সাধারণ তরুণরা শিক্ষা জীবন শেষ করে যখন সারা জীবনে অর্জিত শিক্ষা সনদগুলো হাতে নিয়ে অফিসে অফিসে চাকরির সন্ধান করে, তখন সাহসী তরুণরা নতুন পথ তৈরি করে; উদ্যোক্তা হয়ে নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করে। অধিক সাহসী কেউ কেউ শিক্ষা জীবন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষাও করে না। আর সমসাময়িক সময়ে তরুণদের মধ্যে চাকরি প্রত্যাশীর চেয়ে এই উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। নানামুখী সচেতনতা, অনুপ্রেরণা এবং সাহসীকতা এক্ষেত্রে তরুণদের অনুপ্রেরণা যোগাতে অনুঘটকের ভুমিকা পালন করে।
তবে শতকরা ৯০টি নতুন উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। কেননা তরুণ উদ্যোক্তারা কোন রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই কাজ শুরু করে থাকে। আর সে কারণেই ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এমন অনেক ভুল সিদ্ধান্ত বা কাজ আছে যার কারণে নতুন উদ্যোগ কখনো কখনো সম্পূর্ণ ভেস্তে যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এমন ভুলগুলোকে উদ্যোক্তারা কখনো ভুল বলে মনে করে না। আজ তরুণ উদ্যোক্তাদের এমন কিছু ভুল এবং তার সমাধানের কথা বলতে চেষ্টা করব।
স্টার্টআপ আইডিয়ার প্রতি প্রেম
তরুণ উদ্যোক্তাদের সিংহভাগ আসলে ব্যবসা করতে আসে না, আসে একটা অভিনব স্টার্টআপ আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে। স্বভাবতই প্রাথমিক অবস্থায় ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি লাভের চেয়ে অভিনব আইডিয়া বাস্তবায়ন করায় তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে। আর তাই যে কোন ব্যবসার প্রধান বিষয়, সার্বিক বিষয়ের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা বাদ দিয়ে তাদের মনোযোগ একটি নির্দিষ্টি বিষয়ে প্রবিষ্ট থাকে। তারা মনে করে এই অভিনব আইডিয়ার সফল বাস্তবায়ন তাদের সাফল্য এনে দেবে। কিন্তু এই ভাবনা যে মস্ত বড় ভুল তা তারা ভাবতেই পারেন না। একটি পণ্য বা সেবা বাজারজাত করার আগে বাজারে তার চাহিদা এবং এই চাহিদার বিপরীতে মুনাফা করার সম্ভাব্যতা যাচাই করে নিতে হয়। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হয়।
অর্থ ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
যেকোন নতুন ব্যবসায় অর্থের সংকট থাকে। তবে সেই সংকট নিশ্চয়ই ব্যবসা শুরুর প্রথম দিন থাকে না। অর্থাৎ উদ্যোক্তার কাছে ব্যবসা শুরু করার নূন্যতম অর্থ থাকলেই সে স্টার্টআপ শুরু করে। আর শুরু করার প্রথম কয়েক দিন ব্যবসায় অধিক মনোযোগী হয়ে দুই হাত খুলে বিনিয়োগ তথা খরচ করতে থাকে। অনিবার্যভাবে এই অধিক খরচ অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবসায় সংকট সৃষ্টি করে। অথচ শুরুতে অধিক খরচ যে একটা ভুল সিদ্ধান্ত তা অনেক উদ্যোক্তা জানে না। কাজেই ব্যবসায় শুরুতে অর্থের যথাযথ ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
নিজের ভাবনার কার্যকরী সংশয়
নতুন স্টার্টআপ সবসময় চিন্তা ভাবনা করে শুরু করা ভাল। তবে অধিক আত্মবিশ্বাস কখনো কখনো ভরাডুবির কারণ হয়। অর্থাৎ কেবলমাত্র নিজের চিন্তা ভাননা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যবসায় নেমে পড়া উচিত না। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া সবচেয়ে জরুরী। এক্ষেত্রে নিজের সব ভাবনায় বিশ্বাস না রেখে কাজ শুরু করার আগে পরখ করে দেখা ভাল। নিজের ভাবনা সম্বন্ধে সংশয় আপনাকে যথার্থ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগীতা করবে।
কেন আমার পণ্য বা সেবা অন্যরা কিনবে?
