একটু বেশি সময় ধরে একটানা পড়াশুনা করলে দেখা যায় আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে আসে অর্থাৎ মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে ! তখন যতই চেষ্টা করা হোক না কেন মস্তিষ্ক যেন আর কথায় শুনতে চায় না । কারণ সে তখন চাইছে বিশ্রাম ! তখন যদি মস্তিষ্কের বিনোদনের জন্য কাছের কোন জায়গা থেকে একটু বেড়িয়ে আসা যায় যেমন-পাশের কোন লেক , কোন হেরিটেজ , কোন খোলা জায়গা যেখানে প্রকৃতি ও আকাশ একখানে মিলে গেছে , তখনি দেখবেন মস্তিষ্কের পুষ্টি কাকে বলে!
মগজের পুষ্টি বা মস্তিষ্কের পুষ্টির খোরাক জোগায় ভ্রমণ । আমরা সবসময়ই জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন। সারাক্ষণ লেগে আছে প্রতিযোগিতা, সারাক্ষণ হেরে যাওয়ার ভয়। এই সবকিছুর মধ্যে আমাদের মস্তিষ্ক কখনোই বিশ্রাম পায় না। এর জন্য প্রয়োজন ভ্রমন।
ভ্রমণ মানেই শান্তি, রিল্যাক্স। সারা সপ্তাহ কাজের শেষে ছুটির দিন এলেই মন ভাল লাগতে শুরু করে আমাদের। কোন কাজ নেই, ভাবার মাঝেই অনেক আনন্দ। ঠিক যেমন অনেক কাজ আছে এই ভাবনা আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ায়। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, বেড়াতে যাওয়া আমাদের শরীরের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মস্তিষ্ককে উন্নত করে।
কারণ? ভ্রমণ মেটায় মনের ক্ষুধা। আমরা যত সৌন্দর্য্যের কাছে যাই তত আমাদের মন প্রশান্ত হয়। যত নিরিবিলি জায়গায় যাই তত মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায় দুশ্চিন্তা করা থেকে। যত যাই বনের গভীরে, যত যাই আদীম আবহাওয়ায় তত মস্তিষ্ক ভুলে যায় পার্থিব যত দূর্ভাবনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিজের মুড ভাল করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল অন্য বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া। এবং মজার ব্যাপার হল, আমরা যখনই এটা করি আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের তালে তালে ঠিকই পুরোনো বিষয় ভুলে যায়! এই থিওরি নিয়েই একজন বিজ্ঞানী কিছু সংখ্যক মানুষের উপর পরীক্ষা চালান। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় বনে হাটার জন্য মাত্র দেড় ঘন্টার জন্য। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর মস্তিষ্কের প্রিফন্টাল কর্টেক্স পরীক্ষা করা হয়। মস্তিষ্কের এই এলাকা মানসিক রোগের জন্য দায়ী। দেখা যায় সেখানে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। ভাবুন, মাত্র দেড় ঘন্টায় যদি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তাহলে দীর্ঘ ভ্রমণের ফল হতে পারে কেমন!
বিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা করেন, মস্তিষ্কের এই পরিবর্তন কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে। তারা একটি ভলান্টিয়ার গ্রুপকে শহরের বাইরে কিছুদিন অবস্থানের জন্য পাঠালেন। তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয় নিজেদের সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ করে রাখার। ফিরে আসার পর তাদেরকে বেশ কিছু জটিল এবং সৃজনশীল কাজ করতে দেওয়া হয় । দেখা যায়, তাদের সৃজণশীল ভাবনার ক্ষমতা বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
ভ্রমণ কেন জরুরি তা নিশ্চয়ই আর ব্যাখার অপেক্ষা রাখে না। মনকে প্রফুল্ল রাখতে, নিজের জীবনের সকল জট খুলতে একটাই জাদুকরী সমাধান। সব সমস্যা থেকে দূরে পালিয়ে যান কিছুদিনের জন্য। অন্তত ১ দিনের জন্য। মস্তিষ্ককে আরাম দিন, সে আপনাকে দেবে কয়েকগুণ বেশী কাজ করার ক্ষমতা।
এমনও হয় যখন কেউ চায় শহরের কোলাহল থেকে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে সরিয়ে নিতে তাদের জন্য/ যারা ঘরে মুখ লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করেন কিংবা বাইরের নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় থেকে নিজেকে বিরত রাখেন তাদের জন্যও একা ভ্রমণের কিছু উপকারিতা রয়েছে –
১. সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুশীলন: একা ভ্রমণের ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্ত আপনাকে একাই নিতে হবে। আর একা ভ্রমণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি বড় অনুশীলনক্ষেত্র হিসেবে বলা যায়। কারণ প্রতি ক্ষেত্রে আপনার বেশ কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে নিজে নিজেই। ফলে কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, কী কী দেখবেন, কোন যানবাহনে চড়বেন ইত্যাদি সিদ্ধান্তের আড়ালে আপনার মস্তিষ্ককেও যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে।
২. মানুষ পর্যবেক্ষণ: দেশ কিংবা বিদেশে যেখানেই ভ্রমণে যান না কেন, আপনাকে বিভিন্ন ধরনের বহু মানুষকে দেখতে হবে। এতে যেমন বিভিন্ন ধরনের মানুষ পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন তেমন তাদের আচার-আচরণ ও অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারবেন।
৩. আলাপ-আলোচনা: ভ্রমণে আপনাকে বিভিন্ন ধরনের বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এতে আপনি যেমন তাদের মাঝ থেকে ভালো বন্ধু খুঁজে নিতে পারবেন তেমন তাদের মনোভাব, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় জানতে পারবেন।
৪. নিজের মতো করে থাকা: একা ভ্রমণে অনেকটা স্বাধীনতা পাওয়া যায়। তাই আপনি বই পড়া কিংবা খাওয়া যাই করতে চান না কেন, এতে কারো কোনো বাধার সম্মুখিন হবেন না। এক্ষেত্রে আপনার ইচ্ছেটাই সবচেয়ে বড় করে পালন করতে পারবেন।
৫. আরাম করা: ভ্রমণ মানে শুধু পাহাড়ে চড়া কিংবা কষ্টকর জার্নি নয়, এতে আরাম করাও হতে পারে। আপনার ইচ্ছেমতো হোটেল কক্ষে আরাম করে সময়টি কাটিয়ে দিতে পারেন। এছাড়া ভ্রমণকালে একটি পরিশ্রমের পর বা আপনার পরবর্তী কাজের প্রস্তুতি হিসেবেও বিশ্রাম করে নিতে পারেন।
৬. ইচ্ছেমতো খাওয়া: ভ্রমণে গিয়ে আপনি ভিন্ন পরিবেশ বা সংস্কৃতিতে তাদের খাবারের স্বাদ নিতে পারবেন। প্রত্যেক জায়গারই কিছু না কিছু স্থানীয় খাবার থাকে। মিষ্টি, ঝাল কিংবা টক যাই হোক না কেন, এসব খাবার আপনার রসনাকে তৃপ্ত করতে ভূমিকা রাখবে। এতে কোন অঞ্চলের খাবার কেমন তাও জানতে পারবেন।
৭. চাপমুক্ত থাকা: পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি নানা মানুষের চাপে আমরা অনেকেই ব্যস্ত থাকি। এসব নানা ব্যক্তির চাপ এড়িয়ে একদণ্ড ভেবে নেওয়ার কিংবা সময় কাটানোর একটি ভালো উপায় হলো একা ভ্রমণ। এতে তাদের সঙ্গে আপনার মানসিক কোনো দ্বন্দ্ব যেমন হবে না তেমন অন্য মানসিক চাপও লাঘব হবে।
ভ্রমণ নিয়ে বিখ্যাত একটি উক্তি দিয়ে বলতে হয়- নতুন কোনো শহরে একাকী ঘুম থেকে জাগা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দের অনুভূতি। – ফ্রেয়া স্টাক
তথ্যসূত্র: এডুটিউব!