মানুষের দক্ষতা সাধারণত দুই ধরনের হতে পারে। কারিগরি ও মানবিক। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মাধ্যমে কারিগরি দক্ষতার নানান বিষয় ও প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে পারি। এর বাইরে বেশ কিছু দক্ষতা আছে, যা নিজে থেকেই আয়ত্ত করতে হয়। সারা পৃথিবীতেই চাকরির ক্ষেত্রে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ‘সফট স্কিল’ গড়ে তোলার ব্যাপারে জোর দেওয়া হচ্ছে, সফট স্কিল বলতে সাধারণত এই মানবিক দক্ষতাগুলোকেই বোঝানো হয়। কারিগরি দিক দিয়ে আপনি যতই দক্ষ হন না কেন, মানবিক দক্ষতা না থাকলে ক্যারিয়ারে সফল হওয়া কঠিন। ১০টি প্রয়োজনীয় মানবিক দক্ষতার কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্সি প্রোগ্রামের চেয়ারপারসন, বিজনেস কমিউনিকেশন পরামর্শক ও সহকারী অধ্যাপক সাইফ নোমান খান।
১. যোগাযোগ দক্ষতা
পড়াশোনার বিষয়টা যা-ই হোক, যে ক্ষেত্রেই আপনি ক্যারিয়ার গড়েন না কেন, আপনার মধ্যে যোগাযোগের দক্ষতা থাকা জরুরি। ভাষাগত দক্ষতা, ইতিবাচক শারীরিক ভাবভঙ্গি, লেখার দক্ষতা, গল্প বলার দক্ষতা, রসবোধ, শোনার আগ্রহ, পাবলিক স্পিকিং, সাক্ষাৎকার গ্রহণসহ ই–মেইল লেখা, নিজের বক্তব্য তুলে ধরার যোগ্যতা আয়ত্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই এসব দক্ষতা বিকাশে মনোযোগ দেওয়া উচিত। কোথায় কোথায় দুর্বলতা আছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। চর্চার মাধ্যমে দুর্বলতা দূর করতে হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলতে টেড টকস: দ্য অফিশিয়াল টেড গাইড টু পাবলিক স্পিকিং বইটি পড়তে পারেন। মনে রাখবেন, বাংলা ও ইংরেজি, দুটো ভাষাতেই আপনাকে দক্ষ হতে হবে।
২. নেতৃত্ব বিকাশ
যেকোনো ক্যারিয়ারেই নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ থাকা এখন বিশেষ যোগ্যতা। আপনি ম্যানেজার হতে চান কিংবা দক্ষ কর্মী, আপনার মধ্যে নেতৃত্বের সব গুণ থাকতে হবে। দল গঠনের সক্ষমতা, নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি করা, পরামর্শ দেওয়া-নেওয়া, সংঘাত নিরসনের কৌশল জানা, কূটনীতি, মতামত দেওয়া ও নেওয়া, তত্ত্বাবধান করাসহ দূর থেকেই দলকে নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা আয়ত্ত করতে হবে। টম র্যাথের স্ট্রেন্থস ফাইন্ডার ২.০ বইটি পড়ে জানতে পারবেন, কোন ধরনের নেতৃত্বের গুণাবলি আপনার মধ্যে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বিভিন্ন বিজনেস কেস কম্পিটিশন, হ্যাকাথন আরও নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে নিজের নেতৃত্ব বিকাশের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। সংগঠনে কাজের মধ্য দিয়েও নেতৃত্বের গুণ বিকাশ করা যায়।
৩. পেশাগত দক্ষতা
পেশাগত দক্ষতা বলতে প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা, পরিকল্পনা করা, মিটিং পরিকল্পনা, প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ, পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর কোথায় কী হচ্ছে, গবেষণা করার আগ্রহ, ব্যবসায় রীতিনীতি সম্পর্কে জানা, প্রশিক্ষণ নেওয়া ও দেওয়া এবং গ্রাহকসেবার নানা দিক সম্পর্কে জানা—এসবই বোঝায়। পেশাগত দক্ষতাগুলো সম্পর্কে জানা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে কর্মজীবনে পা রাখলে ভয় কিংবা জড়তা তেমন থাকে না। চার্লস দুহিগের দ্য পাওয়ার অব হ্যাবিট: হোয়াই উই ডু হোয়াট উই ডু ইন লাইফ অ্যান্ড বিজনেস বইটি পড়লে জড়তা কাটানোর বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে জানা যাবে।
৪. ব্যক্তিগত দক্ষতা
