কেতাদুরস্ত স্যুটের দুনিয়ায় রেমন্ডের নাম সুপরিচিত। ১৯২৫ সালে ক্ষুদ্র টেক্সটাইল কোম্পানি হিসেবে যাত্রা করে প্রতিষ্ঠানটি। তারপর প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান ৮০ বছর বয়সী বিজয়পত সিংহানিয়ার হাত ধরেই সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠে রেমন্ড। বর্তমানে উন্নতমানের পশমি উলের স্যুট তৈরিতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধরা হয় রেমন্ড গ্রুপকে। শুধু তা-ই নয়, সিংহানিয়া পরিবারের নামও এখন সারা বিশ্বে সমাদৃত।
তিন বছর আগে বিজয়পত সিংহানিয়া রেমন্ড গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ তার ছেলে গৌতম সিংহানিয়াকে হস্তান্তর করেন। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। কিছুদিন পর থেকেই পিতা-পুত্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে। বিজয়পতের জীবনে নেমে আসে দুর্দশা। বিজয়পতের অভিযোগ, তার ছেলে মুম্বাইয়ের অভিজাত বাড়ি থেকে তাকে বের করে দিয়েছে। এমনকি তাকে রেমন্ডের অফিস থেকেও বিতাড়িত করা হয়েছে।
অনেকটা আবেগতাড়িত হয়েই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিজয়পত। কিন্তু এখন তিনি তার এ সিদ্ধান্তের জন্য অনুশোচনা করছেন। নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে এখন নিজেই ঠাঁই পাচ্ছেন না। অভিজাত বাড়ি ছেড়ে এখন তাকে থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাড়িতে।
দক্ষিণ এশিয়ার উদ্যোক্তা পরিবারগুলোর মধ্যে সিংহানিয়া পরিবারের নাম প্রথম দিকেই উঠে আসে। শুধু পোশাকই নয়, সিমেন্ট, দুগ্ধপণ্য ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও সিংহানিয়া পরিবারের অবদান রয়েছে। সম্প্রতি ক্রেডিট সুইস প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, কনগ্লোমারেটের পারিবারিক মালিকানার র্যাংকিংয়ে বিশ্বে ভারতের স্থান তৃতীয়।
ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের কনগ্লোমারেটগুলোয় দিন দিন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। উত্তরসূরিরা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কনগ্লোমারেটগুলো পরিচালনার জন্য ভারতের এখন বৈশ্বিক করপোরেট স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা খুবই প্রয়োজন। এর ফলে হয়তো আম্বানি পরিবারের মতো দ্বন্দ্বগুলো এড়ানো সম্ভব হবে।
রিলায়েন্স কনগ্লোমারেটের কর্ণধার ধিরুভাই আম্বানি মৃত্যুর সময় কোনো উইল করে যাননি। ফলে তার দুই ছেলে মুকেশ আম্বানি ও অনিল আম্বানির মধ্যে রিলায়েন্স নিয়ে বহুদিন ধরে চলেছে দ্বন্দ্ব। ভারতের চাঁদ বিখ্যাত পানীয় ও আবাসন ব্যবসায়ী পন্টি ও তার ভাই হরদীপ চাদের মধ্যেও বহুদিন ধরে চলেছে দ্বন্দ্ব।
২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে পরস্পরকে হত্যা করেন পন্টি ও হরদীপ। ফার্মাসিউটিক্যাল টাইকুন শিবিন্দার সিং ও মালবিন্দার সিংয়ের মধ্যেও বহুদিন ধরে কলহ চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিজয়পত সিংহানিয়ার সংকট শুরু হয় ২০১৫ সালে রেমন্ডের ৩৭ শতাংশের মালিকানা ছেলেকে হস্তান্তর করার পর। বিজয়পত জানান, ২০০৭ সালে অন্য একটি পারিবারিক দ্বন্দ্ব মীমাংসার জন্য পারিবারিকভাবে একটি চুক্তি হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী, মুম্বাইয়ের মালাবার হিলে সিংহানিয়া পরিবারের জে কে হাউজে একটি অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়ার কথা ছিল বিজয়পতের।
চুক্তিতে ফ্ল্যাটটির দাম বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম নির্ধারণ করা হয়। এ ফ্ল্যাটটি কেনার জন্য রেমন্ডের কিছু সম্পদ বিক্রির প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু গৌতম পরিচালনা পর্ষদকে রেমন্ডের সম্পদ বিক্রি না করার নির্দেশ দেন। এ নিয়ে পিতা-পুত্রের মধ্যে দেখা দেয় প্রচণ্ড বিতর্ক।
বিতর্কের একপর্যায়ে পরিচালনা পর্ষদ বিজয়পতকে ‘ইমেরিটাস চেয়ারম্যান’ পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। বিজয়পত জানিয়েছেন, তাকে অফিস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে এবং তার কাছে যা কিছু ছিল, সব কেড়ে নেয়া হয়েছে। এমনকি তার পদ্মভূষণ পদকটি পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়েছে।
দুই বছর ধরে বিজয়পত তার ছেলের সঙ্গে কথা বলেন না। ভারতের ২০০৭ সালের একটি আইন অনুযায়ী, কোনো সন্তান যদি পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন না করে, তবে পিতা-মাতা তাদের অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে পারবে। সম্প্রতি এ আইনের আশ্রয় নেয়ার কথা ভাবছেন বিজয়পত সিংহানিয়া।
সিংহানিয়া দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, কোনো পিতা-মাতা যেন তাদের জীবদ্দশায় সঞ্চিত সব অর্থ তাদের সন্তানদের অর্পণ করার মতো ভুল না করেন। গৌতম সিংহানিয়া জানিয়েছেন, তিনি শুধু তার দায়িত্ব পালন করেছেন।
গত বছর ভারতের ইকোনমিক টাইমসকে তিনি বলেন, যা সঠিক, আমি তা-ই করেছি। রেমন্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে আমার দায়িত্ব এবং পুত্র হিসেবে আমার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আলাদা। পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য (বিজয়পত) তার পদবি ব্যবহার করে কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করেছেন।
গৌতম জানান, ‘আমি নিজেই ভুক্তভোগী। আমি এখানে কী ভুল করলাম?’ পিতা-পুত্রের বিতর্কের কোনো প্রভাব রেমন্ড গ্রুপের ওপর পড়েনি। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ২০১৮ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে তাদের মুনাফা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি ইথিওপিয়ায় তারা একটি নতুন কারখানা চালু করেছে।