সহজ-সরল, বিনয়ী ও মিষ্টভাষী একজন মানুষ। এক কথায় ভীষণ মিশুক। কথা বলতে গেলেই কখনো উদাহরণ টানেন পাশ্চাত্যের জ্ঞানগুরুদের, কখনো ইসলামের কালজয়ীদের, কখনো বা মানবধর্মের মহামানবদের। নিজেও জীবনযাপন করেন সৎ ও সত্যতার নিরেট এক প্লাটফরমে। খুঁজে বেড়ান জীবনের মানে। মানুষটিকে কেউ ডাকেন সুফি সাহেব, কেউ বা মিজান সাহেব। পুরো নাম সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। ‘পিএইচপি ফ্যামিলি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তিনি। ব্যবসার জগতে সফল এক কিংবদন্তি। জীবনের এই স্বর্ণশিখরে এসে শোনালেন নিজের ভাঙা-গড়ার নানা গল্প। বললেন বলা-না বলা সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথা।
ছেলেবেলা
ছেলেবেলায় মাকে হারিয়েছেন সুফি মিজান। জন্ম থেকেই শান্তশিষ্ট স্বভাবের মানুষ তিনি। বাবার কঠিন অনুশাসনে বড় হয়েছেন। অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন দ্বিগুণ স্নেহ-ভালোবাসা। তার ভাষায়, ‘আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার জন্য আমার আব্বা নতুন করে সংসারধর্ম করেননি। আমিই ছিলাম তার জীবনের সব। প্রতিদিন সকালে আব্বা নিজ হাতে আমাকে গোসল করাতেন। নাস্তা খাওয়াতেন। হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতেন। আবার স্কুল ছুটির আগেই স্কুলের সামনে গিয়ে বসে থাকতেন। ক্লাস ওয়ান থেকে সিক্স পর্যন্ত তিনি এমনটিই করেছেন।’
তিনি বলেন, আজ দুঃখ হয়, সমাজের কোমলমতি শিশুরা নষ্ট হয় যাচ্ছে। এই সমাজে ঐশীর মতো সন্তান তৈরি হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি সন্তানদের বাবা-মায়ের সময় না দেওয়াকে দায়ী করেন। আক্ষেপ করে বলেন, ‘আজ আমরা সন্তানদের সময় দিই না, আদর করি না, মায়া করি না। তাদের অনুপ্রাণিত বা উজ্জীবিত করতে পারি না। তাদের মনের মধ্যে বড় স্বপ্ন তৈরি করতে আমরা ব্যর্থ হই। চব্বিশ ঘণ্টা কেবল টাকার জন্য পাগলের মতো ছুটে বেড়াই। স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কিংবা দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যে আত্মার সম্পর্ক তা ভুলে যাই।’
কষ্টের শিক্ষা জীবন
স্কুল জীবন মোটামুটি শেষ হলেও কলেজ জীবনেই অনেকটা কষ্টের শুরু সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের। কলেজ জীবনে আর দশ জনের মতো বন্ধুদের সঙ্গে খুব একটা আড্ডাবাজির সুযোগ পাননি তিনি। ইন্টারমিডিয়েট পাস করেই চাকরি শুরু করেছিলেন। সারা দিন কাজ করতেন। সন্ধ্যা ৬টায় নাইট কলেজে গিয়ে বসতেন। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর রাত ১১টা পর্যন্ত ক্লাস করতেন। কেবল তাই নয়, ৪ মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরতেন গভীর রাতে। এরপর নিজে হাতেই রান্নাবান্না করে খেতেন। আবার সকাল ৮টা থেকে অফিস। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই টিউশনি ও নিজের লেখাপড়া করছেন। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে সাংসারিক প্রয়োজনেই ছাত্র জীবন থেকে এমন কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি।
লেবু চুরি ও জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা
প্রাইমারিতে পড়ার সময় লেবু চুরির একটি ঘটনা থেকে জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা নিয়েছেন সুফি মিজান। আজও সেই শিক্ষা তার চলার পথের পাথেয়। মজার সেই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘গরমের দিন। বৈশাখ-চৈত্র মাস। বাড়িতে শুঁটকির ভর্তা বানানো হয়েছে। আমাদের কাছে তখন শুঁটকি ভর্তার সঙ্গে লেবু খুব উপাদেয় খাদ্য ছিল। তো বাবার সামনে লেবু কেটে দেওয়া হলো। বাবা খেতে গিয়ে বললেন, আজকে তো লেবু কিনি নাই। লেবু কোত্থেকে এলো? আমি মনে মনে ভাবলাম বাবাকে যদি বলি আমরা বন্ধুরা মিলে পাশের জমিদারবাড়ি থেকে লেবু চুরি করে এনেছি তাহলে বুঝি বাবা খুব খুশি হবেন। বলেও ফেললাম তাই।
