যাঁকে ঘিরে আমার যাপিত জীবনের যাবতীয় ছন্দময়তা, যাঁর অনুপম জীবনদর্শন আমার চেতনায় ও মননে লালিত—তিনি আমার মা, আমার মহীয়সী জননী। পাঠকদের জন্য মায়ের কথাই লিখেছেন, উদ্যোক্তা রাজীব প্রসাদ সাহা।
আমার মায়ের জন্ম সিলেটের এক নামকরা পরিবারে, ১৯৫০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। তাঁর বাবা বিমলেন্দু দাস (সিলেট পৌরসভার একসময়ের নির্বাচিত চেয়ারম্যান) ও মা অরুণিমা দাসের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি প্রথম। একান্নবর্তী পরিবার। তাঁরা আদর করে আমার মায়ের নাম রেখেছিলেন শ্রীমতী। সিলেট শহরের শেখঘাট এলাকার অভিজাত লাল ব্রাদার্স হাউসের আঙিনায় গুটি গুটি পায়ে হাঁটা, সবার আদরে একটু একটু করে বড় হওয়া, বড় হতে না হতেই সে সময়ের প্রচলনে শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হওয়া—আমার মায়ের সম্পর্কে সবকিছু ভাবতেই আমি নস্টালজিক হয়ে উঠি। ১৯৬৭ সালের ১১ মে বাবা-মা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মায়ের জীবন চলার পথে—পথের বাধা পেরোনোর অসীম সাহস, ঋজুতা ও রুচি-স্নিগ্ধ সক্ষমতা আমাকে ঋদ্ধ করে।
১৯৭১ সাল। সবে বছর চারেকের বিবাহিত জীবন। আমার পিতা ভবানী প্রসাদ সাহার সঙ্গে কৈশোরের ভাবালুতা ও বাস্তব জীবনের সফল যোজনার স্বপ্নময় সময় পার করছেন আমার মা।
আমার পিতামহ রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা (আর পি সাহা) ১৯৩০-এর দশকে নারীশিক্ষা ও স্বাবলম্বন এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য তাঁর মায়ের নামে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট গঠন করেন। ট্রাস্ট এক মা-হারা বালকের জীবনচরিত। মাটি ও মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে দেশভাগের সময় আর পি সাহা চলমান স্রোতের বিপরীতে ওপার বাংলার প্রভূত সম্পদ রেখে এপার বাংলার পিতৃভূমিতে চলে আসেন। এহেন দেশপ্রেমিক মানুষ আমার পিতামহ ও পিতাকে ট্রাস্টের নারায়ণগঞ্জ প্রধান কার্যালয় থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দালালরা অপহরণ করে। তাঁদের আর আমরা খুঁজে পাইনি।
আমার বয়স তখন সবে তিন। আমি পিতৃহারা হলাম। এরপর থেকে আমার মা আমার সব প্রাপ্তি ও চেতনার উৎস। আমি চোখ বুজলে এখনো কল্পনার হানাদারদের অপস্রিয়মাণ বুটের শব্দ শুনতে পাই। মায়ের অসহনীয় অতলান্তিক চাপা কষ্ট মানুষ হিসেবে আমাকে অসহায় করে। আমার স্কুলপড়ুয়া মা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর সফলভাবে ছাত্রজীবন শেষ করেন। মায়ের শিক্ষা, প্রতীতি, অভীপ্সা, চেতনা, ‘মানুষের জন্য মানুষ’—এ মহামন্ত্র যা শয়নে–জাগরণে আমার মা আমার মধ্যে অতি যত্নে গেঁথেছেন, সেটি আমাকে সতত তাড়িত করে।
এ সময়ে আমার পিতামহ ও পিতার অবর্তমানে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে মিসেস জয়াপতি (ছোট পিসি) কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের কর্মভার গ্রহণ করেন এবং জীবনের মায়া ত্যাগ করে ট্রাস্টের সেবা কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন।
আমার পিতামহ রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা ও পিতামহী কিরণ বালা সাহা আমার মাকে মা সম্বোধন করতেন। তাঁদের সাহচর্যে আমার মা কুমুদিনী পরিবারের অন্যতম চালিকা শক্তি হয়ে ওঠেন। পড়াশোনার পাশাপাশি আমার ছোট পিসির সার্বিক সহযোগিতায় তিনি ১৯৭৪ সালে মাত্র ১০-১৫ জন দুস্থ নারীকে নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাফট প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থাটি সম্প্রসারিত হয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগী, ক্ষতিগ্রস্ত মা–বোনসহ দুস্থ নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ইতিমধ্যে মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ট্রাস্টের পরিচালকের গুরুভার গ্রহণ করেন। সেবাধর্ম পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি তাঁর পরিজনদের, পরিবারের সব সদস্যের সুবিধা-অসুবিধার পরম আশ্রয়স্থল। শোকে মুহ্যমান শাশুড়ির সেবাযত্ন করেছেন নিজ হাতে। কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মির্জাপুরে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস্, কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ, কুমুদিনী নার্সিং স্কুল ও কলেজ এবং নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রণদাপ্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মীরা তাঁদের কষ্ট লাঘব কিংবা শিক্ষালাভের প্রেরণা ও কর্মোদ্দীপনা খুঁজে ফেরেন আমার মায়ের মমতাময়ী সাহচর্যে। তিনি ট্রাস্টের তথা কুমুদিনী পরিবারের কর্মী ও সেবা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের কাছে ভরসা ও নিরাপত্তার প্রতীক। তিনি নিজের অজান্তেই কুমুদিনী পরিবারের মা রূপে বরিত হয়েছেন সবার অলক্ষ্যে।
প্রচারবিমুখ আমার মা তাঁর প্রশান্তি ও আত্মতৃপ্তি খুঁজে ফেরেন আর্তপীড়িতের সেবায়, নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষায়। মায়ের শিক্ষা, শাসন, স্নেহ-পরামর্শ, ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আমার পাথেয়। এটি এক বালিকার নিজেকে গড়ে তোলা ও মানবতার সেবায় উৎসর্গ করার অনন্য সংগ্রামী উপাখ্যান। সেবার মহামন্ত্রে বলীয়ান বিশাল কুমুদিনী পরিবারের কর্মযোজনায় এখন তিনি প্রেরণার উৎস।
জীবনযুদ্ধে নিয়তির কঠোরতাকে ধারণ করে জীবনকে অর্থময় করা ও প্রজন্মান্তরে সঞ্চালিত করার তাঁর অদম্য প্রাণশক্তি আমাকে শক্তি জোগায়, গর্বিত করে। দুঃখময়তাকে অবলীলায় ধারণ করে মায়ের সদা প্রেরণাময় হাসি আমাকে নির্ভার করে। আমার মা আমার অহংকার।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট
তথ্যসূত্র: প্রথমআলো ডটকম।