মুক্তো একটা প্রাকৃতিক রত্ন এবং এটা মোলাস্ক বা কম্বোজ জাতীয় প্রাণী থেকে উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশ এবং সব জায়গায় একদিকে যেমন মুক্তোর চাহিদা বাড়ছে, তেমনি খুব বেশী মুক্তো তোলা এবং প্রদূষণের কারণে প্রকৃতি থেকে এর জোগান কমে গেছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রচুর পরিমানে মুক্তো নিজের দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানি করছে। ভারতের ভুবনেশ্বরের সেন্ট্রাল ইন্সটিট্যুট অফ ফ্রেশওয়াটার অ্যাকোয়াকালচার সাধারণ মিষ্টিজলের ঝিনুক থেকে মিষ্টিজলে মুক্তো চাষের প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে, যে ঝিনুক সারা দেশের মিষ্টিজলের জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়৷
প্রকৃতিতে একটা মুক্তো তৈরী হয় যখন কোনও বহিরাগত বস্তু যেমন বালির দানা, কীট ইত্যাদি কোনভাবে একটা ঝিনুকের দেহে প্রবেশ করে, এবং ঝিনুক তাকে পরিত্যাগ করতে পারে না ও পরিবর্তে তার উপর স্তরে স্তরে একটি চকচকে আস্তরণ তৈরী করে। সহজ এই পদ্ধতিটি কাজে লাগান হয় মুক্তো চাষে।
চাষের পদ্ধতি:
মিষ্টি জলে মুক্তো চাষের প্রক্রিয়াতে পরপর ছ’টি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ থাকে, যথা ঝিনুক সংগ্রহ, অস্ত্রোপচারের আগের প্রস্তুতি, অস্ত্রোপচার, অস্ত্রোপচারের পরের যত্ন, জলাশয়ে চাষ এবং মুক্তো বার করা।
১) ঝিনুক সংগ্রহ
মিষ্টি জলের জলাশয় যেমন, পুকুর নদী ইত্যাদি থেকে সুস্থ ঝিনুক সংগ্রহ করা হয়। ওগুলো হাতে করে সংগ্রহ করে বালতিতে বা জলপূর্ণ পাত্রে রাখা হয়। মুক্তো চাষের জন্য ব্যবহৃত আদর্শ ঝিনুকের আকার সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত ৮ সেমির বেশি হবে
২)অস্ত্রোপচারের আগের প্রস্তুতি
সংগৃহীত ঝিনুকগুলিকে অস্ত্রোপচারের আগে দুই থেকে তিনদিন বন্দী দশায় গাদাগাদি করে পুরোনো কলের জলে লিটার প্রতি একটি ঝিনুকের অনুপাতে রাখা হয়৷ এই অস্ত্রোপচার-পূর্ববর্তী পদ্ধতিটি চালান হয় অ্যাডাক্টার পেশিগুলোকে দুর্বল করার জন্যে, যা অস্ত্রোপচারের সময় ঝিনুকগুলোকে সহজে নাড়াচাড়ায় সাহায্য করে
৩)ঝিনুকের অস্ত্রোপচার
অস্ত্রোপচারের জায়গা বিশেষে স্থাপন তিন রকম হয়, যথা ম্যাণ্টল গহ্বর, ম্যাণ্টল কোষকলা ও যৌনগ্রন্থীয় স্থাপন। অস্ত্রোপচার দ্বারা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রধান বস্তুগুলি হচ্ছে পুঁতি বা কেন্দ্রকণা, যেগুলো সাধারণতঃ ঝিনুকের খোলা বা অন্য কোনও চুনযুক্ত বস্তুর দ্বারা গঠিত হয়।
ম্যাণ্টল গহ্বর স্থাপন – এই পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রাণীটির দুটি কপাট খুলে(ঝিনুকের উভয় দিকে আঘাত না লাগিয়ে) ও খোলার সামনের দিকে থেকে ম্যাণ্টলকে সাবধানে আলগা করে গোলাকৃতি(৪-৬ মিমি ব্যাসের)বা পূর্বনির্দিষ্ট ধরনের পুঁতি(গণেশ, বুদ্ধ ইত্যাদির প্রতিকৃতি) ম্যাণ্টল গহ্বরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। উভয় কপাটের ম্যাণ্টল গহ্বরেই স্থাপন করা চলে৷ পূর্বপরিকল্পিত ধরনের পুঁতি স্থাপনের সময় যত্ন নেওয়া হয় যাতে ডিজাইন করা দিকটি ম্যাণ্টলের দিকে মুখ করে থাকে। পুঁতিটিকে যথাস্থানে রাখার পর ম্যাণ্টলকে কেবল খোলসের গায়ে ঠেলে দিলেই স্থাপনের দরুন উৎপন্ন ফাঁকা জায়গাগুলি ভরাট হয়ে যায়৷