আব্বা বিদ্যুতের মতো গর্জন দিয়ে উঠলেন। বললেন, কী বললে! তুমি মানুষের বাড়িতে লেবু চুরি করতে গেছ! আমি তোমাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি ভালো মানুষ করার জন্য আর তুমি লেবু চুরি করতে গেছ! কাঠের পিঁড়িতে বসে খাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা পিঁড়ি হাতে নিয়ে আমাকে মারতে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়ে বের হয়ে গেলাম। আমাকে বললেন, সব লেবু নিয়ে ওদের বাড়িতে দিয়ে এসো। মনে আছে, অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে এক হাতে লেবু, আরেক হাতে চোখের পানি মুছছিলাম। ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ার সময় বাবা এই যে একটা অনুশাসন দিলেন তা সারা জীবনের মতো মনে গেঁথে গেল। প্রথমে ভেবেছিলাম বাবা বুঝি খুব নিষ্ঠুর। কিন্তু না। এখন মনে করি ওইটা আমার শ্রেষ্ঠ শাসন ছিল। দয়া ছিল।
আর সে কারণেই আজ এই ৭৫ বছর বয়সেও কোনো মানুষের জিনিসে হাত দিই না। অবৈধ কোনো কিছু মনেও আসে না। কেবলই বাবার সেই অনুশাসনের কথা মনে হয়। যেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন আমার বাবা।’ সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘টোকিও থেকে ভ্যানকুভার, উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ অনেক জায়গায় গিয়েছি। ব্যবসায়িক জীবনে বহু মানুষের সঙ্গে লেনদেন করেছি। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না, মিজান সাহেবের কাছে ৫টা টাকা পাওনা আছে। মানুষের হক, বান্দার হক, দেশের হক, প্রতিষ্ঠানের হক সবকিছুই বিবেচনার সঙ্গে নিই, যা আমি আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি। আর সে কারণেই হাসিমুখে আল্লাহর কাছে ফিরে যাব বলে আশা করি।’
সাদাসিধে জীবন
শিল্পপতি হয়েও অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত সুফি মিজান। বিলাসিতা একেবারেই টানে না তাকে। ঘুরেফিরে এক পোশাকই পরেন তিনি। তার প্রিয় খাবার ডাল, ভাত, আলু ভর্তা ও ডিম ভাজি। সঙ্গে একটি শুকনা মরিচ ভাজাও। স্ত্রী তাহমিনা রহমানও তার মতোই। সাত ছেলে, এক মেয়ে তাদের। চট্টগ্রামের মাত্র ১৩-১৪০০ স্কয়ার ফিটের বাড়িতে থাকেন তিনি। সুফি মিজান বলেন, ‘আমি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে বিছানা থেকে পা রেখেই বলি, হে আল্লাহ! তোমার জমিন, তোমার বাতাস, তোমার আলো। একদিন আমি এখানে ছিলাম না, থাকবও না। কেন এলাম, কীই বা জীবনের উদ্দেশ্য?’ বাবার কাছ থেকে সততা, সাম্য ও সরলতার শিক্ষা পেয়েছেন তিনি। বললেন, ‘আমার বাবা বলতেন, “ভালো মানুষের জুতা ছাপ করে দেবে, তাতেও সম্মান আছে। কখনো খারাপ মানুষ, দুশ্চরিত্র মানুষের সরদার হয়ো না”।’
নারীদের অন্য রকম সম্মান করেন এই অনন্যসাধারণ মানুষটি। ব্যবসার শুরুতেই যখন একের পর এক সফলতা পাচ্ছিলেন তখনই এক পীর সাহেবের সান্নিধ্যে এমন শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। তার বর্ণনায়, ‘আমি চাকরি ছেড়ে যখন ব্যবসা শুরু করলাম, তখন ব্যবসার জন্য দেশ-বিদেশ যেতে হতো। ভরা যৌবন আমার। একদিন আমার পীর সাহেব আমাকে ডাকলেন। কাছে বসালেন।
বললেন, “মিজানুর রহমান সাহেব।” জি হুজুর। “আপনি তো দেখছি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দেশ-বিদেশ বহু জায়গায় যান।” জি। “বাবা! জীবনে অনেক মেয়েমানুষের সান্নিধ্যে আসতে হবে। মনে রাখবেন, অনলি অ্যাকসেপ্ট ইউর ওয়াইফ”।’ সুফি মিজান বলেন, ‘আমার কাছে আমার স্ত্রী ছাড়া যে কোনো মেয়ে, যদি তিনি আমার বয়সে বড় হন, তবে মায়ের মতো, সমবয়সী হলে বোন, ছোট হলে মেয়ের মতো। আমি মনে করি, পৃথিবীর প্রতিটি পুরুষ যদি এটি হৃদয়ে ধারণ করত তবে কোনো নারীই কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হতো না… কিসের ইভ টিজিং, কিসের কী!’
