জীবনে চলার পথে আসে নানা বাঁধা। পথচলার শুরু হতে না হতেই থমকে দাঁড়াতে হয় কখনও কখনও। বুদ্ধিমত্তা আর কৌশল প্রয়োগ করে পেরিয়ে যেতে হয় সেই বাঁধা। অক্লান্ত পরিশ্রম বয়ে আনে সেই পথে সফলতা। আর এই পথের শেষ দেখতে যারা এগিয়ে যায় তারা অন্য সবার থেকে বেশী আত্মবিশ্বাসী হয়। এগিয়ে থাকে তারুন্যের যাত্রায়। সেই সাথে এই মানুষগুলো হয় অন্যের জন্য অনুপ্রেরণা। তেমনই একজন তরুন উদ্যোক্তা কে.এস.এম সপ্নীল চৌধুরী সোহাগ।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার উলা গ্রাম। দুরন্ত বালক দাপিয়ে বেড়িয়েছে খেলার মাঠ থেকে সর্বত্র। এ পাড়া থেকে ও পাড়া কোথায় নেই তার পদচারনা। গ্রামের মানুষের মধ্যমনি ছিলেন ছোট বেলা থেকেই। বাবা ছিলেন আর্মি অফিসার। লেখাপড়ার শুরুটা হয় ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট স্কুল থেকে। এরপর নড়াইল তারপর ঝিনাইদহ প্রি ক্যাডেট। বাবার চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় লেখাপড়া করলেও অষ্টম শ্রেনীতে বৃত্তি তুলে নিতে ভুল হয়নি। নড়াইল দিঘলিয়া আদর্শ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি। কম্পিউটার এন্ড সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং এ বিএসসি সমাপ্ত করে বর্তমানে এমএসসি চলমান।
ইটকাঠ পাথরের যান্ত্রিক ঢাকায় আসা পড়াশুনার সুবাদে। কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে কিভাবে আত্মকর্মসংস্থান করা যায় সেটা খুজতেই শুরু হয় টিউশনি করা। নিজের পড়াশুনার খরচ নিজে যোগানোর পরেও হাতে থাকা কিছু কিছু টাকা জমানো শুরু করেন। কিন্তু হটাৎ করেই টিউশন চলে যায়। এভাবে যে জীবন চলবে না বুঝতে বাকি থাকে না। তখন থেকেই মুলত বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। ২০১০ সাল। তখনও ঢাকা শহর অচেনা। অচেনাকে চেনার যাত্রা শুরু হয় টিউশনি করে জমানো মাত্র ২২,০০০ টাকা হাতে নিয়ে।
নিজেকে কিভাবে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরী করা যায় সে ভাবনা ভাবতে ভাবতে বন্ধুর পরামর্শ পছন্দ হয়। মজার বিষয় হচ্ছে যে বন্ধু ব্যবসার আইডিয়া দিয়েছিল সে বিস্তারিত কিছুই জানত না। শুধু রাস্তাটা বলে দিয়েছিল। পরের দিন ভার্সিটির ক্লাশ শেষ করে দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে আইডিয়া কে বাস্তবায়নের পথে নেমে পড়েন। কাছে থাকা ২২০০০ টাকাই সম্বল। পন্য কিনে কোথায় বিক্রি করবেন নেই সে সম্পর্কেও কোন ধারনা।
গুলিস্থান এলাকায় খুঁজেও পেলেন তার ব্যবসার জন্য পাইকারী পন্য ক্রয়ের জায়গা। কিন্তু কোয়ালিটি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। সর্বপ্রথম ১২০০০ টাকার টিশার্ট কিনলেন। যে বাসায় থাকতেন সেখান থেকেই শুরু হল যাত্রা। বন্ধু আর সল্প সময়ের পরিচিত জনদের কাছে তার পণ্য বিক্রি শুরু করলেন। কিছু দিনের মধ্যে প্রচার বাড়তে লাগল তার ক্রেতাদের কাছ থেকেই।
প্রথম চালানের মাল বিক্রি করতে না করতেই ধাক্কা। একজনের সাথে সল্পসময়ের পরিচয়। সেই লোক কিছু প্রোডাক্ট সোর্সিং করে দেওয়ার কথা বললেন ভাল কোয়ালিটির। কিন্তু যা দিলেন তা ছিল রাশিয়ান বায়ারের প্রোডাক্ট। বাংলাদেশের মানুষের পোশাকের সাইজ থেকে অনেক বড়। তার ওপর ছেড়া কাটা রিজেক্ট প্রোডাক্ট প্যাকেট করে দিয়েছিল। বড় ধরনের ক্ষতি হল। মনটা ভেঙে গেল। হতাশ হলেন দারুন ভাবে। ভাবলেন কোন ভাবেই এ ব্যবসা করবেন না। আশপাশে সব অসৎ মানুষ। এদের মাঝে থেকে ব্যবসা করা সম্ভব নয়।
