সাধারন মানুষের অসাধারন হয়ে ওঠার পথের বাঁকে থাকে ছোট ছোট অনেক গল্প। যে গল্প বিশ্বাসের, যে গল্প পরিশ্রমের, যে গল্প ধৈর্য্য ধারনের, যে গল্প সাহসীকতার। ঘুরে দাড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় পথচলা। নানা বাধা আসে চলার পথে। ঝুঁকি সামলে নিতে না নিতে আবার ঝুঁকি আসে। পথচলতে গিয়ে থেমে যাওয়া মানে তো সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে আবার উঠে দাড়াতে হয়। সাফল্য তাদের কাছেই ধরা দেয় যারা থেমে গিয়েও পথের শেষ দেখতে এগিয়ে যায়। তেমনিই একজন মেডিভেট এ্যানিমেল হেলথ এর প্রতিষ্ঠাতা মঈনুল আহসান।
চিংড়িখালী, মোড়েলগঞ্জ জেলার এক নিভৃত গ্রাম। যেখানে সহজ সরল বেড়ে ওঠা। ছোট বেলার ছোট স্বপ্ন তার প্রবাসী হওয়া। যদিও সে স্বপ্নের পিছু ছুটে মাঝপথে স্বপ্নটাকে হারিয়ে ফেলেছেন। এসএসসি পাশের পর ১৯৯৭ সালে পড়াশুনার জন্য ঢাকায় আসা। তখনও চোখে স্বপ্ন বিদেশ যাত্রা। এইচএসসি পাশের পর কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং পড়তে ইন্ডিয়ার হায়দ্রাবাদ চলে যাওয়া। ফিরে এসে কিছু দিন যেতে না যেতেই দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিকাল এ সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। কিন্তু সেখানে তার কাজ তাকে সন্তুষ্ট করতে পারছিল না। সারা দিন বসে থেকে কাজ করতে বিরক্ত লাগত। মন চাইত বাইরে ঘুরে ফিরে করা যায় এমন কোন কাজ করতে। হটাৎ করেই অব্যাহতি দিলেন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যোগ দিলেন এ্যাভেনটিস ফার্মা লিমিটেড এ ফিল্ড অফিসার পদে। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স কিছু দিনের মধ্যেই। বছর পার হতে না হতেই বাংলাদেশে ইংল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিসটিক ফার্মাসিউটিক্যালস এ যোগ দেন এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে সাভারে। লেগে থাকার সাফল্য হিসেবে সল্প সময়ে পদোন্নতি পেয়ে রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। ঠিক সেই সময় সখ্যতা গড়ে ওঠে তরু নামে এক জনের সাথে। যিনি তাদের কোম্পানীর ছাপার কাজগুলো কন্টাক্টে নিয়ে সম্পন্ন করতেন বিভিন্ন প্রেস থেকে। মামা বলেই ডাকতেন তাকে। ইতিমধ্যে খুলনাতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন বিচক্ষন মেয়ে শারমিন লায়লা অনির সাথে। তরু মামার সাথে সম্পর্ক যখন সুসম্পর্কে রুপ নিল, বিশ্বাসের সবটুকু যখন তাকেই করা যায় ঠিক তখনই সুযোগ এলো ব্যবসার।
ঠিক হল দুজন মিলে প্রিন্টিং প্রেস করবেন। বিশ লক্ষ টাকার যোগান দিতে হবে তাকে। বাকীটা তরু মামা ব্যবস্থা করবেন। শুরু হল প্রানান্তকর প্রচেষ্টা। ধাপে ধাপে দুই, তিন, চার লক্ষ করে টাকা দিলেন তরু মামার হাতে। মামাও আস্থার সাথে আশ্বাস দিয়ে এগোতে থাকলেন। শেষটাতে এসে কোন ভাবেই টাকা ম্যানেজ করতে পারছিলেন না, যখন তার প্রত্যাশার প্রেসের মেশিন বন্দরে। কোম্পানী থেকে ব্যক্তিগত প্রয়োজন দেখিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা ঋণ করলেন। সেই টাকাও তুলে দিলেন তরু মামার হাতে। ব্যবসায়িক স্বপ্নে যখন বিভোর ঠিক মত অফিস করাও ছেড়ে দিলেন। কিছু দিন পরেই আসছে সুদিন। মামা শেষ মুহুর্তে এক লক্ষ টাকা চাইলেন। যখন তার হতে কোন টাকাই ছিল না। ওদিকে বন্দরে এসে আটকে আছে প্রেসের মেশিন।
তিন দিন পর তার মেশিন আসবে। সকাল সকাল মামার পল্টন অফিসে গেলেন। তালা দেওয়া। ফোনও বন্ধ। সেই তালা আর ফোন খুলল না কয়েক দিনেও। মামা তার বিশ্বাসকে পুুঁজি করে হাতিয়ে নিয়ে গেছে সবটা। বুঝতে বাকি রইল না আর। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। নিজেকে সান্তনা দেওয়ার মত অবশিষ্ট কিছু রইল না। চরম হতাশায় মুষড়ে পড়লেন। অবস্থা এমন যে পারলে আত্মহত্যা করেন। পেছন ফিরে তাকালেন। সাহস দিলেন তার স্ত্রী। ততদিনে কোম্পানী থেকে তাকে ডাকা হল, অফিসে অনুপস্থিতির জবাবদিহিতা, ঋণের টাকার বিষয় নিয়ে। সমস্ত ঘটনা বললেন তিনি। কোম্পানী তাকে দুই বছরের জন্য অবসরে পাঠিয়ে পরবর্তীতে চাকুরীর সুযোগ রেখে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিল।
