আয়রন ম্যান! রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে পরিচয় করিয়ে দিতে এই একটি নামই যথেষ্ট। মাদক, নেশা, মামলা, কারাদণ্ড—এই সব থেকে বেরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। উঠে এসেছেন সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতাদের তালিকার শীর্ষে। সিনেমার দুনিয়ায় মার্ভেল কমিকসের সুপারহিরোদের যে বাহাদুরি, ২০০৮ সালে তার শুরুটা করেছিলেন এই ডাউনিই। তবে পর্দার বাইরে তিনি সুপারহিরো নন, সাধারণ মানুষ হতে চান। পড়ুন এই ‘সাধারণ মানুষের’ অসাধারণ জীবনবোধ
আমার জীবন বদলে দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপদেশ কী ছিল জানো? ‘কিছু একটা করে খাও।’ একদিন রাস্তার ফোন বুথ থেকে বাবাকে (অভিনেতা ও চলচ্চিত্রনির্মাতা রবার্ট ডাউনি সিনিয়র) ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘খিদে পেয়েছে। বাসের টোকেন নেই। আমি কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। বন্ধুরা আমার ফোন ধরছে না।’ ওপাশ থেকে তখন বাবা বললেন, ‘উফ, কিছু একটা করে খাও।’
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তিনি আমাকে এমন সহজভাবে এত কঠিন কথা বলে দিলেন! আমি ভেবেছিলাম সন্তান বলে হয়তো একটু অপরাধবোধ কাজ করবে তাঁর মনে। ভেবেছিলাম, মায়া করে অন্তত ৫-১০ ডলার পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি নির্দয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘বন্ধুদের ডাকো।’
আমি অসহায় হয়ে বললাম, ‘আমি ডেকেছিলাম তাদের। পাইনি।’-তাহলে কাজ খোঁজো। কাজ করো। -বাবা, এক্ষুনি আমাকে এক স্লাইস পিৎজা খাওয়ার পয়সা দেবে, এমন চাকরি আমি কোথায় পাব? আমি ক্ষুধার্ত।’ -‘অনেক হয়েছে। রাখি।’
রাগ উঠেছিল তখন। কিন্তু জানো, তখন আমি কী করলাম? সত্যিই কাজের খোঁজ করলাম, আর পেয়েও গেলাম। পরের ফোনটাই আমি করেছিলাম এক আইরিশ মেয়েকে, যার বাবা সেদিনই শহরের বাইরে গিয়েছিলেন। মেয়েটিকে দেখে রাখার জন্য লোক দরকার ছিল। সেখানে গিয়েই আমার কপালে কাজ, খাবার আর কিছু অর্থ জুটল।
আমি চাই না, এমন অভিজ্ঞতা আমার শত্রুরও হোক। কিন্তু সত্যি বলতে কি, মাঝেমধ্যে জীবনে এমন হোঁচট খাওয়া খুব জরুরি। ভালো কথা, উঠতি বয়সে এমন দু-একটা গলাধাক্কা আর হোঁচট খেয়ে আবার এটা ভেবে বোসো না যে, খুব বিশাল কিছু হয়ে গেল। আমি মনে করি মানুষের জীবনে এমন কিছু ক্ষত, এমন কিছু অভিজ্ঞতা থাকতে হয়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোপন কোনো অধ্যায়ের মতো নিজের মনে সামলে রাখা যায়। সেই গোপন গল্পটাই জীবনে নতুন নতুন অধ্যায় পার করতে অনেক সাহায্য করে।
বাবার কথাই আবার বলি। আমি আমার বাবার কাছ থেকে আত্মসমর্পণ না করার গুণটা পেয়েছি। একটা সময় ছিল, যখন তিনি চাইলেই গতানুগতিক ধারার সামনে সমঝোতার মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে পারতেন। সফল হওয়ার জন্য, খ্যাতির জন্য, বড় একটা বাড়ির জন্য একদম গতানুগতিক ধারার ছবি বানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি আত্মসমর্পণ করেননি।
আমার সামনেও এমন সময় এসেছিল; যা আমাকে একটা ভিন্ন প্রজন্ম, ভিন্ন পথে আপস না করে চলার সাহস দিয়েছে। তা ছাড়া আমিও বাবার মতো এখন পরিচালনা নিয়ে ভাবছি। মোদ্দা কথা, তুমি যদি তোমার চিন্তার বীজকে আত্মসমর্পণ না করে কোনো বাধা ছাড়া বাড়তে দাও, তাহলে তোমাকে আর কেউ থামাতে পারবে না।
এখন অনেকেই হয়তো বলতে পারো, নেশায় না থাকলে সৃষ্টিশীল চিন্তা আসে নাকি? মাদক আর সৃষ্টিশীলতাকে তোমরা একসঙ্গে মেলাচ্ছ? ঘোড়ার ডিম! আমি নিজেকে কখনো এই মিথ্যাটা বলতে পারি না। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জানি। এখন আমি উপদেশের ঝুলি খুলে বসব না। দেখো, চাইলেই দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এসব করে সময় নষ্ট করা যায়। সেই সময় থেকে বেরিয়ে আসতেও আবার লেগে যায় অনেক বছর।
কিন্তু এটাও সত্য যে, একটা সময় ‘ইগো’ (অহংবোধকে) ব্যাপারটা আমাদের শোধরাতে দেয় না। কিছু মানুষ আছে, এসেই বলে ‘আমি তোমার জীবনকে বদলে দিতে চাই’ কিংবা ‘আমি তোমার জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছি।’ এসব শুনতে কিন্তু অসহ্য লাগে। মাদক থেকে বেরোনোর জন্য এসব কথায় কাজ হয় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তুমি নিজেই নিজের ইগোকে প্রশ্ন করছ যে, ‘আসলেই কি এটা ঠিক হচ্ছে?’
