আগের দিনে মানে ৮০ দশকের সময় মানুষ পায়ে দেওয়ার জন্য এক ধরনের কাঠের জুতা ব্যবহার করত। যার নাম (খরম) বলে সবাই চিনত। জুতার ইতিহাস নিয়ে সারারাত লিখলেও শেষ হওয়ার নয়। আজ আমি এখানে সেন্ডেল তৈরির ব্যবসা নিয়ে এসেছি তাই ব্যবসা নিয়েই আলোচনা করা উত্তম। জুতা মানুষের জীবনে ব্যবহার যোগ্যের মধ্যে সব থেকে অন্যতম।
একটি মানুষের দুটো জুতা /স্যান্ডেল /পাদুকা যাই বলুন না কেন, এক জোড়া হতেই হবে। একবার চোঁখ বন্ধ করেই জুতা নিয়ে ভাবুন না! দেখবেন মানুষের জীবনে জুতার চাহিদা কত বেশি। আর চাহিদা যেহেতু বেশিই তাই আপনি জুতা তৈরির ব্যবসা করে ভাল আয় করতে পারেন। গ্রামে বা শহরে রাবারের সেন্ডেল এর ব্যাপক চাহিদা। একজোড়া ভাল সেন্ডেল এর দাম ১৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়।
শীত, বর্ষা, গ্রিস্ম যে সময়েই বলুন না কেন জুতা লাগবেই। বর্তমানে লেটার ব্যবসায় যদি আপনি নেমে পড়েন তাহলে আপনার জন্য দুটি সহজ বিষয় হবে। প্রথম হল মোটামুটি অল্প পূঁজিতে আপনি লেদার ব্যবসা শুরু করতে পারবেন অপরটি হল এই লেদার বা সেন্ডেল তৈরির ব্যবসাতে বর্তমানে কম্পিডিশন ( প্রতিযোগী) খুবেই কম। আজ আমরা জুতা তৈরির ব্যবসা সমন্ধে বিস্তারিত দেখে নিবো।
কিভাবে শুরু করবেন জুতা তৈরির ব্যবসা: জুতা একটি নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুু, তাই আপনি যদি মনে করেন এই রাবারের জুতা তৈরির ব্যবসা করে আয় করবেন তাহলে এখনেই নেমে পড়তে পারেন। আপনি শুধু জুতা তৈরি করার চিন্তা করুন, বিক্রি অটোমেটিক হয়ে যাবে। জুতা তৈরি শুরু করার জন্য আপনাকে প্রথমে চামড়ার জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
এরপর আপনাকে জুতা তৈরির উপকরণ সহ সব বিষয়ে জানতে হবে তারপর জুতা তৈরির মেশিন কিনে আনতে হবে সেই সাথে জুতা তৈরির কাচামাল আনতে হবে। আর জুতা তৈরি করার জন্য বড় কোন ফ্যাক্টরির প্রয়োজন হয় না। আপনি ছোট দুটো রুম নিয়ে লেদার ফ্যাক্টরি দিয়ে দিতে পারেন।
জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ: আপনি যেহেতু এই ব্যবাসার মধ্যে নতুন তাই আপনাকে চামড়ার জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে হবে তারপর আপনার সব অবিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জুতা তৈরি করতে পারবেন। কোথায় থেকে জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ নিবেন তা আপনি নিজেই সিলেক্ট করতে পারেন। চামড়ার জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ সরকার দিয়ে থাকে আপনি চাইলেই সরকার কতৃক জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।
এজন্য আপনাকে বাংলাদেশ সরকারের হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়া আপনি যাদের থেকে লেদার তৈরির মেশিন ও কাচামাল কিনবেন তারাই আপনাকে সাহায্য করে থাকবে। আর এক জায়গা আছে সেটা হলো অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয় (ইউটিউব) থেকে সকল ভিডিও দেখে দেখে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। আর যদি আপনি কোন জুতা তৈরি কোম্পানি তে চাকুরি করে থাকেন তাহলে তো কথাই নাই।
জুতা তৈরির মেশিন: আপনি যে কোন মাধ্যমে জুতা তৈরির সব কিছু জেনে গেছেন। এখন আপনাকে জুতা তৈরির মেশিন কিনতে হবে। সেন্ডেল তৈরি করার জন্য আপনি ৩ ধরনের মেশিন পাবেন আপনার যে মেশিনটি কেনার সামর্থ হবে আপনি সেই মেশিনটি কিনে ব্যবসা শুরু করুন।
