1. editor@islaminews.com : editorpost :
  2. jashimsarkar@gmail.com : jassemadmin :

মিষ্টির ব্যবসা!

বাংলাদেশে মিষ্টির ব্যবসা একসময় ঘোষদের দখলে থাকলেও এখন অবস্থা বদলেছে৷ বড় বিনিয়োগ নিয়ে মিষ্টির চেনশপ চালু হয়েছে ঢাকায়৷ তারা ব্র্যান্ডিং-এর ওপর জোর দিচ্ছেন৷ তবে ক্রেতাদের মধ্যে দাম নিয়ে আছে আপত্তি৷

বাংলাদেশে একাধিক আউটলেট খুলে, আধুনিক প্যাকেটে, রীতিমত বিজ্ঞাপন দিয়ে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করে আলাউদ্দিন সুইটমিট৷ ১৯৮৩ সালে পুরান হাজি মাসুম উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া মিষ্টির ব্যবসাকে আধুনিক কর্পোরেট ব্যবসায় রূপ দেন৷ তিনি আলাউদ্দিন সুইটমিটকে লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করেন৷ শুধু বাংলাদেশে নয় নিউইয়র্ক, লন্ডনে শাখা খোলেন৷ এরপর সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ভারতেও মিষ্টির ব্যবসা শুরু করে আলাউদ্দিন সুইটমিট৷

প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের পূর্বপুরুষ আলাউদ্দিন ভারতের লক্ষ্ণৌর বাসিন্দা ছিলেন৷ সেখান থেকেই তাঁর মিষ্টি ব্যবসা শুরু৷ তিনি পরে বাংলাদেশ এসে চকবাজারে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন৷ এখন ঢাকাসহ বড় বড় শহরে শাখা আছে৷ ৫০ ধরনের মিষ্টি তৈরি করে তারা৷

ব্র্যান্ডের মিষ্টি
ঢাকায় এখন মিষ্টির আরও কয়েকটি ব্র্যান্ড আছে৷ এর মধ্যে অন্যতম হলো মিনা সুইটস, প্রিমিয়াম সুইটস, প্রমিনেন্ট সুইট রস, বনফুল, মিঠাই, জয়পুর, মুসলিম সুইটস ইত্যাদি৷ তারা মিষ্টির প্রচলিত ব্যবসাকে পেছনে ফেলে ব্র্যান্ডিং-এ এগিয়ে যাচ্ছে৷ ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার মিষ্টির ব্যবসা হয়৷ যারা বড় বিনিয়োগ নিয়ে এই ব্যবসায় নেমেছে তারা রীতিমত মার্কেট স্টাডি করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে৷ অনেকেরই এখন শাখা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে৷ প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশীয় মিষ্টি খেতে চান৷ তাদের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বিদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে৷ আর এই ব্যবসা সম্প্রসারণে মিষ্টি রপ্তানি নয়, ঐ সব দেশে সরাসরি মিষ্টির কারখানা খোলার পরিকল্পনাও রয়েছে৷

বাংলাদেশে মোট যে পরিমাণ মিষ্টি বিক্রি হয় তার শতকরা ৫০ ভাগই রসগোল্লা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা৷ তারা জানান, ‘‘নানা নামে মিষ্টির হরেক রকম আইটেম আসলেও রসগোল্লার দাপট এখনো কমেনি৷ রসগোল্লাকেই আবার নানাভাবে নতুন নামে ব্র্যান্ডিং করছেন কেউ কেউ৷ এখন যারা মিষ্টির কর্পোরেট ব্যবসা করেন তারা ব্যবসা প্রতষ্ঠানের নামের ব্র্যান্ডিং যেমন চান, তেমনি তারা তাদের নিজস্ব প্রোডাক্ট হিসেবে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টির ব্র্যান্ডিংও করছেন৷ সে কারণে সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের হালুয়া বাজারজাত করা হচ্ছে, সেগুলো জনপ্রিয়ও হচ্ছে৷