আপনি কতটা ইতিবাচক মানুষ কিংবা নেতিবাচক পরিবেশে নিজেকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তার ওপর নির্ভর করছে আপনার ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিগত দক্ষতা বলতে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিবৃত্তিক আবেগ, ব্যক্তি সচেতনতা, আবেগের নিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস, উৎসাহ, আপনি কতটা সহানুভূতিশীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ—এসবই বোঝায়। আপনি কেমন মানুষ, আগে তা খুঁজে বের করতে হবে, তারপর কোথায় কোথায় দুর্বলতা তা বের করে নিজেকে শোধরাতে হবে। ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স ২.০ বইটি পড়লে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিবৃত্তিক আবেগ কীভাবে, কতটা সৃজনশীল উপায়ে বিকাশ করা যায়, তা জানতে পারবেন।
৫. নিজেকে উপস্থাপন
নিজেকে অন্যের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করাও একটি দক্ষতা। এমন নয় যে আপনি যা নন, তা অন্যের সামনে দেখাতে হবে। বরং আপনার শক্তির জায়গাগুলোকে কাজে লাগিয়েই নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা শিখতে হবে। অন্যের সামনে নিজের ‘ব্র্যান্ডিং’ করতে হবে।
৬. ইতিবাচক চিন্তা করা শিখতে হবে
আপনি কীভাবে চিন্তা করেন—এ থেকেই বোঝা যায় আপনি কতটা দক্ষ। নিজের চিন্তাশক্তি বিকাশের জন্য অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড্যানিয়েল কাহনেম্যানের থিংকিং, ফাস্ট অ্যান্ড স্লো বইটি পড়তে পারেন। সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক চিন্তা করা শিখতে হবে এবং তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।
৭. সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন
জীবনে আপনি কতটা সফল হবেন, তা নির্ভর করে আপনার সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী দক্ষতার ওপর। সৃজনশীলতার সঙ্গে নিজের বুদ্ধিমত্তার নান্দনিকতার সম্পর্ক যুক্ত। উদ্ভাবনী দক্ষতা বিকাশের জন্য আপনি অভিজ্ঞ কোনো মানুষের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। যে ভাবনাগুলো আপনাকে আলোড়িত করছে, সেগুলো শুধু মাথার ভেতর না রেখে প্রয়োগ করে দেখতে পারেন। তাহলেই আপনার শক্তি ও দুর্বলতাগুলো জানতে পারবেন।
৮. সংবেদনশীলতা
আপনার সংবেদনশীলতা আপনার আজীবনের শক্তি। কোনো কারণে ব্যর্থ হলে কত দ্রুত সময়ে স্বাভাবিক হতে পারেন কিংবা ব্যর্থতার প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়া কতটা ইতিবাচক, এসব গুণই সংবেদনশীলতা। আপনি নিজের অনুভূতিকে কতটা ইতিবাচক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তা আপনাকে চর্চার মাধ্যমে শিখতে হবে।
৯. সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ
আমরা সমস্যা নিয়ে ভাবতে পছন্দ করি। সমস্যা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সমাধান নিয়ে ভাবনার সুযোগই পাই না। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে জানতে হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য গণিত ও যুক্তির বিভিন্ন কৌশল আয়ত্ত করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে আবেগের চেয়ে যুক্তি ও বাস্তবতার দিকে খেয়াল রাখতে শিখতে হবে।
১০. শেখার আগ্রহ
সবচেয়ে বড় সফট স্কিল হচ্ছে শেখার আগ্রহ থাকা এবং শিখে তা প্রয়োগের চেষ্টা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেকে নিয়ে অহংকারবোধ করি, নিজে থেকে কিছু শিখতে চাই না, যা একটি ফাঁদ। আপনি নিজেকে জ্ঞানী ভাবা শুরু করলেই শেখার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাবে। শিখতে না পারলে ক্যারিয়ার বা জীবনকে সামনে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। আপনার চেয়ে বয়সে বড় কিংবা ছোট সবার কাছে যেতে হবে শেখার জন্য। কে আপনাকে কোন বিষয়টি শেখাবে, তা কিন্তু আপনি জানেন না। আপনার মন যদি নতুন কিছু শেখার জন্য প্রস্তুত না থাকে, তাহলে আপনি নিজেকে সামনে এগিয়ে নিতে পারবেন না।
তথ্যসূত্র: প্রথমআলো ডটকম।