রফতানির জন্য প্রস্তুতকৃত জুতার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে সরকার। কিন্তু এ সুবিধার শর্ত ভঙ্গ করে আমদানিকৃত কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে খাতসংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি কয়েকটি কারখানা পরিদর্শন করে এ অনিয়ম উদ্ঘাটন করে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট।
চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা সম্প্রতি মেসার্স জিল ওয়্যারস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কারখানা পরিদর্শন করেন। সেখানে ধরা পড়ে রফতানি পণ্য হিসেবে জুতা উৎপাদনের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির পর তা দেশের বাজারেই বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। এর আগে বেঙ্গল সু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায়ও একই ধরনের অনিয়ম ধরা পড়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বন্ড কমিশনারেটের নিরীক্ষায় মেসার্স জিল ওয়্যারস লিমিটেড ও বেঙ্গল সু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের গুদামে যে পরিমাণে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামাল থাকার কথা ছিল, তা পাওয়া যায়নি। সরেজমিন পরিদর্শনের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট চলতি মাসে এক নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ইনবাউন্ড গুদামে মজুদ করা কাঁচামাল ও বন্ড রেজিস্টারের স্থিতি পর্যালোচনা করে বড় ধরনের অনিয়ম উদ্ঘাটন হওয়ার কথা জানানো হয় এতে। প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় রেজিস্টার অনুযায়ী ৬০ ক্যাটাগরির আট লাখ কেজি জুতার কাঁচামাল থাকার কথা থাকলেও ইনভেন্ট্রি করে দেখা গেছে, রয়েছে মাত্র ১ লাখ ১৭ হাজার কেজি। বাকি কাঁচামাল বিক্রি করে দেয়া হয়েছে স্থানীয় বাজারে।
আবার এর মধ্যে বেশকিছু কাঁচামাল ঘোষণার চেয়ে অতিরিক্ত রয়েছে, যেগুলো বিক্রির জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। পরিদর্শনে পাওয়া কমবেশি এই ৬০ ধরনের কাঁচামালের মূল্য ১৭ কোটি টাকা, বাণিজ্যিকভাবে যার শুল্ক আসে ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লায় অবস্থিত।
অন্যদিকে গত বছর অক্টোবরে বেঙ্গল সু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আমদানি করা ১১৭ ধরনের কাঁচামালে গরমিল ধরা পড়ে। প্রতিষ্ঠানটির কম ও বেশি পাওয়া পণ্যের মূল্য ২৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা, যার শুল্ক দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
এছাড়া কারখানায় উৎপাদন ফ্লোর পরিদর্শন করে পাঁচটি লাস্টিং উৎপাদন লাইনের মধ্যে ভেতরে মাত্র একটি লাস্টিং লাইন এবং নয়টি সুইং লাইনের মধ্যে মাত্র তিনটি সুইং লাইনে উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে কমিশনারেট সূত্রে জানা গেছে। কারখানার বর্ধিত অংশে তিনটি আউটসোল তৈরির মেশিনের মধ্যে চালু ছিল একটি।
একই প্রতিষ্ঠানের কারখানা চত্বরে মোট আটটি কাঁচামালের গুদাম রয়েছে, যার সবগুলো কাস্টমস কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এছাড়া পরিদর্শনকালে ব্যাস ব্র্যান্ডের জুতার বাক্সে ভিন্ন ব্র্যান্ডের জুতা প্যাকেটজাত করারও প্রমাণ পেয়েছেন কমিশনারেটের নিরীক্ষাকারীরা। এ ধরনের অনিয়ম কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬৯-এর সেকশন ৮৬, ৯৭, ১০২, ১০৪ ও ১০৭ এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধিমালা ও শর্তের পরিপন্থী।
কাস্টমস, বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রামের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে মেসার্স জিল ওয়্যারস লিমিটেড ও বেঙ্গল সু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অনিয়ম উদ্ঘাটন করা হয়েছে। শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে তারা এর অপব্যবহার করেছে। আমরা এ দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাস্টমস আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’
যোগাযোগ করা হলে বেঙ্গল সু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মো. নাছিমুল হক সুমন বলেন, ‘কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের ইনভেন্ট্রিতে ভুল ছিল। আমদানি করা কাঁচামালের অনেক আইটেমই তারা লিপিবদ্ধ করেননি।’ যদিও কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সরেজমিন পরিদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিবৃতি দিয়ে অনিয়মের বিষয়গুলো স্বীকার করেছেন বেঙ্গল সু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কর্মকর্তারা।
বিবৃতিতে কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন, কাস্টমস পরিদর্শনে পাঁচটি লাস্টিং উৎপাদন লাইনের ভেতরে তাত্ক্ষণিকভাবে একটি এবং নয়টি সুইং লাইনের মধ্যে তিনটিতে উৎপাদন চলমান ছিল। এছাড়া আউটসোল তৈরির ইউনিটের তিনটি মেশিনের মধ্যে একটি মেশিনে উৎপাদন কার্যক্রম ছিল, যার উৎপাদনক্ষমতা ঘণ্টায় ৬০ জোড়া আউট সোল।
ফ্লোরে ব্যাস নামের ব্র্যান্ডের জুতার বাক্সে অন্য ব্র্যান্ডের জুতা প্যাকেটজাতের তথ্যও স্বীকার করে নেয়া হয় বিবৃতিতে। প্রতিষ্ঠানটির চার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কারো দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে এ বিবৃতি দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে এতে স্বাক্ষর করেছিলেন।
বন্ড কমিশনারেট সূত্রে জানা গেছে, ১০০ শতাংশ রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্স সুবিধা পেয়ে থাকেন। বন্ড সুবিধা নিয়ে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনলে তাতে শুল্ক ও কর দিতে হয় না। তবে শর্ত থাকে, সে কাঁচামাল পুরোপুরি ব্যবহার করে দুই বছরের মধ্যে রফতানি করতে হবে।
এজন্য বন্দর দিয়ে কী পরিমাণ পণ্য বন্ড সুবিধায় এসেছে, এর যেমন হিসাব রাখতে হয় আবার ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউজে কতটা রক্ষিত আছে, কী পরিমাণ ব্যবহার হয়েছে, সেই হিসাবের সঙ্গেও মিল থাকতে হয়। প্রতিষ্ঠান দুটির এ হিসাবের মধ্যেই গরমিল পাওয়া গেছে। তথ্যসূত্র: বণিক বার্তা।