থেমে গিয়েও থামলেন না। বড় হওয়ার জিদটা আরও বেশী কাজ করল। হটাৎ করেই ভাবলেন অসৎ মানুষের ভীড়ে সততা নিয়ে ব্যবসা করাটা অবশ্যই ভাল কিছু হতে পারে। তার প্রতি ক্রেতাদের আস্থা তৈরী হতে বেশী সময় লাগবে না। ধাক্কাটাকে পজিটিভ ভাবে নিয়ে শুরু হল সাবধানে পা ফেলা। পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর জন্য নতুন পথের সন্ধান করা। সেই সাথে কোন জায়গা থেকে আরও ভাল কোয়ালিটির প্রোডাক্ট সংগ্রহ করতে পারবে সেদিকে নজর দেওয়া। অন্যদিকে নিজের পড়াশুনা আর টিউশন তখনও চলছে।
প্রতিদিন সকালে উঠে ভার্সিটি, তারপর সেখান থেকে পাইকারী মার্কেটে গিয়ে আনকমন ষ্টাইলিশ পন্য খুজে বের করে বাসায় এনে সুতা কাটিং করে সেগুলোতে মেটাল ও বাটন সংযুক্ত করে আয়রন করা, সাথে হ্যান্ড ট্যাগ ও প্যাক চেঞ্জ করে দর্শনীয় উপস্থাপন। তত দিনে মিরপুরের ফুটপাতের পোশাক বিক্রেতারা তার খোঁজ পেয়ে গেছে। দিন দিন পন্য বিক্রয়ের জায়গা বাড়ার সাথে পন্য পাইকারী কিনে আনার পর সেটিকে দর্শনীয় রুপ দিতে চুক্তি ভিত্তিক তিন জন ছেলে ও একটি মেয়ের কাজের ব্যবস্থাও হল। সেই সাথে তার অক্লান্ত পরিশ্রম যুক্ত হয়ে ভাল কিছুর দেখা মিলতে শুরু করল।
কিন্তু গল্প তো এখানেই শেষ নয়? দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করার পরও স্বপ্নটাকে ছুতে পারছিলেন না। ব্যবসাকে কিভাবে আরও সমৃদ্ধ করা যায় সে চেষ্টা চলছিল দিনরাত। পরিচয় হল বায়িং হাউজের সঙ্গে। প্রতিশ্রুতি পেলেন গার্মেন্টস থেকে তার পছন্দের নির্দিষ্ট পোশাক তৈরী করে দেওয়ার। এবার স্বপ্নের পথে যাত্রার আরও একটি ধাপ পার হতে পারবেন বলেই অনেকটা নিশ্চিত। গার্মেন্টস এ তার দেওয়া অর্ডারের মাল সুইং হল। কিন্তু তিনি হাতে পেলেন না। তার টাকায় তৈরী পন্য মার্কেটে বিক্রি করে দিয়ে মুনাফা লুটে নিতে লাগল সেই বায়িং হাউজ। আর তাকে দেখাতে লাগল নানান অজুহাত। অন্যদিকে তার পাইকাররা তার কাছে মাল চাইতে লাগল। কিন্তু হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় সমস্যায় পড়তে হল প্রতিনিয়তই।
দেড় মাস পর উদ্ধার পেলেন কৌশল আর বুদ্ধিমত্তার গুনে। ডেলিভারী পেলেন মাল কিন্তু নিন্মমানের। ততদিনে তার ব্যবসার যত পাইকার ছিল তা হাতছাড়া হয়ে গেছে। ব্যবসা বন্ধের পর্যায়ে প্রায়। হাল ছাড়লেন না। আবারও ভাবলেন যেখানে যত অসৎ মানুষ সেখানেই সততার স্বীকৃতি পাওয়া সহজ হবে। পথে নেমে বাধার সম্মুখীন না হলে বাধা পার হওয়ার উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না। এবার আর মার্চেন্ডাইজার নয় সরাসরি গার্মেন্টস মালিকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করলেন। সেই সাথে পুরাতন পাইকারদের ফিরিয়ে আনার সাথে সাথে নতুন পাইকার খুঁজতে লাগলেন। সফলতাও এলো সে পথে। দিন দিন পরিচিতি বাড়তে শুরু করল। সততা, বুদ্ধিমত্তা, আর অক্লান্ত পরিশ্রমের গুণে ঘুরে দাড়ানো শুরু হল।
