বছর বছর বাংলাদেশি টাকার মান কমছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করে থাকে মার্কিন ডলারে। রক্ষণশীল হিসেবেও আওয়ামী লীগ সরকারের ১০ বছরে সেই ডলারের তুলনায় টাকার মান কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ বছর আগে যে জিনিস কেনা যেত ১০০ টাকায়, বর্তমানে তা কিনতে হচ্ছে ১২১ টাকায়। এটি সরকারি হিসাবের তথ্য।
বেসরকারি হিসাবে এই সময়ে টাকার মূল্যমান আরও বেশি অর্থাৎ ২৫ শতাংশ কমেছে। আর, এর প্রভাবে লেনদেনের ভারসাম্য এবং চলতি হিসাব নেতিবাচক হয়ে পড়েছে। কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুদ্রা বিনিময় হারের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এ তথ্য মিলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যেত ৬৯ টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারিজুড়ে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৪ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা ১২ পয়সা দরে। এই হার এক বছর আগের তুলনায় ১ টাকা ২২ পয়সা বেশি। অথচ দুই বছর আগেও ২০১৭ সালের শুরুর দিকে প্রতি ডলারের মূল্যমান ছিল ৭৯ টাকা ৭৫ পয়সা।
তবে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকের বাইরে প্রতি ডলার ৮৬ টাকারও বেশি দরে বিক্রি হয়েছে গতকাল। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৫৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে এবং তিন দফা ডলারের দাম বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার নির্ধারণ করে দিত। টাকাকে রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয় ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ। আর ২০০৩ সালে এই বিনিময় হারকে করা হয় ফ্লোটিং বা ভাসমান। এর পর থেকে আর ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরোপুরি তা বাজারভিত্তিক থাকেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই এতে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখে আসছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে অনুসরণ করে আসছে ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং রেট’ নীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা বিনিময় হারের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু মার্কিন ডলারের তুলনায় নয়, আন্তর্জাতিক অন্য মুদ্রার তুলনায়ও কমছে টাকার মান। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিং, প্রধান ইউরোপীয় দেশগুলোর সমন্বিত মুদ্রা ইউরো এবং চীনের মুদ্রা ইউয়ান। তবে ভারতীয় মুদ্রা রুপির তুলনায় টাকার মূল্যমান মোটামুটি স্থিতিশীল আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘টাকার অবমূল্যায়ন হলে রপ্তানিকারকেরা সুবিধা পান, কিন্তু আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়ার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কৃত্রিমভাবে ডলার কেনাবেচা করে পরিস্থিতি ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা করা।’
রপ্তানিকারকেরা আপাতত খুশি: টাকা অবমূল্যায়িত হওয়ায় খুশি দেশের রপ্তানিকারকেরা। কারণ এতে আগের তুলনায় বেশি আয় হচ্ছে তাঁদের। কিন্তু এই রপ্তানিকারকদের একটি অংশ যেখানে আমদানিকারক, সেই দিক থেকে তাঁরা আবার নাখোশও। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, বাংলাদেশে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হচ্ছে। আবার প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। তাই টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় খুব বেশি লাভবান হতে পারছেন না এসব ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, ‘আমরা আমদানি-রপ্তানি দুটিই করি ডলারে। রপ্তানির পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে একটু একটু করে ডলারের দাম বাড়লে আমাদের উপকার হয়।’ প্রতিযোগী দেশ তুরস্ক ও ভারত ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে বলে তিনি উদাহরণ দেন।
কমছে রিজার্ভ: ১ ডলারে আগের তুলনায় বেশি টাকা পাওয়া গেলে সাধারণত প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বেশি আসে দেশে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা তখন বেশি উৎসাহে টাকা পাঠান দেশে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে ঠিক উল্টো চিত্র। টাকা মূল্যমান হারালেও কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
২০১৭ সালের জুনে যেখানে রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার, তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৯৬ কোটি ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল আমদানির কারণেই রিজার্ভ এখন কিছুটা কম, ডলারের দামেও অস্থিরতা। তবে এ অবস্থা থাকবে না।’
চলতি হিসাবে ঘাটতি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দুই বছর আগেও চলতি হিসাবের ঘাটতি ছিল ৯৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এই ঘাটতি বর্তমানে বেড়েছে সাত গুণেরও বেশি। গত ডিসেম্বর শেষে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০৮ কোটি ২০ লাখ ডলারে।
বাণিজ্য ঘাটতি আছেই: রিজার্ভ কমা, লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি এবং চলতি হিসাবে ঘাটতির কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা আমদানি বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ আমদানি ব্যয় বেশি হয়েছে। প্রথম ছয় মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭৮২ কোটি ডলার। একই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ২ হাজার ১৬ কোটি ডলার। সে হিসাবে শুধু পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৬৬ কোটি ডলারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানিনির্ভর দেশ। সে তুলনায় রপ্তানি অত বেশি নয়। মূলধনি যন্ত্রপাতি তো আমদানি করতেই হবে। আমরা চাই বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কম হোক। এতে ডলার–সংকট কম হবে, দামও স্বস্তিদায়ক থাকবে।’ তথ্যসূত্র: প্রথমআলো।