প্যাকেজিং
যারা বড় আকারে কর্পোরেট মিষ্টির ব্যবসা করছেন তারা প্যাকেজিংকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন৷ উৎসব আয়োজনে বাহারি মিষ্টির প্যাকেট মন ভুলিয়ে দেয়, থাকে বিশেষ অফার৷ কোনো কোনো মিষ্টির দোকান এখন গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী প্যাকেট করে দেন৷ আর এই প্যাকেজিং-এ এখন বাঁশ বেতের ব্যবহারও হচ্ছে৷ মিষ্টির প্যাকেজিং এখন ছোট হলেও আলাদা শিল্প হিসেবে গড়ে উঠছে৷ এই প্যাকেজিং-এ ঐতিহ্যবাহী মাটির হাড়ি ফিরে এসেছে, তবে তা ভিন্ন রূপে৷ রস মিষ্টির উপ-মহাব্যবস্থাপক এম কে নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী৷ আমরা গ্রাহকদের কাছে সুদৃশ্য মোড়কে মিষ্টি তুলে দেই৷ এছাড়া আমরা মানও বজায় রাখি৷ ফলে আমাদের উপস্থাপনা যেমন সুন্দর, তেমনি পণ্যও মানসম্পন্ন হয়৷ তাই আমাদের মিষ্টির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে৷”

একই বক্তব্য মিনা সুইটস-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদ আহমেদ এরও৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন যুগটা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং-এর যুগ৷ তাই মানের সঙ্গে প্যাকেজিং গুরুত্ব পাচ্ছে৷ যেমন পহেলা বৈশাখে এক ধরনের প্যাকেজিং লুক চান ক্রেতারা৷ আবার উৎসব অনুষ্ঠানে ক্রেতারা তাদের পছন্দ মত প্যাকেজিং চান৷ এখন মিষ্টি শুধু খাওয়ারই না, দেখারও৷”

মান নিয়ন্ত্রণ
রস মিষ্টির নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা কাঁচামাল থেকে শুরু করে উৎপাদন, বাজারজতকরণ প্রতিটি পর্যায়েই কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করি৷ মিষ্টির প্রধান কাঁচামাল দুধ, চিনি ও ময়দা৷ আমরা মান পরীক্ষার মাধ্যমেই এগুলো গ্রহণ করি৷ উৎপাদন এবং সংরক্ষণে আমাদের দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত লোক আছে৷ আর প্রচলিত কারিগরদের নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে কারিগর তৈরি করি৷ আমাদের পণ্য বিএসটিআই অনুমোদিত৷”

মিনা সুইটস-এর সাঈদ আহমেদও বলছেন, ‘‘আমাদের আধুনিক ফ্যাক্টরি আছে৷ আউটলেটগুলোও স্বাস্থ্যসম্মত৷ ফ্যাক্টরি থেকে আউটলেটে মিষ্টি পরিবহণে আমরা নিজস্ব পরিবহণ ব্যবহার করি৷ মান নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের কেমিস্ট আছেন৷ মিষ্টি উৎপাদনের আগে কাঁচামাল পরীক্ষা করা হয়৷ উৎপাদনের পরেও গুনাগুন পরীক্ষা করা হয়৷”

মিষ্টির বাজার
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশে প্রায় এক হাজার মিষ্টির দোকান বা আউটলেট রয়েছে, যা প্রতিষ্ঠিত কর্পোরেট মিষ্টি ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত৷ ঢাকায় রয়েছে পাঁচ শতাধিক আউটলেট৷ এইসব শোরুমে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার মিষ্টি বিক্রি হয়৷ তবে সবাই যে মিষ্টি তৈরি করেন তা নয়৷ মিষ্টি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২০০৷ মিষ্টির অন্যতম প্রধান উপাদান দুধ৷ বর্তমানে প্রায় তিন হাজার দুগ্ধ সরবরাহকারী আছেন৷

মিনা সুইটস-এর সাঈদ আহমেদ জানান, ‘‘আমরা মার্কেট স্টাডি করে দেখেছি বাংলাদেশে মিষ্টির বাজার অনেক বড়৷ এখানে উৎসব আয়োজনসহ নানা অনুষ্ঠানে মিষ্টির প্রচলন আছে৷ আর সাধারণভাবে মিষ্টি খায় এ দেশের মানুষ৷ বিদেশেও বাংলাদেশের মিষ্টির চাহিদা রয়েছে৷ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশেও তাদের আউটলেট খুলেছে৷ আমরা এখন বাংলাদেশের মার্কেটকে আরো সংহত করার কাজ করছি৷ এরপর দেশের বাইরে রপ্তানির চিন্তা আছে৷”

