ফেসবুক এখন বিজ্ঞাপন দিয়ে চলছে। ব্যবহারকারীদের বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে, বিনিময়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ব্যবহারকারীরা যদি বিজ্ঞাপন দেখতে না চান, তবে অর্থ খরচ করে বা ফেসবুক সাবস্ক্রাইব করে ফেসবুক চালাতে হবে। রাজি কয়জন?
অনেকেই হয়তো টাকা খরচ করে ফেসবুক চালাতে রাজি হবে না। ফেসবুক কর্তৃপক্ষও সেটি জানে। কিন্তু ব্যবহারকারী ধরে রাখতে তাদের অন্য উপায় নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। ফেসবুকের এমন বিজ্ঞাপনমুক্ত সংস্করণ চলবে কি না বা ব্যবহারকারীরা টাকা দিয়ে ফেসবুক ব্যবহার করবেন কি না, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ফেসবুক বিজ্ঞাপনমুক্ত সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক সংস্করণ নিয়ে বাজার গবেষণা শুরু করেছে। এখন ফেসবুক ব্যবহার করতে টাকা লাগে না বলে ফেসবুক ব্যবহারকারী বাড়ছে। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে ফেসবুকের বিশেষ সংস্করণ চালু হলে ব্যবহারকারী বাড়ানো যাবে কি না, সে বিষয়টিও বিবেচনা করছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
ফেসবুকের ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাতে ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগেও ফেসবুক এ ধরনের গবেষণা করেছে। তবে সম্প্রতি ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’ ডেটা কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রাইভেসি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে ফেসবুক। এরপরই অর্থ খরচ করে ফেসবুকের সংস্করণ চলবে কি না, সে বিষয়টির ওপর বেশি জোর দিয়েছে ফেসবুক। এ পরিকল্পনা এখনো সামনে এগিয়ে নেওয়া হবে কি না, এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি।
অর্থ খরচ করে ফেসবুক চালাতে হবে বা এ ধরনের কোনো সংস্করণ আসবে কি না? এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। তবে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ ও প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ বিজ্ঞাপন রেখেই ফেসবুক চালানোর পক্ষে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আয় ঘোষণার সময়ে তাঁরা বলেন, বিজ্ঞাপনযুক্ত বর্তমান ফেসবুকের ব্যবসার মডেলটিই বেশি উপযুক্ত। কারণ, এতে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। বিনা মূল্যের বলে সব ধরনের আয়ের মানুষই ফেসবুক ব্যবহার করতে পারেন। অবশ্য, তাঁরা এও বলেন, এটাই ফেসবুকের ব্যবসা চালানোর একমাত্র পথ নয়।
স্যান্ডবার্গ বলেন, ‘ফেসবুক থেকে অর্থ আয়ের আরও নানা উপায় নিয়ে চিন্তা করছি আমরা। এর মধ্যে সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক পদ্ধতিও আছে। আমরা সব সময় সব ধরনের বিষয়গুলো বিবেচনা করে দেখি।’ গত মাসে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি জের ধরে মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে হাজির হতে হয়েছিল মার্ক জাকারবার্গকে। তিনি সেখানে বলেছিলেন, সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক মডেলের জন্য দরজা খোলা আছে। তবে ফেসবুকের একটি সংস্করণ সব সময় বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ফেসবুক থেকে অনৈতিকভাবে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক নির্বাচনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রথম এ বিতর্কের সূচনা হয়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমেরিকান নাগরিকদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছিল তথ্য বিশ্লেষণ করার প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। এ ক্ষেত্রে ফেসবুকের কোটি কোটি ব্যবহারকারীর প্রোফাইল থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলেকজান্ডার কোগানের তৈরি অ্যাপ্লিকেশন ‘দিসইজইওরডিজিটাললাইফ’ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ফেসবুক। এতে ব্যবহারকারীদের তথ্য জোগাড় করার সুযোগ পান ওই অধ্যাপক। ওই অ্যাপ মূলত একটি ব্যক্তিত্ববিষয়ক পরীক্ষা চালাত। কিন্তু যেসব ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই অ্যাপ ডাউনলোড করতেন, তাঁরা আলেকজান্ডার কোগানকে নিজেদের বিভিন্ন তথ্য নেওয়ার অনুমতিও দিতেন। এতে ব্যবহারকারীদের অবস্থান, তাঁদের বন্ধু ও যেসব পোস্টে তাঁরা ‘লাইক’ দিতেন, সে সম্পর্কে জানতে পারতেন মনোবিজ্ঞানের ওই অধ্যাপক।
