতার কারখানায়। সেখানে তারা আমাদের সেই উপকরণ দিয়ে সুন্দর জুতা তৈরি করছে। আমরা কেন পারব না? চামড়ার জুতা তৈরি করতে প্রয়োজন ভালো মানের চামড়া ও জনবল। এর দুটিই তো বাংলাদেশে আছে। আজ সেসব কথা ভাবলে মনে পড়ে সেই গানের প্রথম কলিটি: আগে যদি জানতাম…।
যা-ই হোক, দেশে ফিরে ১৯৯০ সালের ১ জুলাই কাজে যোগ দিলাম। আমার পারিশ্রমিক সাত হাজার টাকা। কারণ, থাকি বাবার হোটেলে; থাকা-খাওয়ার খরচ নেই। প্রথম সরাসরি বস হামিদ ভাই একজন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ব্যক্তি। পাঠালেন হাঁটুভাঙা থেকে ইট কিনতে এবং গাজীপুর থেকে ভিটি বালু কিনতে। এখান থেকে আমার হাতেখড়ি। তারপর কত অভিজ্ঞতা, কত শিক্ষা—বাংলাদেশের সরকারি ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার নিয়মকানুন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের হুমকি, শুল্ক বিভাগ থেকে মেশিন ছাড়ানোর কষ্ট, ভারত থেকে আগত মহাব্যবস্থাপকের মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ…আরও কত কিছু।
বাংলাদেশেরই খ্যাতনামা শিল্প স্থাপেত্যর (ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্কিটেক্ট) তৈরি কারখানায় আমরা শুরু করলাম জুতা তৈরির কাজ। জার্মানির অত্যাধুনিক মেশিন। বাংলাদেশের তৈরি চামড়া ও জুতা তৈরিতে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ ১৩০ জন নিয়ে আমরা প্রথম জুতা রপ্তানি করলাম বেলজিয়ামে। কিন্তু আমাদের পণ্য পৌঁছানোর পর সেখানকার শুল্ক বিভাগ মালামাল আটকে দিল। তাদের সন্দেহ, জুতা বলে নিশ্চয়ই অন্য কিছু পাচারের অপচেষ্টা—বাংলাদেশ আবার জুতা রপ্তানি করে কবে থেকে?
এক বছরের মধ্যেই জাপানিদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। আজও স্মরণ করি সেই দুই মহানায়ক মিউরা স্যান (Miura San) ও মিজুসি স্যানকে (Mizuse San), যাঁরা আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং যাঁরা বিশ্বাস করেছিলেন যে আমরা পারব। কিন্তু জাপানি বাজারের জন্য যে মান দরকার, তা আমরা কোনোভাবেই দিতে পারছিলাম না।
এরপর আমরা পেলাম আরেক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, ৬৫ বছর বয়সী গিনসবার্গ। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ, জুতার জাদুকর। তিনি হাত ধরে ধরে নয় মাস আমাদের শেখালেন। ধীরে ধীরে জাপানের বাজারে জায়গা করে নিলাম, সুফল পেলাম, অর্জন হলো।
কিন্তু তারপর নামল জাপানে অর্থনৈতিক ধস। আবার নতুন করে শুরু ১৯৯৪ সালে। এবার ইউরোপ আমাদের লক্ষ্য। অনেক বাধা অনেক প্রতিকূলতা। সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের নিজেদের অজ্ঞতা এবং বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতি আস্থার অভাব। অনেক ঘাটের পানি খাওয়ার পর এবার পেলাম আরেক বিশেষজ্ঞ ইতালিতে। শুরু হলো নতুন উদ্যমে কাজ। ১৯৯০ সালে ১৩০ জনের একটি কারখানায় যেখানে প্রতিদিন ১০০০ জোড়া জুতা তৈরি হতো, সেখানে এবার পাঁচ হাজার লোকের একটি নিবেদিত দল নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার জোড়া জুতা তৈরি করে পৃথিবীর প্রায় ৩০টি দেশের ১০০-র বেশি বিপণনকারীকে আমরা দেখিয়ে দিলাম, আমরাও পারি।