ব্যাংকার থেকে ব্যবসায়ী
দাদা ছিলেন ব্যবসায়ী। পাটের ব্যবসা করতেন। সে সময় চার-পাঁচশ মণের কয়েকটা নৌকা ছিল তাদের। তার বাবাও ব্যবসা করতেন। কিছু খেত-খামারও ছিল। সেখানে ধান-পাট চাষ হতো। সুফি মিজানের ইচ্ছা ছিল শিক্ষক হবেন। কিন্তু তার বাবা বললেন, ‘তুমি ব্যবসা করবে।’ কিন্তু টাকা? তখন বাবা বললেন, ‘ইফ ইউ নো দি বিজনেস, মানি উইল রান আপ টু ইউ।’
তার পরও মাত্র ১০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেছিলেন সুফি মিজান। এখনকার হিসাবে মাত্র ১ ডলার ২০ সেন্টস। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পরপরই ১৯৬৫ সালে সর্বপ্রথম তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড) চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে দুই বছর চাকরি করার পর ’৬৭ সালেই আরেকটি ব্যাংকে যোগ দেন। তবে স্বাধীনতার পরপরই চাকরি ছেড়ে দিলেন। তখন ব্যবসার জন্য তার মূলধন ছিল মাত্র ১ হাজার ৪৮৩ টাকা। এই মামুলি টাকা দিয়েই ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি।
সুফি মিজানের মতে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক কমে গেল। কেননা বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই ছিলেন নন-বেঙ্গলি। যারা ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন, তারাই ব্যবসা জানতেন। তৎকালীন আদমজী, বাওয়ানী, দাউদের মতো বড় বড় সব শিল্প কারখানাই ছিল তাদের। স্বাধীনতার পর যখন তারা নিজেদের দেশে ফিরে গেলেন তখন ব্যবসা ক্ষেত্রে বিশাল একটি শূন্যতা তৈরি হলো। ঠিক এই সময়টাকে কাজে লাগালেন মিজানুর রহমান। বেশ কয়েক বছর ব্যাংকে কাজ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেসটা ভালো করে শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
জেনেছিলেন কোন দেশে কোন জিনিস তৈরি হয়, কোন দেশের ভালো জিনিস কম দামে পাওয়া যায়, আবার নিজের দেশে কোন সিজনে কোন জিনিস ভালো দামে বিক্রি হয়। এসব কিছুর সম্যক ধারণা নিয়েছিলেন ব্যাংকে চাকরির সময়। আর সে কারণেই দেশ-বিদেশ থেকে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসার মাধ্যমে ব্যবসায়িক জীবন শুরু করেছিলেন মিজান সাহেব। প্রথম দিকে জাপান থেকে টায়ারটিউব, মিল্ক পাউডার, সুতা, পুরনো কাপড়, স্পেয়ার পার্টস, মোটর পার্টস প্রভৃতি আমদানি করতেন তারা। সেখানে সফলতার পর পরই ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে যান। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন একের পর এক সফলতা।
যে মন্ত্রে মিরাকল
Divine Blessings Mixed with Hard Work Backed by Good Intension can Make Miracle— এই মন্ত্রেই বিশ্বাসী সফল ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এ সত্যকেই ভিতরে লালন করেন তিনি। বলেন, ‘আপনি যদি আল্লাহর দয়া পেতে চান, তবে আপনাকে একজন ভালো মানুষ হতে হবে। আপনাকে পরোপকারী হতে হবে। ধার্মিক হতে হবে। হতে হবে সৎ, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক। তবে তা কাউকে দেখানো কিংবা বাহ্বা পাওয়ার জন্য নয়, মনের গভীর আকুতি থেকে। নিজেকে কাজের মধ্যে উজাড় করে দিতে হবে। আর যে মানুষ যত বেশি মানুষের জন্য কাজ করে, বিধাতা তাকে তত বেশি বড় করেন।’
স্বপ্ন
