‘বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত ভালো।…আমাদের দেশ সম্পদশালী। দেশি বিনিয়োগের কোনো ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা পিছিয়ে নেই। কেবল বিদেশি বিনিয়োগের ওপরই একটা দেশ নির্ভরশীল হতে পারে না।’ কথাগুলো বলেছেন কাজী নাবিল আহমেদ। তিনি জেমকন গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান।
জীবনের সিঁড়িগুলো কীভাবে টপকে এসেছেন, সেই গল্প। জানালেন, স্বপ্নের বীজটা বুনে দিয়েছেন তাঁর বাবা কাজী শাহেদ আহমেদ। স্বপ্নটাকে আরো পরিণত করার চেষ্টা করে চলেছেন তিনি।
দিনের শুরু হয় যোগব্যায়ামের মাধ্যমে। তার পর ঘরে থেকেই অফিসের কাজ শুরু করে দেন। এরই ফাঁকে চলে পরিবারের লোকজনদেরও খোঁজ-খবর নেওয়া। এখনো যৌথ পরিবার টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা। এক ছাদের নিচেই থাকেন বাবা-মা, ভাইদের নিয়ে।
বাবা কাজী শাহেদ আহমেদ ছিলেন সেনাবাহিনীতে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে ছিলেন, ১৯৭৯ সালে অবসর নেন তিনি। তার পর ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম প্রতিষ্ঠান ক্যাসেল কনস্ট্রাকশন। তার পর হাঁটি হাঁটি পা পা করে জেমকন গ্রুপে পরিণত হয়েছে।
নাবিলের মা আমিনাহ আহমেদ। ঘর-সংসার সামলেও নিয়মিত রেওয়াজ করেন তিনি। তাই গানের গলাটাও এখনো বেশ ভালো। সঙ্গে ব্যবসাও দেখেন। আবার পারিবারিকভাবেই সবাই সংস্কৃতি আর খেলাধুলার সঙ্গেও জড়িত।
ছোটবেলায় ফুটবল খেলার প্রতি বড্ড বেশি ঝোঁক ছিল তাঁর। প্রিয় খেলোয়াড় ব্রাজিলের কালোমানিক পেলে। বড় হয়ে ফুটবল খেলোয়াড় হবেন—এমনটাও ভেবেছেন বহুদিন।
তবে সময়ের সঙ্গে তো কত কিছুই বদলে যায়। এখন তাঁর শখ বই পড়া। চোখের সামনে যা পান, তা-ই পড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। তাঁর কাছে অবসর কাটাতে বইয়ের বিকল্প নেই। তাই নিজের সন্তানদেরও বই পড়তে উৎসাহ দেন।
অনেকটা নিয়ম করেই পরিবারের সবাইকে সময় দেন। কথা দিলে তা রাখেন, এটাও তো মস্ত বড় গুণই। সব মিলিয়ে ভালো থাকতে আর আশপাশের মানুষকে ভালো রাখতে যা যা গুণ দরকার, তার সবই নাকি আছে তাঁর মধ্যে।
রাজধানীর ধানমণ্ডিতে তাঁর জন্ম। এখানেই বেড়ে ওঠা। স্কুল-কলেজও ঢাকাতেই। অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে তাঁর। রাজনীতিক মাহী বি চৌধুরী তাঁর সহপাঠী ছিলেন।
এইচএসসি শেষ করে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই অর্থনীতির ওপর নেন উচ্চশিক্ষা; গ্রহণ করেন ১৯৯২ সালে। আর যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার সময়ই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গেও। পরিচিত হন এক অসাধারণ রাজনীতিবিদের সঙ্গে।
তিনি জিমি কার্টার। তাঁর সঙ্গে নানা আলাপে রাজনীতিতে কাজী নাবিলের আগ্রহটা আরো বাড়ে।
১৯৯২ সালেই দেশে ফিরে আসেন। তার পর বাবার আগ্রহ আর উৎসাহে নিজেদের ব্যবসার দেখভাল শুরু করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে শেষ পর্যন্ত আজকের কাগজ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন।
১৯৯৮ সালে পড়াশোনার জন্য আবার চলে যান ইংল্যান্ডে। ফিরে আসেন পরের বছর। আবার জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়।
নিজেদের ব্যবসা দিয়েই কর্মজীবন শুরু হয় তাঁর। তার পর বাইশ-তেইশ বছরে অনেক কিছুই শিখেছেন তিনি। অনেক খারাপ সময়ও গেছে। ঠিকঠাকমতো লেগে ছিলেন বলেই একটা সময় টের পান, একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছেন তিনি।
ব্যবসার সাফল্য নিয়ে নাবিল আহমেদ বলেন, ‘আমরা ক্রেতা-ভোক্তার সন্তুষ্টির বিষয়টি সব সময় মাথায় রাখি। আমাদের নীতি হচ্ছে, আমরা কোনো সময় খারাপ জিনিস বিক্রি করব না। আমরা সব সময় ভালো পণ্য গ্রাহকদের দিতে চাই। এভাবেই আমরা আমাদের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সব সময় বিকল্প কৌশল, পরিকল্পনা ভেবে রাখি, যদি কোনোটি সম্ভব না হয়, তাহলে অন্যটি অ্যাপলাই করি। এটা ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো চর্চা।’