তিনি জানান, ‘‘মিষ্টির কারিগর হিসেবে দেশের ছাড়াও কলকাতার কিছু কারিগর এখানে কাজ করেন৷ আবার দেশের কারিগরদের দেশের বাইরে থেকে প্রশিক্ষণ দিয়েও আনা হয়৷ মিষ্টির নতুন আইটেম যোগ করা হয়৷ আর এজন্য গবেষণাও হয়৷” দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মিষ্টির দোকান আছে হাজার হাজার৷ গ্রামাঞ্চলে যেখানে দোকান সেখানেই মিষ্টি তৈরি হয়৷

বাংলাদেশে অঞ্চলভিত্তিক কিছু জনপ্রিয় মিষ্টি আছে৷ যেমন কুমিল্লার রসমালাই, টাঙ্গাইলের চমচম, যশোরের জামতলার রসগোল্লা, নওগাঁর প্যারা সন্দেশ, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, মুক্তাগাছার মণ্ডা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি ইত্যাদি৷ আর রসগোল্লার কপিরাইট কলকাতার হলেও বাংলাদেশের রসগোল্লাও বিখ্যাত৷

এইসব মিষ্টির জনপ্রিয়তা বিপুল৷ তবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি এসব মিষ্টি বিক্রি করছেনা৷ রস মিষ্টির এম কে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা ঐসব মিষ্টি সরেজমিন গিয়ে দেখেছি৷ কারিগরদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তারপর নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করেছি৷” বাংলাদেশে ছোট মিষ্টির দোকান চালিয়ে পরে মিষ্টির কর্পোরেট ব্যবসায় গড়ে তুলেছে এমন প্রতিষ্ঠানও আছে৷ চট্টগ্রামের বনফুল এন্ড কোং সেরকমই একটি প্রতিষ্ঠান৷ তাদের ব্যবসা এখন ঢাকা ও সিলেটেও বিস্তৃত৷ দুবাই এবং লন্ডনে আছে আউটলেট৷

বনফুল-এর মালিক এম এ মোতালেব বলেন, ‘‘আশির দশকে আমি দেশের বাইরে গিয়ে মিষ্টির কর্পোরেট মার্কেটিং সম্পর্কে ধারণা পাই৷ তারপর ব্যবসার ধরন বদলে ফেলি৷ এরপর আরো অনেকে আমাকে ফলো করে৷ আমি নিজেই মিষ্টি তৈরিতে দক্ষ৷ আমি নিজে ভারত থেকে যেমন নানা ধরনের মিষ্টি তেরি শিখেছি, তেমনি ভারত থেকে কারিগর এনে আমার কারিগরদের শিখিয়েছি৷”

দামে অসন্তুষ্টি
মিষ্টির দাম নিয়ে অষন্তোষ আছে ক্রেতাদের মধ্যে৷ তাদের কথা, ‘‘এক কেজি রসগোল্লার দাম দোকানভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা৷ এত পার্থক্য কেন হবে?”এ ব্যাপারে মিনা সুইটস-এর সাঈদ আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা মানের সঙ্গে আপোষ করিনা৷ তারপরও আমাদের দাম রিজোনেবল৷ আমরা গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই দাম রাখি৷”

রস মিষ্টির এম কে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘পণ্যের মানের ওপর দাম নির্ভর করে৷ তাই দেখা যায় আমাদের দাম একটু বেশি হলেও ক্রেতা কিন্তু বাড়ছে৷” ঢাকা কেন্দ্রিক এই ব্র্যান্ড মিষ্টির প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটি দুধের জন্য নিজস্ব ডেইরিও স্থাপন করেছে৷ তারা মিষ্টি উৎপাদনে নিজস্ব ডেইরির দুধ ব্যবহার করে৷

তথ্যসূত্র: ডিডব্লিউ ডটকম।

More News Of This Category