রকেট নির্মাণপ্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক। টেসলা, পেপ্যালসহ আরও বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। গত ফেব্রুয়ারিতে স্পেসএক্সের তৈরি রকেট ফ্যালকন হেভির সফল উৎক্ষেপণের পর তুমুল আলোচিত হয়েছেন তিনি। পড়ুন তাঁর সাফল্যের সূত্র
১. স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান সমালোচনা
চাকরি বা ব্যবসা—আপনি যা-ই করেন না কেন, নিশ্চয়ই কোনো না কোনো পণ্য তৈরি করছেন। আপনার পণ্যটাকে নিখুঁত করতে হলে মানুষের প্রতিক্রিয়া জানা প্রয়োজন। দুর্বল লোকেরা সমালোচনায় হতাশ হয়ে পড়েন। আর মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা সমালোচনাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে উন্নত করেন। মানুষের প্রতিক্রিয়া তাঁরা মন দিয়ে শোনেন। বোঝার চেষ্টা করেন, এই প্রতিক্রিয়ার কতখানি সত্য। ভাবেন, কোথায় কোথায় নিজেকে আরও উন্নত করা যায়। এই বিশ্বাস থেকেই সমালোচনাকে ভালোবাসেন ইলন মাস্ক। তিনি বলেন, ‘আপনি যা-ই করেন না কেন, একজন সুবিবেচকের সমালোচনা আপনার কাছে স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান।’ বটে, সমালোচকেরাই তো আপনার ভুল ধরিয়ে দেবে!
২. হার মানতে নেই
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টিভি চ্যানেল সিবিএসের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে ইলন মাস্কের কথোপকথনের একটি অংশ শুনুন। আপনি যখন পরপর তিনবার ব্যর্থ হলেন, হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি? কখনো না। কেন? আমি কখনোই হার মানিনি। মৃত্যু এলে কিংবা একেবারে অক্ষম হয়ে গেলে তবেই কেবল আমি হার মানব। ইলন মাস্কের কথা যে কেবল কথার কথা নয়, তাঁর পেছনের দিনগুলোতে তাকালেই বোঝা যায়। স্পেসএক্স থেকে ফ্যালকন ১ নামের রকেটটি উৎক্ষেপণ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হাল ছাড়েননি।
৩. প্রচারের চেয়ে উন্নয়ন জরুরি
অনেকে প্রতিষ্ঠান প্রচারের জন্য যত টাকা ব্যয় করে, পণ্যের মান উন্নয়নের জন্য ততটা ব্যয় করতে আগ্রহী হয় না। টেসলা সম্পর্কে মাস্কের বক্তব্য, তারা কখনোই বিজ্ঞাপনের জন্য তেমন খরচ করেনি, যতটা পণ্যের উন্নয়নের জন্য করেছে। এই মনোভাব শুধু যে সময়, শক্তি ও অর্থ বাঁচায় তা নয়, দ্রুত সামনে এগোতেও সাহায্য করে। মাস্ক বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠান দ্বিধায় পড়ে যায়। তারা এমন সব খাতে টাকা ব্যয় করে, যেগুলো তাদের উৎপাদনকে উন্নত করে না।’ এমন ব্যয় মোটেও কোনো কাজের নয় বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা।
৪. জীবন হোক রোমাঞ্চকর
ইলন মনে করেন, জীবনটা খুব ছোট। আপনি যে কাজটা পছন্দ করেন না, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই একই কাজ করার কোনো মানে হয় না। বেরিয়ে পড়ুন, পাহাড়ে চড়ুন, বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান…রোমাঞ্চ উপভোগ করুন। আপনি তো রোবট নন। ইলন বলেন, ‘মঙ্গলে বসতি গড়ার কল্পনা আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে। প্রতিদিন কিছু সমস্যা সমাধানের চাইতে জীবনটা অনেক বড়। অতএব, জেগে উঠুন আর ভবিষ্যতের কল্পনায় রোমাঞ্চিত হোন।’
৫. যতটা সম্ভব পরিশ্রম করুন
পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। হোক সেটা মানসিক কিংবা শারীরিক—একমাত্র পরিশ্রমের মাধ্যমেই আপনি সফলতা অর্জন করতে পারেন। পরিশ্রম প্রসঙ্গে ইলন মাস্ক বলেন, ‘কেউ সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করছে আর আপনি হয়তো ১০০ ঘণ্টা কাজ করছেন। আপনারা দুজন হয়তো একই কাজ করছেন। নিশ্চিত থাকুন, অন্য মানুষটি যেটা এক বছরে অর্জন করবে, সেটা আপনি মাত্র চার মাসেই অর্জন করতে পারবেন।’ তবে কাজের সঙ্গে শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা থাকাটাও প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন তিনি।