ওই সময় ফেসবুকের নিয়মনীতির মধ্যেও এ কার্যক্রম অনুমোদিত ছিল। ব্যবহারকারীদের ওই তথ্যাবলি কোগান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছে সরবরাহ করেন। ফেসবুকের নীতিমালা ভঙ্গ করেই এ কাজ করেন তিনি। ফেসবুকের পাঁচ কোটির বেশি ব্যবহারকারীর তথ্য এভাবে বেহাত হয়ে যায়। ওই সময় কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ভোটারদের প্রভাবিত করা যাবে, এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিল। তবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, ২০১৫ সালে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে ওই সব তথ্য মুছে ফেলতে বলেছিল তারা। এ ঘটনার জেরে গত ৩ মার্চ বন্ধ হয়ে গেছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা বন্ধের পর এখন ফেসবুকের নতুন ব্যবসা মডেল নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেসবুকের বিনা মূল্যের সংস্করণের বিকল্প দীর্ঘদিন ধরেই বিবেচনায় আছে জাকারবার্গের। তবে তা পুরোপুরি বর্তমান ব্যবসার পদ্ধতি পরিবর্তন করে নয়। বরং প্রাইভেসি সচেতন আরও বেশি মানুষকে যাতে ফেসবুকে ধরে রাখা যায়, সে ধরনের বিকল্প পদ্ধতির কথা ভাবছেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করে ফেসবুকের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র ব্লুমবার্গকে বলেছে, গত বছরে ব্যবহারকারীর তথ্য কাজে লাগিয়ে প্রচার করা বিজ্ঞাপন থেকে ৪১০ কোটি মার্কিন ডলারের মতো আয় করেছে ফেসবুক। গত বছরে ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ গবেষণায় দেখা গেছে, টাকা খরচ করে ফেসবুক চালাতে বা সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক মডেল ব্যবহারকারীরা গ্রহণ করবে না। তারা ফেসবুককে লোভী, অর্থখেকো নানা দৃষ্টিতে দেখবে। তাই ফেসবুক সব সময় বিনা মূল্যের সংস্করণে থাকবে।
অবশ্য মানুষের আবেগ যে বদলে যাচ্ছে, ফেসবুক তা টের পাচ্ছে। বিশেষ করে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ওই ঘটনার পর ব্যবহারকারীদের কাছে আস্থার বিশেষ সংকটে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যম। বিজ্ঞাপন থেকে ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহের উপায়, ব্যবহারকারীর অনলাইন কার্যক্রম নজরদারি করা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ফেসবুক এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার সঙ্গে সবকিছু করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। রয়টার্স জানিয়েছে, জাকারবার্গ সবকিছু ঠিকঠাক করার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, প্রাইভেসিসহ সবকিছু ঠিকঠাক করবেন। ভুল থেকে শিক্ষা নেবেন।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান হোসেতে ফেসবুকের বার্ষিক এফ ৮ নামের সম্মেলনে জাকারবার্গ বলেছেন, এ রকম আর ঘটবে না। তথ্যের অপব্যবহার ঠেকাতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা জানতে পারবেন, তৃতীয় পক্ষের কোনো ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ তাদের প্রোফাইল থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। নিজেদের সম্পর্কে তথ্য মুছে দেওয়া যাবে। নিজেদের প্রোফাইলে ব্যক্তিগত বিস্তারিত দেওয়া থেকে ভবিষ্যতে বিরত করবে ফেসবুক।
বর্তমানে ফেসবুক তাদের ব্যবসার বিভিন্ন দিকগুলো বিশদ পর্যালোচনা করছে। সম্ভাব্য নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের কাছে আস্থা অর্জন করতে মরিয়া হয়ে উঠছে। এক বছর আগে যা ভাবা যেত না, সে রকম পরিবর্তনও করতে শুরু করেছে। সংবাদে বিশ্বাসযোগ্যতার র্যাঙ্কিং দেখানো, মন্তব্যে আপভোট, ডাউনভোট দেওয়ার মতো নানা অপশন নিয়ে হাজির হচ্ছে।
অবশ্য ফেসবুকের কর্মকর্তাদেরও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ফেসবুকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন চালানো যাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবে গত মাসে ফেসবুকের পরিচালনা কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গ বলেন, বাক্স্বাধীনতার প্রচারে ফেসবুকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন গ্রহণ করবে।
ব্লুমবার্গ, বিবিসি ও রয়টার্স অবলম্বনে
সংগৃহীত সূত্র: প্রথম আলো ডটকম।