আমার পড়াশোনার বড় একটা অংশ কেটেছে সিলেটে। সিলেট ক্যাডেট কলেজের আশপাশে সারি সারি চা-বাগান। আর তারও অনেক পরে শ্রীমঙ্গলের রাজঘাটে জেমস ফিনলের চা-বাগানে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করি। এসব মিলিয়ে আমার চা-বাগানকেন্দ্রিক পর্যটনের স্বপ্ন দেখা শুরু। টেক্সটাইল ব্যবসার পাশাপাশি আমি আর আমার ব্যবসায়িক অংশীদার সালাম ভাই দিনের পর দিন রিসোর্ট করার জন্য জায়গা খুঁজে বেড়াই। আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু তাপস আর সিনিয়র কামাল ভাইয়ের মাধ্যমে ‘দি প্যালেস’-এর জায়গাটার খোঁজ পাই। তাঁর নিজের কিছু আর অন্য অনেকের জায়গা সেখানে ছিল। পরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শুরু হয় স্বপ্নের রিসোর্ট তৈরির কাজ।
কামাল ভাই আর লিনা ভাবি আমাদের এই স্বপ্নের অংশীদার। প্রথমেই আমরা চিন্তা করি কী করে সব গাছগাছালি রেখে প্রকল্পটা সাজানো যায়। সালাম ভাই এরই মধ্যে চীন ও থাইল্যান্ডে বিভিন্ন হলিডে রিসোর্ট, নেচার রিসোর্ট ও টি রিসোর্টের খোঁজ নিতে শুরু করেন। কয়েকজন স্থপতির সঙ্গে দফায় দফায় সভা চলতে থাকে। আমাদের টেক্সটাইল ব্যবসার কারণেই চীনে ভালো যোগাযোগ ছিল। সেখানে মি. চেন আমাদের একজন স্থপতির সঙ্গে বসিয়ে দেন। তিনিই প্রথম থিমটা তৈরি করে দেন। সালাম ভাইয়ের চোখ আরও উজ্জ্বল হয়। আমি পাশ থেকে বসে সেই আলো দেখি।
পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা হচ্ছে। ক্যাডেট কলেজের তিন ছোট ভাই স্থপতি পারভেজ, কাইয়ুম ও শিশিরও অনেক ইনপুট দিয়েছেন। পারভেজ আর কাইয়ুম আমাদের দি প্যালেসের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে কাজ করেছে। তাঁদের সবার কাছে আমরা অনেক ঋণী। আরেকটা মজার ব্যাপার হচ্ছে প্যালেস পর্যন্ত যে সড়ক হয়েছে, সেটা আঁকাবাঁকা এবং চা-বাগানের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। সেখানেও হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলা প্রশাসন সহায়তা করেছে। আমাদের দেশে সাধারণত শিল্প স্থাপনের সময় প্রশাসনিক সহায়তার অভিজ্ঞতা খারাপ হয়। এখানে কিন্তু তা হয়নি। যে কারণে অনেক উদ্যোক্তা আমাদের কাছে এ গল্প শুনে আমাদের ভাগ্যবান বলেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সবার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা।
দি প্যালেস নাম কেন রাখা হলো? এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। লেখক আনিসুল হক বলেন, এটা হওয়া উচিত ছিল গ্রিন প্যালেস। আমরা নামকরণের সময় আসলে কিছুই ভাবিনি। আমার এক অংশীদার ইকবাল অবশ্য সব সময় এ নামের পক্ষে। তার যুক্তি হলো ৩৭-৩৮ হাজার গাছগাছালিতে ভরপুর এই প্রকল্প এমনিতেই সবুজ। রিসোর্ট এলাকায় আলোর যে খেলা আর প্রাচীন আমলের মতো করে লবি কিংবা মুভি হলের উঁচু ছাদ, তা ইকবালের মাথা থেকেই এসেছে।
রিসোর্টের মধ্যে অনেক টিলা, দুটো হ্রদ আর প্রচুর গাছ রয়েছে। সবচেয়ে মজা হচ্ছে রিসোর্টের পাশে তিনটি চা-বাগান। শুরু থেকেই ভাবছিলাম কীভাবে পরিবেশবান্ধব একটা রিসোর্ট করা যায়। সে কারণেই কোনো টিলা কাটা হয়নি। টিলাগুলো সেতু দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে। আগের গাছগুলো রেখে দেওয়া হয়েছে, আরও শত শত গাছ লাগানো হয়েছে। গ্যাস জেনারেটরের কুলিং সিস্টেমের পানিকে ভিন্ন প্রক্রিয়ায় গরম পানির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে কোনোভাবেই পরিবেশে প্রভাব না ফেলে।
এমনকি দৃষ্টিসীমায় সবুজের বাইরে কিছু যেন চোখে না পড়ে, সে জন্য রিসোর্টজুড়ে মাটির নিচ দিয়ে তার টানা হয়েছে। এমনকি পুরো রিসোর্টে ব্যবহৃত পানিকে পুনঃপ্রক্রিয়া করে পুনরায় ব্যবহার করা হয়, যাতে কোনোভাবেই পরিবেশদূষণ না হয়। একই সঙ্গে আধুনিক সব যোগাযোগের জন্য ৩০ এমবিপিএস গতির স্পিড আর তার সঙ্গে পাঁচটি সভাকক্ষ। কলামহীন ব্যাংকুয়েট হলও তার পাশেই।
পত্রিকায় পড়ি কিংবা বিভিন্ন সময় টিভি চ্যানেলগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের বক্তৃতা শুনি। পরিবেশবান্ধব প্রকল্প করার জন্য তাঁরা প্রচুর উদ্যোগ নিয়েছেন এবং নিয়ে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে ভাবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ পুরো পর্ষদ দি প্যালেস দেখলে কী খুশিই না হতেন। আমাদের মতো নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য এটা হতে পারে খুব উৎসাহমূলক। আমাদের এই পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়নের পেছনে রূপালী ব্যাংকেরও অনেক অবদান।
আমার কাছে অনেকেই প্রশ্ন করেন, স্পিনিং গার্মেন্টস ব্যবসার পাশাপাশি রিসোর্ট কেন? সিলেট এবং চা-বাগান—দুটোর প্রতি ছোট থেকে দেখা ভালো লাগা তো আছেই। আর তার সঙ্গে আমার কাছে মনে হয়েছে, চা-বাগানের সৌন্দর্যের কিছুই এখনো উন্মোচিত হয়নি। পরিবেশবান্ধব প্রকল্প করার জন্য এর চেয়ে উত্তম জায়গা আর হয় না। পৃথিবীর অনেক রিসোর্টে যাওয়ার জন্য লোকজন উন্মুখ হয়ে থাকে। আমি স্বপ্ন দেখি দি প্যালেস সেই মানের একটা গন্তব্য হবে। সিলেটের জাফলং দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ে যেটা আসছে, সেটা এই রিসোর্টের পাশ দিয়েই যাবে। বিদেশিরাও আসবেন আমাদের পাশাপাশি। একই সঙ্গে চা-বাগানে যে জনগোষ্ঠী আছে, তাদের জীবনমান উন্নত হতে থাকবে। এভাবেই এগিয়ে যাবে দেশ—বাংলাদেশ।
আরিফুররহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দি প্যালেস, বাহুবল, হবিগঞ্জ।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।