দিনে চাকরি আর রাতে কম্পিউটারে ক্রেতা খোঁজা। চার-পাঁচ মাস ধরে এভাবেই চলছে জীবনের ঘড়ি। ভাগ্যের শিকে কিছুতেই ছিঁড়ছে না। রাত সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎই একদিন নেদারল্যান্ডসের এক ক্রেতার ই-মেইল, ‘কাল সকাল নয়টায় কি গুলশানে আমার সঙ্গে হোটেলে দেখা করতে পারবে?’
ঘটনা সতেরো বছর আগের। চট্টগ্রামের রাতের সব বাস ততক্ষণে ঢাকার উদ্দেশে বেরিয়ে গেছে। যাব কি যাব না, কীভাবে যাব—ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাত ১১টার দিকে মহাসড়কে এসে চালককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে উঠে পড়লেন পণ্যবাহী এক ট্রাকে। ভোরে ঢাকায়, সোজা হোটেলের অভ্যর্থনাকক্ষে।
ক্রেতা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখলেন, পুঁচকে এক ছোকরা। নাহ্, একে দিয়ে হবে না—এমন মনোভাব নিয়ে নাশতা খাইয়ে বিদায় করে দিতে চাইলেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা তরুণটি অকপটেই বললেন, ‘আমার কোনো কারখানা নেই, কিন্তু আত্মবিশ্বাস আছে। অন্তত একটি নমুনা বানানোর সুযোগ আমাকে দিন।’ ২৩ বছরের তরুণের সেই আত্মবিশ্বাস দেখে কিছুটা সদয় হলেন বিদেশি সেই ক্রেতা। টেবিলে একটি জিনস ট্রাউজার রেখে বললেন শিগগিরই নমুনা বানিয়ে পাঠিয়ে দিতে।
দারুণ খুশিতে চট্টগ্রামে চলে এলেন ওই তরুণ। কিন্তু কোনো কারখানাই যে নমুনা বানাতে চাইছে না। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না এই ছোকরাকে। অগত্যা একটি সেলাইমেশিন ভাড়া করে পাহাড়তলীতে বাবার ছোট দোকানে এলেন। চেনা এক কারিগরকে দিয়ে নমুনা তৈরি হলো। সেই নমুনা দেখে চলে এল ৩ হাজার জিনস তৈরির কাজ।
সেদিনের ২৩ বছরের যুবক চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন। তাঁর ব্যবসার অংশীদার নেদারল্যান্ডসের সেই ক্রেতা এগবার্ট বোভেনহুইস। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামের মতোই মোস্তাফিজ সত্যিকারের ডেনিম বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। ব্লুএক্সঅনলি নামে নিজস্ব ব্র্যান্ডের জিনস রপ্তানি করছেন বিদেশে। একটি উদ্ভাবনীকেন্দ্রও করেছেন, যেখানে প্রতিবছর হাজারখানেক নিত্যনতুন নকশার জিনস তৈরি হচ্ছে।
কিন্তু মোস্তাফিজ উদ্দিনের বিশেষত্ব অন্যত্র। চার বছর ধরে তিনি দেশের ভেতরে সফলভাবে আয়োজন করে চলেছেন আন্তর্জাতিক মানের একটি প্রদর্শনী। সেটির পোশাকি নাম ডেনিম এক্সপো। অলাভজনক এই প্রদর্শনীর জন্য ক্রেতাদের টানতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রেতা-প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে যান। বিশ্বের বড় বড় প্রদর্শনীতে অংশ নেন কপালে লাল-সবুজ পতাকা বেঁধে।
মোস্তাফিজের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড গত বছর ১ কোটি ৭০ লাখ ডলারের জিনস রপ্তানি করেছে, দেশীয় মুদ্রায় যা ১৩৬ কোটি টাকার সমান। ১৯৯৯ সালে ঘটনাচক্রে একটি বায়িং হাউসে মোস্তাফিজ চাকরি শুরু করেছিলেন ৩ হাজার টাকা বেতনে। ১৯৯৮ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করে দেশে ফেরার সময় তাঁর স্বপ্ন ছিল বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার। যা হোক, চাকরিটি একসময় ছেড়েও দেন। তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ব্যবসা করবেন। চাইলেই তো সব হয় না। ১২ বছর বয়সে বাবা মারা গেছেন। মায়ের পীড়াপীড়িতে চাকরি খুঁজতে নামলেন। রাতে চলল কম্পিউটারে বসে ক্রেতা খোঁজা।
পাহাড়তলীতে বাবার দোকানেই মোস্তাফিজ প্রতিষ্ঠা করলেন এমএএস ইন্টারন্যাশনাল নামের বায়িং হাউস, সাতজন তরুণকে নিয়ে। জিনসের ক্রয়াদেশ আসছে। বিভিন্ন কারখানায় তৈরি হয়ে চলে যাচ্ছে। সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়লেও জায়গা কিনে কারখানা করার মতো যথেষ্ট নয়। শেষে এগবার্টকে ব্যবসায়িক অংশীদার করলেন। তত দিনে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে কর্ণফুলী ইপিজেড হয়েছে।
খোঁজখবর নিয়ে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) ঢাকা কার্যালয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করলেন মোস্তাফিজ। কিন্তু কেউ পাত্তা দেন না। নাছোড়বান্দা মোস্তাফিজ কর্মকর্তাদের পিছু পিছু ঘোরেন। একদিন বেপজার চেয়ারম্যানের নজরে পড়ে কপাল খুলে গেল। কারখানা করার জন্য একসঙ্গে পাঁচটি প্লট পেলেন।