আমি জীবনের সেই ধাপটা পেরিয়ে এসেছি। আমাকে কেউ সরাসরি উপদেশ দিতে এলে খুব অসহ্য লাগত। ঈশ্বরের কৃপায় কেউ আমাকে তেমন বিজ্ঞ উপদেশ কখনো দেয়নি। তবে মেল গিবসনের (অভিনেতা) কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি যখন কিছুতেই নিজেকে শোধরাতে পারছিলাম না, তখন সে আমাকে বলেছিল, ‘হাল ছেড়ো না, নিজের ওপর নিজের আস্থাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করো।
তুমি পথ খুঁজে পাবে।’ সে কথায় কথায় আমাকে নিজের কিংবা অন্য কারও শুধরে যাওয়ার গল্প শোনায়নি, মহান কারও দৃষ্টান্তও দেখায়নি। আমাকে যখন মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে কেউ কাজে নিচ্ছিল না, তখন সে শুধু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার ছবিতে আমাকে কাজ দিয়েছে। তার জন্য যে ছবির গল্প লেখা হয়েছিল, সেখানে আমাকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে অভিনয় করিয়েছে। আমার মাথার ওপরের ছায়া হয়েছে।
আমি যখন ক্ষুধার্ত ছিলাম, তখন টেবিল ভরিয়ে দিয়েছে খাবারে। সে আমাকে বুঝিয়েছে যে, নিজের ভুলগুলোর দায় মাথায় নিয়ে আমি যদি আমার আত্মার কালো অংশটাকে গ্রহণ করে নিতে পারি আর নিজের ত্রুটিগুলো মেনে নিয়েই শুদ্ধ পথে চলতে পারি, তাহলেই একদিন মানুষ হতে পারব। মেলের ভাষায়, ‘মনের ক্যাকটাসগুলোকে জড়িয়ে ধরে রাখো।’ কষ্ট হবে, কিন্তু তুমি একদিন সত্যিই মানুষ হয়ে যাবে। সত্যকে মেনে নাও।
আমি মেলের সেই কথা শুনেছিলাম। সে এই ‘ক্যাকটাস’ উপদেশের বিনিময়ে আমার কাছে কী চেয়েছিল জানো? আমি শুধরে গেলে এই বার্তাটা যেন অন্যদের জানাই। এসব বলে কিন্তু আমি কারও চোখে নায়ক বা মহামানব হতে চাইছি না। আমি আমার সন্তানদের দৃষ্টিতেও কখনো নায়কের (হিরো) অবতার নিতে চাই না। আমি একটা স্বাভাবিক মানুষের চরিত্রই বাস্তবে ধারণ করতে চাই।
সাধারণ হওয়াটাই অনেক কঠিন। প্রত্যেক বাবাই একটি মহানুভবতার ছায়া দাঁড় করিয়ে দেন সন্তানদের সামনে। জানো? সেটাই না সবচেয়ে হতাশাজনক। আজীবন আমরা সেই ছায়াতেই নিজের ছায়াকে খাপ খাওয়ানোর আশায় দৌড়াতে থাকি। সেটা করতে করতে বুঝতেই পারি না যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবন আসলে এই ছায়ার পেছনে দৌড়ানোর চেয়েও কঠিন।
আমরা সেই কঠিন সময়টার জন্য নিজেকে তৈরিই করি না। তাই আমি বলব, মানবজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে ‘হিরো’ বিষয়টা একদমই যায় না। আমরা সবাই ‘নায়কসুলভ’ কিছু না কিছু করেই থাকি। আমার কাছে হিরো কোনো বিশেষ্য নয়, এটা একটি ক্রিয়া। এসকোয়ার ম্যাগাজিন ও ফোর্বস অবলম্বনে তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।