স্যান্ডেল তৈরির মেনুয়াল মেশিন: আপনার যদি পূঁজি কম থাকে তাহলে আপনি সেন্ডেল তৈরি করার জন্য মেশিন কিনতে পারেন। মার্কেট এ এর বর্তমান বাজার মূল্য ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে। আপনি এই মেশিনের সাথে আপনার শারিরিক শ্রম দিতে হবে ও এর থাকে আপনি আরও কিছু মেশিন কিনতে হবে যেমন ডাইস, ড্রিল ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্যান্ডেল তৈরির রোলার মেশিন: আপনার যদি পূঁজি আর একটু বেশি হয় তাহলে আপনি স্যান্ডেল তৈরির রোলার মেশিন কিনতে পারেন। বর্তমানে স্যান্ডেল তৈরির রোলার মেশিনের দাম ৬০ হাজার টাকার থেকে ৭০ হাজার টাকার মধ্যে। এই রোলার মেশিন কিনলেই স্যান্ডেল তৈরি করতে পারবেন না। আপনাকে তারজন্য আরও কয়েকটি উপকরণ নিয়ে নিতে হবে।
স্যান্ডেল তৈরির পাওয়ার প্রেস মেশিন: আপনি জুতা তৈরি করার জন্য পাওয়ার প্রেস মেশিন কিনতে পারেন। এর বর্তমান বাজার মূল্য ১ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে। সব মেশিনের দাম নির্ভর করে তাদের উৎপাদনের উপর। তাই আপনি যেখান থেকেই জুতা তৈরি করার মেশিন কিনে থাকে না কেন যাচাই বাচাই করে কিনবেন।
জুতা তৈরি মেশিনের দাম: আজ আপনাকে একটি জুতা তৈরি মেশিনের দাম নিয়ে বলব। যেটি খুব কম দাম না বেশি দামের মধ্যেও না। মোটামোটি বলা চলে আপনি যদি রাবার শীট কাটা সহ মেশিন কেনার কথা ভাবেন তাহলে আপনাকে রাবার শীট মেশিনের জন্য মোটা অঙ্কের টাকার ব্যয় করতে হবে। আপনি রাবার শীট মেশিন না কিনে পাইকারি বাজার থেকে কিনে নিতে পারবেন।
এর পর তা মেশিনের মাধ্যমে উপযুক্ত সাইজ করে কেটে তার মধ্যে ফিতা লাগিয়ে অনায়াসে বিক্রি করতে পারেন। ১০ ফিট বাই ১০ ফিট মেশিনটির দাম পড়বে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। যা আপনি একটা রুমে সহজেই সেট করে নিতে পারবেন। আর মেশিনটির সাথে যা যা থাকবে স্যাম্পল কাটিং করার জন্য একটি ডাইস। পিলার ফিতা লাগানোর একটি মেশিন। প্রিন্ট করার জন্য প্রিন্টিং ফ্রেম একটি।
ড্রিল করার জন্য একটি ড্রিল মেশিন। হাই পাওয়ার কাটিং মেশিন একটি। সু গ্রাউন্ডার করার জন্য একটি মেশিন। আপনি এই মেশিন থেকে প্রতিদিন ৩ হাজার পিছ জুতার সোল উৎপাদন করতে পারবেন। আপনি ইচ্ছে করলে এর থেকে বড় মেশিন কিনতে পারবেন। যেহেতু আপনি প্রথম শুরু করতেছেন, তাই আপনি এই মেশিন দিয়েই শুরু করলে ভাল ফল পাবেন। পরবর্তী সময়ে অবস্থা বুঝে মেশিনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।
জুতা তৈরির মেশিন কোথায় পাওয়া যায়: আপনি যদি জুতা তৈরির মেশিন কেনার পরিকল্পনা করেন তাহলে আপনার ইচ্ছে ও সুবিধামত জায়গা থেকে এই মেশিন কিনতে পারবেন। আপনি বাংলাদেশ থেকেও কিনতে পারেন আবার আপনি চায়না, জাপান, মার্মা, ইন্ডিয়া থেকেও কিনতে পারেন। এগুলো আপনার পূঁজির উপর নির্ভর করবে। দেশের বাহিরে থেকে মেশিন কেনার জন্য আপনি এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তাদের থেকে এসব সাহায্য পাবেন।
জুতা তৈরির কাচামাল কোথায় পাবেন: আপনি যেখান থেকেই মেশিন কিনবেন তাদের মাধ্যমে এসব তথ্য পাবেন। জুতা তৈরি কাচামাল কেনার জন্য আপনি পুরান ঢাকায় যেতে পারেন। সেখানে অনেকেই চামড়া ব্যবসা সহ নানা রকম ব্যবসার সাথে জড়িত। আপনি যদি আমার উপর ছেড়ে দেন তাহলে আমি বলব দেশের একটি বড় প্রতিষ্ঠান আছে যারা বিভিন্ন দেশ থেকে জুতা তৈরির কাচামাল সহ বিভিন্ন কিছু আমদানি করে থাকে। তাদের মধ্যে বিকেএলএস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানটি ভাল। আপনি তাদের মাধ্যমে সহজেই ও কম দামেই সবরকম জুতা তৈরির উপকরণ সহ সব কিছু পেয়ে যাবেন।