ম্যাণ্টল কোষকলা স্থাপন: এখানে ঝিনুকগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়; দাতা এবং গ্রহীতা ঝিনুক। এই প্রক্রিয়ার প্রথম কাজ হল গ্রাফ্ট বা জোড় তৈরী করা(ধাত্র কোষকলার ছোট ছোট টুকরো)। এটা করার জন্য একটা দাতা ঝিনুক থেকে একটা ম্যাণ্টল ফিতে তৈরি করা হয়(ঝিনুকের পেটের দিকের ম্যাণ্টলের একটি ফালি),যে ঝিনুকটিকে এ কাজের জন্য মেরে ফেলা হয় এবং ওই ফিতেটি ছোট ছোট(২X ২মিমি) টুকরোয় কাটা হয়। স্থাপন শুধু গ্রহীতা ঝিনুকে করা হয়, যা দুই ধরনের হয়, যথা কেন্দ্রবিহীন ও কেন্দ্রযুক্ত(নন নিউক্লিয়েটেড ও নিউক্লিয়েটেড)। প্রথমটিতে ঝিনুকের পেটের দিকে অবস্থিত পস্টিরিয়র প্যালিয়াল ম্যাণ্টলের ভিতরের দিকে তৈরি করা পকেট বা গহ্বরে কেবল জোড়ের টুকরোগুলিকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কেন্দ্রযুক্ত পদ্ধতিতে, একটি জোড়ের টুকরো ও সেই সঙ্গে একটি ছোট কেন্দ্রকণা(2 মিমি ব্যাসের) গহ্বরে ঢোকান হয়৷ দুটো পদ্ধতিতেই সাবধানতা নেওয়া হয় যাতে জোড় বা কেন্দ্রকণা পকেট থেকে বেরিয়ে না আসে। দুটি কপাটের ম্যাণ্টলের ফিতেতেই স্থাপন করা যায়৷
যৌনগ্রন্থীয় স্থাপনঃ এই পদ্ধতির জন্যও গ্রাফট বা জোড়(ম্যান্টল টিস্যু পদ্ধতিতে বর্ণিত)তৈরি করতে হয়। প্রথমে ঝিনুকের যৌনগ্রন্থির ধারে কাটতে হয়। তারপর যৌনগ্রন্থিটিতে একটা জোড় এবং তার সাথে একটা কেন্দ্রকণা(2-4 মিমি ব্যাসের) এমন ভাবে প্রবেশ করান হয় যাতে জোড় এবং কেন্দ্রকণা নিবিড়ভাবে পরস্পর সংলগ্ন থাকে। এমনভাবে যত্ন নেওয়া হয় যাতে কেন্দ্রকণাটি জোড়ের বাইরের এপিথেলিয়াল স্তরের সাথে লেগে থাকে এবং অস্ত্রোপচারের সময় অন্ত্র কেটে না যায়
৪) অস্ত্রোপচারের পরের যত্ন
স্থাপন করা ঝিনুকগুলি অস্ত্রোপচারের পরে যত্ন করার জায়গায় নাইলনের ব্যাগে ১০দিন রাখা হয়, অ্যান্টিবায়োটিক এবং প্রাকৃতিক খাবার দিয়ে। ইউনিটগুলি প্রতিদিন পরীক্ষা করা হয় এবং মরা ঝিনুক এবং যেগুলো কেন্দ্রকণাকে প্রত্যাখ্যান করে সেই ঝিনুকগুলিকে বার করে নেওয়া হয়।
৫)জলাশয়ে চাষ
অস্ত্রোপচারের পরের যত্নের পর স্থাপন করা ঝিনুকগুলিকে জলাশয়ে ছাড়া হয়৷ ঝিনুকগুলিকে নাইলনের ব্যাগে রাখা হয় (এক-একটা ব্যাগে দুটো করে)এবং বাঁশের বা পিভিসি পাইপ থেকে ঝুলিয়ে জলাশয়ে ১ মি গভীরতায় রাখা হয়। ১ হেক্টরে ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ ঝিনুক রেখে চাষ করা হয়। জলাশয়ে মাঝেমাঝে জৈব ও অজৈব সার দেওয়া হয় যাতে প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদন অব্যাহত থাকে। চাষের ১২-১৮ মাস সময়কালের মধ্যে মাঝেমাঝেই ঝিনুকগুলিকে যাচাই করে মরা ঝিনুক বার করে দেওয়া এবং ব্যাগগুলিকে পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
৬) মুক্তো তোলা
চাষের সময়ের শেষে ঝিনুকের ফসল তোলা হয়। ম্যান্টল কোষকলা বা যৌনগ্রন্থি পদ্ধতিতে জ্যান্ত ঝিনুক থেকে মুক্তো বার করা সম্ভব হলেও ম্যান্টল গহ্বর পদ্ধতিতে ঝিনুকগুলিকে মেরে ফেলতে হয়। বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচার করে স্থাপন করা পদ্ধতির ফলে যে মুক্তোগুলো পাওয়া যায় তা হল ম্যান্টল গহ্বর পদ্ধতিতে খোলের গায়ে লেগে থাকা অর্ধ গোলাকৃতি ও প্রতিকৃতি মুক্তো; ম্যান্টল কোষকলা পদ্ধতিতে না লেগে থাকা ছোট অসমান বা গোল মুক্তো এবং যৌনগ্রন্থি পদ্ধতিতে না লেগে থাকা বড় অসমান বা গোল মুক্তো।
পুকুরেই মাছের সাথে মুক্তা চাষ
মুক্তা মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ।ঝিনুকের ন্যাকার গ্রন্থি হতে নির্গত রস জমে যে পদার্থ তৈরি হয় তা হচ্ছে মুক্তা।দেশের বিলে-ঝিলে ও উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর ঝিনুক রয়েছে। ওই ঝিনুক ব্যবহার করে মুক্তা চাষ ও উৎপাদন বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার একটু দৃষ্টি দিলেই পরিকল্পিতভাবে মুক্তা চাষ ও উৎপাদন করে প্রতিবছর দেশীয় চাহিদা পূরন করা ছাড়াও হাজার হাজার কোটি টাকা মুক্তা রফতানি করা সম্ভব।এতে বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।