বাংলাদেশ নিয়ে, নিজের পিএইচপি ফ্যামিলি নিয়ে এখনো অনেক স্বপ্ন দেখেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমি চাই বাংলাদেশের কোনো মা-বোন যেন ক্ষুধার তাড়নায় কষ্ট না পায়। প্রতিটি কোমলমতি সন্তান যেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়। যেন চিকিৎসার অভাবে কোনো মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ না করে। প্রতিটি মানুষের যেন থাকার মতো একটি ছোট্ট কুটির আর চলার মতো একটি ছোট্ট ট্রান্সপোর্ট থাকে।’
পিএইচপি ফ্যামিলি নিয়েও একই স্বপ্ন দেখেন তিনি।
এই ফ্যামিলির প্রতিটি মানুষ যেন থাকার মতো একটি ছোট্ট বাড়ি ও চলার মতো একটি নিজস্ব ট্রান্সপোর্ট পায়। তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবসা ক্ষেত্রে সফল, তার পরও কিছু আকুতি থেকে গেছে। আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেকটা অবদান রাখতে পেরেছি। বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, যা আমাদের আগে আর কেউ নিতে পারেনি। কিন্তু এখনো কিছু স্বপ্ন পূরণ বাকি আছে। যার একটি হলো, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেসিক স্টিল মিলস মেকার হিসেবে দেখতে চাই।’
অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপার সম্ভাবনা খুঁজে পান সুফি মিজান। তার মতে এই দেশটি সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। ব্যবসার জন্য বাংলাদেশের মতো এমন সুযোগ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তিনি বলেন,‘ স্বাধীনতার পর আমাদের বলা হতো বটমলেস বাস্কেট। আজ আমাদের রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নের ওপরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় কিছুদিন আগে আইটি সেন্টার উদ্বোধন করেছেন।
প্রতি বছর শুধু সেখান থেকেই ১ বিলিয়ন এক্সপোর্ট করা সম্ভব হবে। এ রকম আরও যদি ৫০টি গ্রুপ আসে, ৫০ বিলিয়ন হবে। বেশি দিন বাকি নেই যেদিন বাংলাদেশ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।’ তার মতে, বাংলাদেশের মতো এত অল্প পয়সায় আর অন্য কোথাও শ্রমিক পাওয়া যায় না। এত বুদ্ধিমান, দক্ষ, কর্মঠ জাতি আর কোথাও নেই। এই মানুষগুলোকে কেবল সুযোগ দেওয়া দরকার। দরকার আনন্দ-উৎসাহ ও সুন্দর একটা পরিবেশ দেওয়া; যার অভাব এখনো বাংলাদেশে আছে বলে তিনি মনে করেন।
নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান
নতুন যারা ব্যবসায় আসতে চান তাদের জন্য সফল এই ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার আহ্বান— কঠিন পরিশ্রম ও তপস্যা করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে সুফি মিজান বলেন, এই মুহূর্তে যে কাজটি করছ মনের মাধুরী মিশিয়ে কর। যারা ব্যবসা বিষয়ে একাডেমিক শিক্ষা নিচ্ছ তারা সেখানে সফলতা দেখাও। তাহলে বিজনেসে এসেও সফল হবে। জীবনে বড় হতে হলে বড় বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে কঠিন পরিশ্রম ও তপস্যা করতে হবে।
বিশ্বের জ্ঞানতাপস সক্রেটিসের উদাহরণ টেনে সুফি মিজান বলেন, একবার সক্রেটিসের কাছে একজন জানতে চাইলেন, ‘স্যার আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কিংবা শ্রেষ্ঠ কাজ কোনটি?’ প্রতি উত্তরে সক্রেটিস বললেন, ‘এই মুহূর্তে তুমি যে কাজটি করছ সেটিই তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এই মুহূর্তে তুমি যার সামনে আছ তিনি তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ। আর মানুষের জন্য কিছু করা তোমার শ্রেষ্ঠ কাজ।’ সক্রেটিসের এই কথা যদি কেউ মেনে চলতে পারেন, তবেই না একজন সত্যিকারের মানুষ হতে পারবেন। ফের উদাহরণ টেনে মিজানুর রহমান বলেন, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন, ‘ডার্কনেস ক্যান নট বি রিমুভড বাই ডার্কনেস।