কোথায় জুতা বিক্রি করবেন: আপনি যখন জুতা তৈরি করেছেন এখন বিক্রি করার পালা, আপনি ভালভাবে মার্কেটিং করুন ও সব দিকে ছড়িয়ে দিন আপনার ব্রান্ডিং। আপনি প্রতি জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দিন আপনার জুতা। অনেকেই আছে যারা পাইকারি বাজার থেকে জুতা কিনে তারাও বিভিন্ন মাধ্যমে পাইকারি দিয়ে থাকে। তাদের শনাক্ত করুন এবং আপনার জুতা বিক্রি করুন। এছাড়াও বর্তমান সময়ে অনেক হকার লেভেল এর লোক ভ্যানে করে জুতা সেল দিয়ে থাকে। আপনি তাদের কাছেও আপনার জুতা বিক্রি করে আয় করুন।
জুতার সাথে আর কি উৎপাদন করবেন: আপনি জুতার সাথে লেদারের সকল কিছুই উৎপাদন করতে পারবেন। জুতার জুতা ইমেজ যখন ভাল হবে তখন আপনি তার সাথে বেল্ট তৈরির ব্যবসা করতে পারেন। আপনি ইচ্ছে করলে বার্মিজ জুতার ক্যাটালগ নকল করে বার্মিজ জুতার ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারেন। এভাবেই আস্তে আস্তে আপনি একজন লেদার ফ্যাক্টরি এর গর্বিত মালিক বনে যাবেন। আপনাকে আর পায় কে ভাই। আপনি এখন জুতা তৈরির কারখানা দিয়ে জুতার ব্যবসা সব অন্য ব্যবসাগুলো জমজমাট ভাবে করতেছেন।
জুতা তৈরিতে সাবধানতা: আপনাকে খুব ধৈর্য সহকারে চামড়ার জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এছাড়া যখন মেনুয়ালি মেশিন চালাবেন তখন আপনাকে খুব সাবধানতার সাথে কাজ করতে হবে। জুতা তৈরির মেশিন সব সময় মেইন্টেনেস করে রাখতে পারেন। আর অবশ্যই সব থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল আপনাকে জুতা তৈরির মাপের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আপনাকে খুব বড় সাইজ এর জুতা কম তৈরি করতে হবে ও খুব ছোট সাইজের জুতা তৈরিও কম করতে হবে। আপনি সব সময় মধ্যোম মাপের জুতা তৈরির দিকে বেশি নজর দিবেন। কারন এগুলো বাজারে খুব ভাল চলে।
জুতা তৈরির ব্যবসায় লাভ: এখানে বলা রাখা ভাল আপনি যদি ভাল মানের জুতা তৈরি করতে না পারেন ও মার্কেটিং করতে না পারেন তাহলে আপনার লাভের চেয়ে লসের পরিমান প্রথমে বেশি হতে পারে। আর যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে আপনি একটি মৌখিক ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে হিসেব করলে লাভজনক ব্যবসা করতে পারবেন।
ধরুন একটি জুতার তৈরির মেশিনের মাধ্যমে দৈনিক ৮০০ জুতা উৎপাদন করতে পারেন। তাহলে মাসিক জুতা উৎপাদন হবে চব্বিশ হাজার পিছ। মেশিনে জুতা তৈরি সহ আপনার সাথে আরও ২ জন লোক লাগবে।তাদের গড় বেতন ১৫ হাজার টাকা। রাবার শীট এর দাম পড়বে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে। আপনি রাবার শীট এর কোয়ালিটির উপর এর দাম (দাম কম বেশি) নির্ভর করবে।
একটি রাবার শীট থেকে ১৭ থেকে ১৮ জোড়া স্যান্ডেল তৈরি করা যায়। তাহলে একজোড়া স্যান্ডেল তৈরি করার জন্য আপনাকে গুনতে হবে ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা। এছাড়া স্যান্ডেলের ফিতা ও বিদ্যুৎ বিল আপনার বিল ও আপনার কর্মচারীর বিল সহ ১ জোড়া স্যান্ডেল তৈরি করতে খরচ পড়বে ৩৫ টাকা। আপনি প্রতিজোড়া সেন্ডেল তৈরি করে জোড়া প্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা লাভ করে বাজারে ছেড়ে দিলে আপনার মাসিক আয় হতে পারে ১ লক্ষ টাকার মত।
তাহলে আপনি বছরে শুধুমাত্র ১ টি ব্যবসা দিয়ে ভালই লাভ করতে পারতেছেন। আপনি শুরু করুন আস্তে আস্তে, একদিন আরও বেশি সফলতা পেয়ে যাবেন। এভাবেই একজন নতুন উদ্দ্যোক্তা ছোট ব্যবসা থেকে বড় ব্যবসার দিকে ধাবিত হবে। আর হ্যাঁ, এখন থেকে আপনিও একজন সফল স্যান্ডেল ব্যবসায়ী। তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।