ঢাকাতে থাকা হল না। কোন কিছুর মধ্যেই মনোনিবেশ করতে না পারায়। স্ত্রীকে নিয়ে চলে এলেন খুলনায়। প্রতিটা দুঃসহ যন্ত্রনার দিন শুরু হল। একদিকে কোন কিছু করতে না পারা। অন্যদিকে প্রচন্ড হতাশা আর বিশ্বাস ভঙ্গের খেলা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। শারমিন লায়লা যথাযত সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। যদিও সে নিজেও ষ্টুডেন্ট ছিলেন তখন। স্বামীর পাশে থেকে সর্বোচ্চ সাহস দিয়ে এগিয়ে রাখলেন শত বাধা উপেক্ষা করে। চাকুরীর জন্য চেষ্টা করতে করতে মাঝখানে একটি বছর চলে গেল। অবশেষে যোগ দিলেন ব্রাক ব্যাংক এ সিনিয়র অফিসার পদে। কিছুটা হলেও ঘুরে দাড়াতে পারলেন এবার। খুলনার হাদিস পার্কে বসে প্রতিবেশী মোঃ বদিউজ্জামান আবার স্বপ্নটাকে নাড়া দিলেন। উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন আবারও পেয়ে বসল তাকে। পূর্বের ক্ষতি ভুলে যেতে না যেতে আবারও ঝুঁকি নিলেন। বিশ্বাস এবারও তাকে করতে হল। কারন যে ব্যবসার পরিকল্পনা তারা করলেন তার মার্কেটিং ছাড়া অন্য কিছুই জানা ছিল না মঈনুল আহসানের।
বিশ্বাস ঠিকই করলেন। ঠকলেন না এবার। বদিউজ্জামান কথা রাখলেন। ভাগ্য সহায় হল। লক্ষাধিক টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু হল। বদিউজ্জামানের পূর্ব থেকে ওষুধ তৈরীর সকল বিষয়গুলো সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ছিল। ঢাকা থেকে কেমিক্যাল নিয়ে এসে শুরু হল ছোট্ট পরিসরে। শুরু হল এগিয়ে চলার গল্প। নিজের ব্যবসায়িক কাজের চাপ বাড়ায় এক বছরের যাত্রাপথে মঈনুল আহসান কে চাকুরী থেকে অব্যাহতি নিতে হল। ব্যাংকে চাকুরী করার সুবাদে ঋণ পেতে তেমন বড় কোন বেগ পেতে হল না। নিজস্ব জায়গাতে ফ্যাক্টরি হল। এগিয়ে চলার এ সময়েই ব্যবসা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেন। ফ্রোজেন ফুড রপ্তানি করনের উদ্দেশ্যে খুলনার খাঁনজাহান আলী ব্রিজ সংলগ্ন হাজী আব্দুল মালেক এর পুরাতন একটি ফ্যাক্টরী ভাড়া নেন। চার ধাপে বিদেশে চিংড়ি মাছ রপ্তানীও করেন। লাভের মুখ দেখার মাঝপথে হটাৎ করে মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতায় পড়ে। রপ্তানীর জন্য কোলেষ্টরে মজুদ করা সম্পূর্ণ মাছ লুট হয়। কোটি টাকা ক্ষতির মুখে সবটা হারিয়ে ফিরে আসেন ফ্রোজেন ফুডের ব্যবসা থেকে।
ব্যবসা শুরুর ছয় বছরে এনিমেল হেলথ এ খামারীদের আস্থার আরেক নাম মেডিভেট। গবাদিপশু ও হাস-মুরগির রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে মেডিভেট এর সলুউবল পাউডার ও লিকুইড এখন খামারীদের সফলতার গোপন সুত্রেও পরিণত হয়েছে। তারই কোম্পানীতে বর্তমানে অর্ধশতের বেশী লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তার প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করছেন তারা বেশ পরিতৃপ্তি নিয়েই কাজ করছেন। কর্মীদের জন্য সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা রেখে স্থায়ীকরন ও পেনশনের ব্যবস্থা রেখেছে কোম্পানী। তাছাড়া সরকার ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে জনহিতকর নানা কাজের সাথে জড়িত তার প্রতিষ্ঠান।
আগামীর উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ চাইতে মঈনুল আহসান বলতে শুরু করেন, চোখে স্বপ্ন থাকতে হবে। লেগে থাকতে হবে যে কোন কাজে। আর সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তা হচ্ছে জানতে হবে, শিখতে হবে। জানা ছাড়া, শেখা ছাড়া কোন কিছুই ভাল ভাবে করা সম্ভব নয়। আর মানুষকে অন্ধ বিশ্বাসও করা যাবে না। যাকে বিশ্বাস করে দায়-দায়িত্ব দিতে হবে তার সম্পর্কে ভালভাবে খোঁজখবর করতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে কৌশলী হয়ে। বুদ্ধিমানের মত খাটতে হবে। সততার সাথে বিপদ মোকাবেলা করতে হবে। আল্লাহর কাছে সবসময় আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। সফলতার জন্য ধৈর্য্য ধরতে হবে। এবং হাসিমুখে সবসময় ভাল ব্যবহার করতে হবে।
মো: মাসুদুর রহমান মাসুদ
উদ্যোক্তার খোঁজে ডটকম।