কেটে গেল ২৩টি বছর, যেন চোখের নিমেষে। ইতিমধ্যে প্রবেশ করলাম স্থানীয় বাজারে, বাংলাদেশের জুতার অনুরাগীদের মন জয়ের প্রচেষ্টা নিয়ে। আমরা সত্যিই বুঝতে পারিনি যে দেশের ক্রেতারাও আমাদের এত কাছে টেনে নিতে পারবেন এত সহজে। ২০১৩ সাল। এবার নতুন এক স্বপ্ন—নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটি ইচ্ছা। আর কত দিন বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীলতা! আর কত দিন আমাদের শুনতে হবে, আমরা পারব না! আমাদের ব্যবসাটা একটি ফ্যাশনসমৃদ্ধ (Fashion Driven) ব্যবসা। তাই পণ্যের ডিজাইন ও উন্নয়ন (Design & Development) আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; এক দশকের বেশি তা নিয়ন্ত্রণ করেছেন বিদেশিরা। এবার আমাদের পালা। দীর্ঘ পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগের ফলে সেই প্রচেষ্টাও সার্থক হলো।
আজ আধুনিক পণ্য প্রস্তুতের ক্ষেত্রে প্রধান তিনটি কৌশল অবলম্বন করে তিন ধরনের পণ্য তৈরি হতে পারে: ১. ওইএম (OEM: Original Equipment Manufacturing) ২. ওডিএম (ODM: Original Design Manufacturing) ৩. ব্র্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং (Brand Manufacturing)
প্রথমত, ওইএম-ব্যবস্থায় কারখানার নিজস্ব ডিজাইন করার কোনো অবকাশ নেই। ক্রেতারাই ঠিক করে দেন তাঁরা কী ডিজাইনের পণ্য কিনতে চান এবং কারখানা শুধু তৈরি করে দেয়। এটাই সবচেয়ে সহজ ও সর্বপ্রচলিত প্রথা। পণ্যের ডিজাইন ও উন্নয়ন (Design & Development) আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; এক দশকের বেশি তা নিয়ন্ত্রণ করেছেন বিদেশিরা। এবার আমাদের পালা। দীর্ঘ পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগের ফলে সেই প্রচেষ্টাও সার্থক হলো
দ্বিতীয়ত, ওডিএম-ব্যবস্থায় কারখানা নিজে বিশ্ববাজারের রুচি, চাহিদা ও ফ্যাশন বিবেচনা করে নির্ধারণ করে তারা কোন ডিজাইনের পণ্য তৈরি করবে। এটা ওইএম কৌশলের তুলনায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রয়োজন অনেক বেশি সক্ষমতা ও বাজার সম্পর্কে ধারণা। অ্যাপেক্স এক দশক ধরে এই সক্ষমতা ও ধারণা-জ্ঞান বিদেশিদের কাছ থেকে অর্জনে বিনিয়োগ করেছে এবং অবশেষে ২০১৩ সালে নিজের ভবিষ্যৎ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। আজ আর আমরা বসে থাকি না বিদেশিদের জন্য। আজ আমরাও পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই প্রক্রিয়া অবিরাম চালু রাখতে হবে। অতএব, এই জ্ঞান অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখা ও এর প্রয়োগ আমাদের জন্য অবশ্যকরণীয়।
আজ অ্যাপেক্স যেখানে পৌঁছেছে, তা তৈরি হয়েছে চারটি নীতিমালার ভিত্তিতে— প্রথমত, আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো আমাদের মানবসম্পদ। খেটে খাওয়া শ্রমিক আমাদের ওপর তাঁদের আস্থা রেখেছেন। যাঁরা হরতাল, অবরোধ, বন্যা উপেক্ষা করে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যাঁদের চাওয়া আমাদের কাছে মোটেও বেশি নয়—সময়মতো তাঁদের জন্য বাস্তবমুখী বেতন-ভাতা, তাঁদের আইনগত সুবিধা, নির্ধারিত ছুটি, একটি নিরাপদ সুন্দর কাজের পরিবেশ।
