সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার এক নারী বলেছেন, ‘বেতন চাইতে গেছি। মাস শেষ হয়ে গেছে। আমি বলছি, আমার বেবিরা না খেয়ে আছে বাংলাদেশে। তো আমার বেতনের টাকাটা দেন। পরে আমারে রুমে আটকা নিয়া উড়াধুরা মাইর।’
সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন ওই নারী। ওই নারী বলেন, ‘ম্যাডাম ছিল, পরে ওনাকে আমি বলছি, মাআম্মা (ও মাগো) দেখেন এভাবে কেন আমারে মারতেছে। বলছে দেখ, আমার করার কিছু নেই। আমি যদি তোর জন্য প্রতিবাদ করতে যাই, তাহলে আমাকে তালাক দিয়ে দেবে।’
নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সৌদি আরবে নারী কর্মীদের না পাঠাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ১১টি সংস্থার জোট বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেশনের নেতারা। এ সময় সৌদিআরবে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা কয়েকজন নারী তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসছেন অনেক নারী। গৃহকর্মী হিসেবে গেলেও তাঁদের সবাই স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেক অর্থ উপার্জনের। কিন্তু অর্থ তো দূরে থাক জীবন নিয়েই টানাটানিতে পড়ে ফিরে এসেছেন বলে জানালেন এই নারীরা।
গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার এক নারীর মা অভিযোগ করে বলেন, ‘মারপিট করে দোতালা থেকে ফালাইয়া দেয়। ফালাইয়া দিয়া আমার মেয়ের পা-টা ভেঙে ফেলায়। আবার মেরুদণ্ডের হাড়ের মধ্যে ওনারা গুতা দিয়ে ছেইচা ওনাকে… (কান্নায় ভেঙে পড়েন)। আমার মেয়েকে ওনারা খুব মারধর করছে। আমার দুনিয়াতে কেউই নাই। আমি একা, খুব গরিব আমি। আমার সন্তানটাকে আইনা দেন।’ ওই নারী সবকিছুর বিনিময়ে হলেও ফিরে পেতে চাইলেন আদরের সন্তানকে।
সৌদি ফেরত আরেক নারীর অভিযোগ, ‘ওরা অত্যাচার করে কোন সময়, যখন বলমু যে দেশে চইলা যামু, এই অত্যাচার করে। আর যখন বলব, আমাদের বেতন দেন, এই দুটায় অত্যাচারটা বেশি করে।’ ওই নারীরা যতটুকু সবাইকে জানাতে পারছেন পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ। অভিযোগ আছে, রিক্রুটিং এজেন্সির মিথ্যা আশ্বাস নিয়েও।
সংবাদ সম্মেলনে আরেক নারী বলেন, ‘আমি যখন অফিসে ফোন দিলাম বাংলাদেশের এজেন্সিতে বললাম যে আমাকে যেভাবেই হোক, আপনি বাংলাদেশে পাঠান নতুবা আপনি আমাকে অন্য জায়গা চেঞ্জ করে দেন। তো তখন বলছে, আমরা যখন পাঠাই এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌঁছাতে পারলেই আমাদের আর কোনো দায়িত্বই থাকে না।’
নির্যাতনের শিকার আরেক নারী বলেন, ‘প্রত্যেকটা এজেন্সি ওয়ালারা বলে যে, তোমরা যাও আমরা খোঁজখবর নেব। ওই খানে যদি তোমরা কষ্টে থাক আমরা তোমাদের দেখব, এই করব, সেই করব। কিন্তু এইটা একেবারেই ভুল। ওখানে যাওয়া পর্যন্তই শেষ। তারপর ওনাদের আর কিছু করার ক্ষমতাই থাকে না।’ সৌদি আরব থেকে এত এত অভিযোগ এলেও সরকার যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করেন সংবাদ সম্মেলনের আয়োজকরা।
সংবাদ সম্মেলনে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিনা রায় বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এবং রিক্রুটিং এজেন্সির পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়, নারী নির্যাতনের ঘটনা খুবই কম। কিন্তু আমরা বলতে চাই, একটি মেয়েও যদি নির্যাতনের শিকার হয় তাঁর জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কিন্তু এই ধরনের ব্যবস্থা আমাদের চোখে পড়ে না।
প্রবাসী অধিকার কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, ‘চুক্তি হয় দুই রকম। একটি হচ্ছে গভর্মেন্টের সাথে যে চুক্তি যেটাকে আমরা বাইলেটারাল অ্যাগ্রিমেন্ট (দ্বিপক্ষীয় চুক্তি) বলি। এখন বাংলাদেশের সাথে এই ধরনের বাইলেটারাল অ্যাগ্রিমেন্ট নেই। সেই জায়গায় সমঝোতা স্মারক আছে।’
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘যদি একটা মেয়েকেও আমরা সৌদি আরবে পাঠাই, সেই দায়িত্ব আমাদের রাষ্ট্রের নিতে হবে। এখানে সংখ্যা কম, একজন-দুজন বলে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। যদি নিরাপত্তা দিতে না পারি তাহলে রাষ্ট্রের পাঠানোর কোনো অধিকার নেই।’ নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা নারীদের সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি তোলা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
তথ্যসূত্র: এনটিভি বিডি ডটকম।