অনলি লাইট ক্যাপন ডু দ্যাট। হেইট ক্যান নট বি রিমুভড বাই হেইট। অনলি লাভ ক্যান ডু দ্যাট।’ হজরত আলী (রা.)ও তার জীবন থেকে এমন অনেক শিক্ষাই আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
পিএইচপি গ্রুপ নয়, ফ্যামিলি
সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গর্ব করে বলেন, অন্যসব বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো পিএইচপি কোনো গ্রুপ নয়, ফ্যামিলি। ফ্যামিলির মতোই এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু আমরা হরতাল কাকে বলে, স্ট্রাইক কাকে বলে কখনো বুঝিনি। এখানকার সবাই আপন মনে হাসিমুখে কাজ করতে পারে। সুইপার, পিয়ন কিংবা প্রেসিডেন্ট সবাই এখানে এক। বিভিন্ন ধরনের স্টিল, গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, শিপ রিসাইক্লিং, টেক্সটাইল, পেট্রলিয়াম প্রোডাক্টস, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিজাত পণ্য, লেদার, ফিশারিজ, রিয়েল এস্টেটসহ বর্তমানে বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবসা রয়েছে সুফি মিজানুর রহমানের। পিএইচপি ফ্যামিলির আওতায় দেশে-বিদেশে অন্তত ৩০টি আলাদা কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই বিশিষ্ট শিল্পপতির।
সহকর্মীদের চোখে সুফি মিজান
সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সহকর্মীদের কাছে অন্য রকম এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রায় ১৭ বছর ধরে তাকে কাছ থেকে দেখছেন সুফি মিজানের ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস—ইউআইটিএসের উপাচার্য ড. মো. সোলাইমান। বললেন তার অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, সুফি সাহেব বিশ্বাস করেন মানুষকে লাখে লাখে দিলে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। তিনি বড় বড় স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। কঠোর পরিশ্রম দিয়ে তা পূরণ করে ছাড়েন।
তার সততা ও সরলতার প্রমাণ দিতে গিয়ে এক বিশেষ ঘটনা তুলে ধরেন ড. সোলাইমান। বলেন, একবার একটি ট্রেনিং সেন্টার উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন সুফি মিজানুর রহমান। তাকে ফিতা কাটতে দেওয়া হলো। তিনি নিজে ফিতা না কেটে হঠাৎ পাশেই কর্মরত সুইপারকে ডেকে ফিতা কাটালেন। বললেন ইনি আমার মা। এমন অনেক ঘটনাই ঘটান তিনি। মিজান সাহেবের অফিসে সবাই একসঙ্গে খাবার খান। লাঞ্চের সময় সবার জন্য একই পাত্রে একই খাবার রান্না হয়। পুরো ক্যান্টিনের খাবার তিন ভাগে ভাগ হয়। সুইপার থেকে শুরু করে ওই শ্রেণির সবার জন্য এক ভাগ। অফিসের অন্য সাধারণ কর্মীদের জন্য এক ভাগ এবং তার নিজেরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য এক ভাগ। সবার জন্যই একই খাবার। এই সহকর্মী আরও জানান, সুফি সাহেব কেবল নিজেই এমন নন, তার সব সন্তানকেও একই রকম করে মানুষ করেছেন তিনি।
তথ্যসুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন ডটকম।