আমি মনে করি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া। দ্বিতীয় নীতি হচ্ছে পণ্যের মান নিশ্চিত করা এবং প্রতিমুহূর্তে তা বৃদ্ধি করার একটি সংস্কৃতি তৈরি করা। তৃতীয়ত, আমাদের কাজের পরিধি, বিশেষ করে কারখানাগুলোয়, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট আইন মেনে চলা এবং আমাদের, তথা জুতাশিল্পে সেরা অনুশীলন অনুসরণ করা, আমরা যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে উন্নত পরিবেশের চাহিদা পূরণে সক্ষম বা কমপ্লায়েন্ট হতে পারি। এই প্রক্রিয়া একটি অব্যাহত যাত্রা এবং প্রতিটি মুহূর্তে আমরা প্রতিযোগিতায় কীভাবে এগিয়ে থাকতে পারি, তা নিয়ে চিন্তা করা।
চতুর্থত, আমাদের কথা রাখা। তা ব্যাংকের লোন সময়মতো পরিশোধ হোক, ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হোক অথবা আমাদের ওপর আস্থা রেখে যাঁরা আমাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগকারী হিসেবে যোগদান করেছেন, তাঁদের ব্যাপারেই হোক। সর্বক্ষেত্রে আমরা কথা রাখার চেষ্টা করেছি এবং করে যাব।
এর মানে এই নয় যে আমাদের ভুল হয়নি বা আমাদের ব্যর্থতা নেই। আজ যতটুকু আমাদের অর্জন, তা সম্ভব হয়েছে। কারণ, অনেক ভুল, বাধা-বিপত্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি আরও ভালো করতে বা অন্তত একই ভুল আবার না করতে। আমার খুবই প্রিয় বেনজামিন ফ্র্যাংকলিনের একটি প্রবাদতুল্য কথা, ‘জিনিয়াস ইজ ওয়ান পারসেন্ট ইনস্পিরেশন অ্যান্ড নাইনটি নাইন পারসেন্ট পারস্পিরেশন’ (প্রতিভা হলো ১ শতাংশ অনুপ্রেরণা ও ৯৯ শতাংশ ঘাম ঝরানো শ্রম)। বাংলাদেশে জুতোশিল্পে যতখানি অ্যাপেক্স অর্জন করেছে, তার পেছনে আছে আমাদের এই অতুলনীয় পাঁচ হাজার নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর শরীরের ঘাম ও সীমাহীন ত্যাগ।
আর অ্যাপেক্সে রয়েছে আমাদের সবার সেই ১ শতাংশ অনুপ্রেরণার উৎস, এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের বিশেষ ছোঁয়া। যিনি দীর্ঘ ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর নীতির সঙ্গে আপস করেননি। যিনি সত্যিকার অর্থে পেশাদারত্বে বিশ্বাস করেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক সহকর্মীর উন্নতি ও আত্মপ্রকাশ দেখতে চান। যিনি আমাদের সাহস জোগান, অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দেন, যেন আমরা আরও এগিয়ে যাই।
মাঝেমধ্যে যখন আমাদের সমাজের চারপাশে দেখি মূল্যবোধের অবক্ষয়, অনেকেরই যেন যেকোনো মূল্যে যেকোনো উপায় অবলম্বন করে কোটিপতি হওয়ার চেষ্টা ও হয়ে যাওয়া, তখন তাঁর এই উদাহরণ আমাদের খুবই প্রয়োজন যে বাংলাদেশে সততা ও নীতির সঙ্গে ব্যবসা করে টিকে থাকা যায় এবং লাভজনক হওয়া যায়। মানুষের ভালোবাসা, সমর্থন ও সম্মান অর্জন টাকা বা প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না।
তিনি হচ্ছেন আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও আমার বাবা সৈয়দ মনজুর এলাহী। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে আমরা পারব। আমাদের পারতে হবে। সৈয়দ নাসিম মনজুর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।