ব্যবসার বাইরেও তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি রাজনীতিবিদ। ২০০৩ সাল থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বর্তমান সংসদেরও একজন সদস্য। যুক্ত আছেন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও। রাজনীতিতে নামলেই ভালোভাবে সব শ্রেণির মানুষকে জানা যায় বলে মনে করেন তিনি।
এখন যাঁরা নতুন ব্যবসায় আসতে চান, তাঁদের জন্য তাঁর একটাই পরামর্শ। জেনে-বুঝে তার পর শুরু করতে হবে। যেখানে আগ্রহ, প্রয়োজনে সেই সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানে কাজও করতে হবে। হাতে-কলমে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
নাবিল বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি এখনো গ্রিনফিল্ড পর্যায়ে রয়েছে। এখনো অনেক কিছু করার সুযোগ আছে।’
তাঁদের ব্যবসার শুরুটা ছিল ছোট পরিসরেই। তার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। সব মিলিয়ে এখন হাজার পাঁচেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন তাঁদের প্রতিষ্ঠানে।
নাবিল আহমেদ বলেন, ১৯৭৯ সালে বাবা শাহেদ আহমেদ ও মা আমিনাহ আহমেদ ব্যবসা শুরুটা করেন। ক্যাসেল কনস্ট্রাকশন কোম্পানি দিয়ে শুরু হয় ব্যবসার। সেটা এখনো রয়েছে। ১৯৮২ সালে চালু হয় জেমিনি সি ফুড। ১৯৮৬ সালে জেমকন চালু হয়, ইঞ্জিনিয়ারিং পোল ফ্যাক্টরি যেটা। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে খবরের কাগজ সাপ্তাহিক ও দৈনিক। এর পর আরো ফ্যাক্টরি করা হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে কাজী কাজী টি, ২০০২ সালে মিনাবাজার, ২০০৩ সালে জেম জুট চালু করা হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি আবাসন ব্যবসার কাজ শুরু করেছি। জেমকন সিটি, এটাও চার বছর হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে নন-প্রফিট ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্ট বাংলাদেশ। দুই বছর আগে শুরু করেছি ইংরেজি পত্রিকা ঢাকা ট্রিবিউন।’
তাঁদের প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যই হচ্ছে ভালো কিছু করা। গ্রাহক বা ভোক্তার কোনো অভিযোগ শুনতে রাজি নন তিনি। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠানের পণ্যের মানের প্রশ্নে কোনো ছাড় দেন না। আর যা-ই করেন, একটা নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেন। ভাবেন, নতুন স্বাদ, নতুন গন্ধ না পেলে গ্রাহকরাই বা পকেটের পয়সা খরচ করবেন কেন!
নাবিল বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত ভালো। বিদেশি বিনিয়োগের আগ্রহের ক্ষেত্রে গোল্ডম্যানস্যাকসের মূল্যায়নে ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকাথেকে প্রচুর বিনিয়োগকারী এ দেশে আসছে। বিনিয়োগের জন্য প্রধান তিন শর্ত থাকে—একটা হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন, আইন-কানুন ঠিকমতো অনুসরণ করতে হবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ থাকতে হবে। এই শর্তগুলো পূরণ করতে পারলে এ দেশে প্রচুর বিনিয়োগকারী আসবে। আমাদের দেশ সম্পদশালী দেশ, দেশি বিনিয়োগের কোনো ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা পিছিয়ে নেই। কেবল বিদেশি বিনিয়োগের ওপর একটা দেশ নির্ভরশীল হতে পারে না।’
ব্যবসায় আরো যেসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, সেগুলোও খোঁজ-খবর করতে হয়। আবার সংসদ সদস্য হিসেবেও আছে নানা দায়িত্ব। সবকিছু মিলিয়ে ব্যস্ততার মাঝেই কাটে তাঁর সময়। কাজের ক্ষেত্রে বাসা, অফিস সবই তাঁর কাছে একই। আর এত কিছুর সঙ্গে তাল মেলাতে প্রযুক্তি তাঁর বড় ভরসা।
ব্যবসাটা তাঁর জীবন-জীবিকার জন্য। কিন্তু রাজনীতির প্রতি অন্য রকম ভালোলাগা আছে তাঁর। বিশ্বাস করেন, সত্যি সত্যিই মানুষের জন্য কিছু করতে চাইলে রাজনীতির মাধ্যমে অনেক কিছু করা সম্ভব। আর মানুষের কল্যাণে কিছু করার চেয়ে গর্বের আর কী-ই বা আছে।
তাঁর প্রতিষ্ঠানে এখন প্রায় হাজার পাঁচেক কর্মী আছেন। তাঁদেরও নানা রকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাঁদের সুযোগ-সুবিধাগুলোও দেখেন গুরুত্ব দিয়ে।
আর একসময় যে ফুটবলের জন্য পাগল ছিলেন, এখন তা-ও খেলা হয় না। সময় পেলে গলফটা খেলা হয় কখনো-সখনো।
তথ্যসুত্র: এনটিভি বিডি ডটকম।