অধিকাংশ তরুণ উদ্যোক্তা কোনো গবেষণা না করেই নতুন একটি পণ্য বাজারে নিয়ে আসে আর লোকসানের মুখে পড়ে। নতুন এই পণ্যটির বাজারে কোনো চাহিদা আছে কিনা, আদৌ কেউ কিনবে কিনা এগুলো আগে ভাবতে হবে। কোন একটি নতুন পণ্যের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, অন্য কারো পণ্য হলে আমি নিজে বাজার থেকে এই পণ্যটি কিনব কিনা। এই একটি প্রশ্ন আপনা থেকে অনেকগুলো উত্তর বের করে আনবে যা ব্যবসা সফল করতে কাজে লাগবে।
দ্রুত শুরু করা
কোন ব্যবসার পরিকল্পনা করে বসে থাকা বোকামি। যত দ্রুত সম্ভব শুরু করে দেওয়া উচিত। কেননা আজ যে বাজার ও চাহিদা বিবেচনা করে ব্যবসার পরিকল্পনা করা হবে, ছয় মাস পর বাজারে সেই চাহিদা নাও থাকতে পারে। কেননা ভবিষ্যৎ সবসময় অনিশ্চিত। তাছাড়া মনে রাখতে হবে নতুন নতুন ব্যবসার পরিকল্পনা কেবল আপনি একা নয়, আপনার মত হাজারো মানুষ করছে। আপনি দেরি করলে একই ধরণের পণ্য বা সেবা নিয়ে অন্য কেউ ব্যবসা শুরু করবে না তার কী নিশ্চয়তা। কাজেই পরিকল্পনা করে মোটেও কালক্ষেপণ নয়।
নিজেকে মালিক ভাবা
অধিকাংশ উদ্যোক্তা ব্যবসা শুরু করার পর নিজেকে তার প্রতিষ্ঠানের মালিক ভাবতে শুরু করে। অবশ্য আইনত তিনি তার প্রতিষ্ঠানের মালিকই। তবে এই ভাবনা তাকে অগোছালো করে তোলে। যেমন নিজের প্রতিষ্ঠান, তার জন্য কোন বাধাধরা নিয়ম নেয়। তিনি যখন ইচ্ছা খরচ করতে পারেন, যখন ইচ্ছা অফিস আসতে পারেন ইত্যাদি। এমন ভাবনা অচিরেই ব্যবসায় লোকসান বয়ে আনবে। কর্মীদের কাজের মনোযোগ নষ্ট করবে। সাফল্য পেতে নিজেকে নিজের প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী ভাবতে হবে। অন্যান্য কর্মকর্তার মত নিময় মেনে অফিস করতে হবে, এমনকি স্কেল অনুসারে মাস শেষে বেতন ভাতা নিতে হবে, তাহলেই আসবে সাফল্য।
যৌথ মালিকানায় কাজের বন্টন
অনেক স্টার্টআপ শুরু হয় কয়েকজন বন্ধুর যোগানো অর্থ দিয়ে। এক্ষেত্রে সব বন্ধু সমান বিনিয়োগ করে না, করলেও সব বন্ধু সমান শ্রম দিতে পারে না। তাহলে প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বা লভ্যাংশ বন্টন হবে কোন নীতিতে? শুরুতে সবার খুব উদ্যম থাকে তাই এসব নিয়ে খুব একটা ভাবা হয় না। কিন্তু ব্যবসা বড় হওয়ার সাথে সাথে এগুলো প্রকট সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। অনেক সম্ভাবনাময় স্টার্টআপ এই সুষ্ঠু বন্টনের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। এমন কী বন্ধুত্বের সম্পর্কও নষ্ট হয়েছে। সুতরাং যৌথ মালিকানায় ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের বিষয়গুলো আগে সমাধান করুন।
একটি নতুন স্টার্টআপ করতে গিয়ে তরুণ উদ্যোক্তারা যেসব ভুল করে থাকে উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো তার মাত্র কয়েকটি। এমন আরও অসংখ্য ভুল সিদ্ধান্ত আছে। অন্য কোন নিবন্ধে সেসব নিয়ে আলোচনা করব। তবে মোটকথা, ব্যবসার শুরুতে এসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখলে ব্যবসায় সাফল্যের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে বহুগুণ। আরও অধিক পরামর্শের জন্য বিশ্বস্ত অভিজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ রইল।
মোস্তাফিজুর রহমান
তথ্যসূত্র: ইয়ুথ কার্নিভাল ডট ওআরজি।