৬. ভালোবাসার ক্ষেত্রটিতেই কাজ করুন
ইলন মাস্ক বলেন, যে কাজটি আপনি করছেন সেটাকে ভালোবাসা খুব জরুরি। যদি তা না হয়, তাহলে মনে হবে, আপনি নিজের ওপর জোর খাটাচ্ছেন। এভাবে হয়তো কিছুদিন চলতে পারবেন। কিন্তু যখন কঠিন সময় আসবে, তখন আর সামলাতে পারবেন না। অতএব, সেই কাজই বেছে নিন, যেটা আপনি সহজাতভাবেই পছন্দ করেন। হোক সেটা গান, গণিত কিংবা মহাকাশবিদ্যা। অনেকেই নিজের ভালো লাগার জায়গাটা ধরতে পারেন না। দ্বিধায় ভোগেন। এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরুন, লক্ষ করুন, কোন কাজটিতে আপনি সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছেন। নিজেকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন। শিগগিরই পছন্দের জায়গাটা ধরতে পারবেন। ইলন বলেন, ‘যদি আপনি কাজটাকে ভালোবাসেন, তাহলে নিশ্চয়ই কাজের সময় ছাড়াও আপনি এটা নিয়ে ভাববেন। আপনার মস্তিষ্ক এই ভাবনার সঙ্গে অভ্যস্ত। আর যদি পছন্দ না করেন, জোর করে এটা সম্ভব নয়।’
৭. ঝুঁকি নিন
ঝুঁকি নেওয়ার কথা সম্ভবত তাঁর মুখেই সবচেয়ে ভালো মানায়! বারবার ঘুরেছে তাঁর জীবনের মোড়। জিপ টু বিক্রি করে তিনি এক্স ডটকম শুরু করেছেন, পেপ্যালের মতো একটা সফল প্রতিষ্ঠানে নিজের শেয়ারের অংশটা বিক্রি করে দিয়ে তিনি স্পেসএক্সের পেছনে লগ্নি করেছেন। ইলন বলেন, ‘কোনো কিছু করা দরকার মনে হলে প্রতিকূল পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হলেও আপনি সেটা করবেন।’ হ্যাঁ, পুরো ব্যাপারটিই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তবে জীবনে কিছু পেতে হলে ঝুঁকি তো নিতেই হবে!
৮. ‘হোমওয়ার্ক’ জরুরি
বিচিত্র সব খাতে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন ইলন মাস্ক। বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। কিন্তু তাঁর এই সাফল্যের রহস্যটা কী? রহস্য হলো, প্রস্তুতি না নিয়ে তিনি মাঠে নামেন না। তিনি যখন মহাকাশ ও অ্যারোনটিকসের দুনিয়ায় পা রাখলেন, অনেক শিল্পপতি ধরে নিয়েছিলেন, শখের বশেই হয়তো এই খাতে টাকাগুলো খরচ করছেন তিনি। কদিন পর নিশ্চয়ই ব্যর্থ হবেন। ভুল। নিজের লক্ষ্য ঠিক না করে ইলন পা বাড়াননি।
৯. মরিয়া হয়ে লড়াই করুন
আপনার কাছে ১০০ টাকা আছে, আপনি আজকের দিনের খাবার কিনতে পারবেন। কিন্তু তাই বলে আপনার কি বসে থাকাটা উচিত? ইলন মাস্ক সেটা একেবারেই মনে করেন না। অনেক কিছু থাকতেই পারে হাতে, হতে পারে কাজ করার খুব বেশি তাড়া নেই। তবে তাই বলে ধীরে-সুস্থে কাজ করা থেকে বিরত থাকুন আর মরিয়া হয়ে কাজ করুন। লড়াই করুন নিজের সঙ্গে! নিজের সেরাটা বের করে আনুন।
১০. পড়তে হবে
বিখ্যাত মানুষেরা সব সময়ই পড়ার ওপর জোর দেন। ইলন মাস্কও ব্যতিক্রম নন। ইলনের বয়স যখন নয় বছর, তখন তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পুরোটা পড়ে ফেলেছিলেন! সে সময় বিজ্ঞান কল্পকাহিনি পড়ে গড়ে ১০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতেন। আজ সেই মানুষটির হাত ধরেই মঙ্গলে বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছে মানুষ। ভার্জ ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমার ছোট্ট লাইব্রেরিতে মহাকাশ-সম্পর্কিত যত বই আছে, সব আমি পড়েছি।’
গ্রন্থনা: সাদিয়া ইসলাম,
সূত্র: এন্ট্রাপ্রেনার ডটকম