ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের ত্রিশ বছরের যুবক বাছির উদ্দিন সোহাগ। দুই ভাইবোনের মধ্যে বড় তিনি। বাবা আবদুল কুদ্দুছ পেশায় কৃষক। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে এসএসসি পাস করার পরই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় সোহাগের। একসময় মনস্থির করলেন ইনকিউবেটর মেশিনে দেশি মুরগির বাচ্চা ফোটানো ও সেগুলো লালন-পালন করে বিক্রির। খোঁজ নিতে গিয়ে জানলেন একটি ইনকিউবেটর মেশিনের মূল্য ৪ লাখ টাকা। শোনার পরই দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বড় একটা ধাক্কা খেল।
এত টাকা কোথায় পাবেন দরিদ্র সোহাগ! এ সময় এগিয়ে এলেন তার এক বন্ধু। সেই বন্ধুর উৎসাহ ও আর্থিক সহযোগিতায় নিজেই একটা ইনকিউবেটর বানিয়ে ফেলার। বাজার থেকে দেড় লাখ টাকার যন্ত্রাংশ কিনে দীর্ঘ চেষ্টার পর বানিয়ে ফেললেন ইনকিউবেটর মেশিন। এখন তার তৈরি মেশিনেই ফোটানো হচ্ছে দেশি প্রজাতির মুরগির বাচ্চা। বাচ্চা উৎপাদন ও লালন-পালন শেষে বিক্রি করে সোহাগ এখন সফল উদ্যোক্তা। ফের পড়ালেখাও শুরু করেছেন। ভর্তি হয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিকে। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের যুবক বাছির উদ্দিন সোহাগের এই উদ্যোগে স্থানীয় এলাকাবাসীও অবাক। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে দেখার জন্য লোকজন আসে তার বাড়িতে।
ঈশ্বরগঞ্জের ১ নম্বর সদর ইউনিয়নের খৈরাটি দক্ষিণপাড়া গ্রামে সোহাগের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে ২০০২ সালে পড়ালেখা বন্ধ করতে হয় তাকে। এরপর বাবার সাথেই কৃষিকাজ করতেন। কিন্তু তার মাথায় নতুন কিছু তৈরির ভাবনা সব সময় কাজ করত। একদিন ঢাকায় যাওয়ার পথে বাসে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় ময়মনসিংহ বিসিকে কাজ করা হাবিরের সঙ্গে। হাবিবের বাড়ি ফরিদপুর। হাবিব বিসিকে ইনকিউবেটরে ডিম ফোটানোর কাজ করেন। হাবিবের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে ইনকিউবেটরের বিষয়টিতে আরো গুরুত্বের সঙ্গে নেন সোহাগ। তার পর থেকে হাবিবের কর্মস্থলে যাতায়াত শুরু হয় সোহাগের। হাবিবের কাছ দেখে ইনকিউবেটর মেশিন চালনা কিছুটা আয়ত্ত করে নেন।
বন্ধু হাবিবের পরামর্শ ও সহযোগিতায় ইনকিউবেটর তৈরির কিছু কিছু যন্ত্র সংগ্রহ করতে শুরু করে বাছির উদ্দিন সোহাগ। টাকার জন্য বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে চাপ দিতে শুরু করলে প্রথমে তারা রাজি হননি। পরে একমাত্র ছেলের জন্য তারা বিক্রি করে দেন গোয়ালের গরু। সেই টাকায় শুরু হয় সোহাগের ইনকিউবেটর তৈরির কাজ। বাড়িতেই নিজের পরিকল্পনা দিয়ে তৈরি করেন ইনকিউবেটর মেশিনটি। মেশিনটিতে একটি কন্ট্রোলারের প্রয়োজন হয়। সেটি সংগ্রহ করেন ঢাকা থেকে। প্রায় চার মাস মেশিনটি তৈরির কাজ করে শেষ করেন ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। মেশিনটি তৈরিতে খচর পড়েছে দেড় লাখ টাকা।
সোহাগ জানান, তার তৈরি ইনকিউবেটর মেশিন দিয়ে একসঙ্গে ২২০০ ডিমের বাচ্চা ফোটানো যায়। ছয় মাস ধরে তার মেশিনে বাচ্চা ফোটানোর কাজ করে যাচ্ছেন। তার মেশিনে এখন শুধু দেশি প্রজাতির মুরগির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করছেন। তিনি আরো জানান, নিজের মেশিনে বাচ্চা ফুটিয়ে তা নিজেই পরিচর্যা করে বড় করে তোলেন। পরে স্থানীয় বাজারের পাইকাররা তার উৎপাদিত দেশি মুরগির বাচ্চা বাড়ি থেকে কিনে নেন। ছয় মাসে ছয়বার মেশিন দিয়ে তিনি বাচ্চা ফুটিয়েছেন।
সোহাগ আরো জানান, বিদেশ থেকে আমদানি করা ইনকিউবেটর মেশিনের মূল্য অনেক বেশি হলেও তিনি দেড় লাখ টাকার মধ্যে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মেশিন তৈরি করে দিতে পারেন। উদ্যোগী যুবক বাছির উদ্দিন সোহাগের পরবর্তী স্বপ্ন মেশিন দিয়ে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার। কিন্তু অর্থাভাবে সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না তার। অর্থলগ্নিকারী স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাননি।
সোহাগের বাবা আবদুল কদ্দুছ বলেন, ছেলের এই কাজকে প্রথমে তার পাগলামি মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ তার বানানো যন্ত্র দেখে তিনিও অবাক হন। নিজের হাতে বানানো মেশিনে মুরগির বাচ্চা ফুটিয়ে লালন-পালন করার খবরে লোকজন আসে এটি দেখার জন্য। অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে সোহাগের এ উদ্যোগে।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা ভ্যাটেনারি সার্জন ডা. তানজিলা ফেরদৌসী বলেন, সোহাগ একজন উদ্যোগী যুবক। ক্ষুদ্র থেকে বড় হতে নিজের লালিত স্বপ্নের পথে হাঁটছেন। ইনকিউবেটর মেশিনে বাচ্চা উৎপাদন করছেন। এ কাজে তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন সোহাগ। মুরগির বাচ্চা লালন-পালনে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে তাকে। উদ্যোগী যুবক সোহাগ সবার অনুকরণীয় হতে পারে। তার সম্ভাবনাময় শিল্পটির অগ্রগতির জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।