ব্যবসা বড় হতে শুরু করল। কিন্তু নিজের কাছে বড় ধরনের পুজিঁ না থাকার কারনে সমস্যায় পড়তে হল। কিন্তু তার সততা আর পরিশ্রম তাকে সেই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় দেখিয়ে দিল। বেশ কয়েকজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী তাকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। গার্মেন্টস থেকে বাকীতে মাল নিয়ে বিক্রি করে বাকী টাকা পরিশোধের সুযোগ করে দিলেন। মুলত এখান থেকেই সে সর্বোচ্চ লাভের সুযোগ পেলেন কোন রকমের পুজিঁ না খাটিয়ে। সেই সাথে আবিস্কার করতে পারলেন সততা থাকলে ব্যবসায় পুঁজির সংস্থান করা কঠিন কিছু না।
ব্যবসাকে আরও সমৃদ্ধ করতে শোরুম ভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও মাঝখানে পুঁজির সংস্থানের জন্য লোনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে বড় অংকের টাকা ক্ষতি হল। সিদ্ধান্ত নিলেন লোনের টাকায় ব্যবসা নয়। শোরুম ব্যবসার যাত্রা শুরু হল ২০১৪ সালে। সেই সাথে ব্যবসায়কে আইনগত দিক থেকে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করাতে লিমিটেড কোম্পানীতে রুপান্তর করলেন। ব্লু ড্রিম কোম্পানী লিমিটেড এর বায়িং হাউজ বর্তমানে দশটি নিজস্ব শোরুমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০০ এর বেশী শোরুমে পাইকারী পন্য সরবরাহ করে। সেই সাথে দেশের ৪২ টি জেলায় ডিলার নিয়োগের পাশাপাশি দেশের বাহিরেও এক্সপোর্ট করছে।
২০১৬ সাল। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে অর্ধশত লোক। যারা নিয়মিত ভাবে তার প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছে। সেই সাথে তার পন্য উৎপাদনের সাথে জড়িত আরও শতাধিত লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হয়েছে। তরুন এ উদ্যোক্তার সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে জানতে চাইলাম ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান আগামীতে? কাল বিলম্ব না করে বললেন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের পাইকারী পোশাকের বাজারে নিজেকে মার্কেট লিডার হিসেবে দেখতে চাই। আর মানব সেবায় নিজের প্রতিষ্ঠান এশিয়ান লাইফ ফাউন্ডেশন নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে থাকতে চাই জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।
তরুন এ উদ্যোক্তার সাথে কথা বলতে বলতে আরও জানতে চেয়েছিলাম আগামীতে যারা উদ্যোক্তা হতে চায় তাদের কি করনীয়? খুব হাস্যোজ্বল ভাবে বলছিলেন একটা বড় লক্ষ দাঁড় করিয়ে দিয়ে তার পেছনে তাড়া করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হল সততা থাকতে হবে। অসৎ মানুষের ভীরে সততাকে কাজে লাগানো সম্ভব হলে সফল হওয়াটা খুব সহজ হবে। প্রচুর পরিমান পরিশ্রম করতে হবে। দিন রাতের পার্থক্য ভুলে কাজে লেগে থাকতে হবে। যতক্ষন সফলতার দেখা না পাওয়া যায় ততক্ষণ লেগে থাকতে হবে। লেখাপড়া শিখে চাকুরী করতে হবে এমন মানুষিকতা বাদ দিয়ে নিজে কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। লেখাপড়ার সাথে সাথে নিজে কিছু একটা করার মত মানুষিকতা তৈরী করে ঝুঁকি নিতে হবে। সফলতার জন্য ব্যার্থতাকে মেনে নিতে হবে। অন্যের কথায় কান না দিয়ে সামনে এগিয়ে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
মাসুদুর রহমান মাসুদ
উদ্যোক্তার খোঁজে ডটকম।