কারখানা নির্মাণে শুরু থেকেই শ্রমিকের নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। দোতলা মূল কারখানা ভবন ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয়। জিনসের কারখানায় প্রক্ষালন (ওয়াশিং) খুব গুরুত্বপূর্ণ। এতে প্রচুর পানি দরকার। ভবনের সামনের পার্কিংয়ের নিচের পুরো অংশজুড়ে গড়ে তুললেন বিশাল পানির ট্যাংক। ৩ কোটি ২০ লাখ গ্যালন পানি তাতে ধরে রাখা যায়। ধরে রাখা হয় বৃষ্টির পানিও। এতে ২০ দিনের চাহিদা মেটানো সম্ভব। বয়লার ও রাসায়নিক গুদামের জন্য আলাদা ভবন। বর্জ্য পরিশোধনে আছে ইটিপি।
২০০৯ সালে পরীক্ষামূলক এবং পরের বছর পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয় ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডে। কারখানাটিতে শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। প্রাইমার্ক, জারা, ম্যাঙ্গোসহ আটটি ব্র্যান্ডের জন্য তাঁরা প্রতিদিন ১২ হাজার পিস জিনস তৈরি করেন। চলতি বছর তাঁদের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৯০ লাখ ডলারের জিনস রপ্তানি।
দেশে থাকলে প্রতিদিন সকাল নয়টার মধ্যে কারখানায় ঢুকে পড়েন কাজপাগল মোস্তাফিজ। দিনের বেশির ভাগ সময়ই তাঁর কাটে ওয়াশিং বিভাগে। সেখানকার শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে উদ্ভাবন করেন নতুন নতুন নকশার জিনস। কারখানার এই বিভাগই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। কেন? মোস্তাফিজ বলেন, ‘ওটাই আসল জায়গা। কারণ আমরা নিজেদের নকশায় জিনস উৎপাদন করি।’
মোস্তাফিজের কারখানার কিছু বিশেষত্ব আছে। নারী শ্রমিকেরা ছয় মাসের বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। ঈদে-পার্বণে শ্রমিকেরা পান নতুন জামা-কাপড়। শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য আছে বাসের ব্যবস্থা। অসুস্থ শ্রমিকেরা পান চিকিৎসা খরচ। নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুনদেরই বেশি প্রাধান্য দেন মোস্তাফিজ।
ব্যবসায় কিছুটা থিতু হতেই জার্মানি, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে নিজের নকশার জিনস নিয়ে হাজির হতে শুরু করেন মোস্তাফিজ। এসব প্রদর্শনীতে অংশ নিতে নিতেই তাঁর মাথায় আসে নতুন ভাবনা। দেশের ভেতরেই কি বিশ্বমানের ডেনিম প্রদর্শনী করা যায় না? তাহলে তো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বিদেশি ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরতে পারে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নতুন কিছু শিখতেও পারে। সেই থেকে শুরু ঢাকার ডেনিম এক্সপো।
২০১৪ সালের নভেম্বরে ঢাকার র্যাডিসন হোটেলে বাংলাদেশসহ ১৪ দেশের ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে প্রথম ডেনিম এক্সপো আয়োজন করলেন। এ বছরের মে মাস পর্যন্ত এর ছয়টি চমকপ্রদ আয়োজন হয়েছে। তবে ডেনিম এক্সপো নিয়েও মোস্তাফিজকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। প্রথম দিকে প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ জানাতে গেলে কেউ ঢুকতে দিত না। তখন তাঁরা ইউরোপে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে প্রচার-প্রচারণা ও আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করলেন। তাঁদের প্রতিনিধিদের বললেন ডেনিম এক্সপোতে অংশ নিতে। এতে কাজ হলো। ধীরে ধীরে জমতে শুরু করল প্রদর্শনী।
নকশায় নতুনত্ব ছাড়া জিনসের ব্যবসায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই বছর দেড়েক আগে মোস্তাফিজ ডেনিম ইনোভেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিয়োগ দিয়েছেন ২৫ জন তরুণকে। এ বছর সেখানে প্রায় ৯০০ নতুন নকশার জিনস তৈরি হয়েছে। অন্য কারখানাও এসব নকশা কিনে নিয়ে জিনস উৎপাদন করছে।
কারখানা প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড সাধারণত ৫ থেকে ৮ ডলারে জিনস তৈরি করত। এখন সেটি ৮ থেকে ১৬ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। এই উন্নতি হয়েছে নকশায় নতুনত্ব আনায়। মোস্তাফিজ বলেন, ‘আমি কারখানা বাড়াতে চাই না। এই কারখানা দিয়েই বছরে ২ থেকে ৪ কোটি ডলারের পোশাক আমি রপ্তানি করতে চাই।’
মোস্তাফিজ অবসর সময়ে অন্তর্জাল ঘেঁটে দেখেন কোন দেশে ডেনিমের কোন ধারা চলছে। ভবিষ্যতে কী আসছে। মানুষটার প্রতিটি দিনক্ষণ আগাগোড়া ডেনিম দিয়ে মোড়া। তাঁর নামটাও তাই পাল্টে গেছে খানিকটা। দেশ-বিদেশের অনেকেই তাঁকে ডাকেন ‘ডেনিম মোস্তাফিজ’।
শুভংকর কর্মকার: সাংবাদিক।
তথ্যসুত্র: প্রথম আলো ডটকম