কোনো জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় নয়, এক মুঠো ময়দা, একটুখানি চিনি, সয়াবিন তেল আর কয়েকটা ডিম দিয়ে তৈরি একটা ‘কেক’ বদলে দিয়েছে আমার ভাগ্য। পাল্টে দিয়েছে আমার পরিচয়। ‘ঘরের বউ’ থেকে হয়েছি সফল উদ্যোক্তা। গৃহিণী জলি বেগম থেকে পরিচিতি পেয়েছি ‘জলি ফুড প্রোডাক্টস’-এর কর্ণধার হিসেবে। অভাব ঘুচেছে, সংসারে এসেছে সুদিন। বাড়ি-গাড়ি হয়েছে, হয়েছে জায়গা-জমি, বেকারি কারখানা। কর্মসংস্থান হয়েছে শতাধিক মানুষের। রসুইঘরের বদলে এখন আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয় ব্যবসা সামলানোর কাজে।
তবে এই সাফল্যের পথটা মসৃণ ছিল না। ছিল কষ্টের, সংগ্রামের। সংগ্রামের কাহিনির শুরুটা সত্তর দশকে। আট ভাইবোনের টানাটানির সংসার। শহরে জন্ম হলেও বাবা দরজির কাজ করতেন। তিনি যে উপার্জন করতেন, তা দিয়ে এতগুলো সন্তানের ভরণপোষণ সামলাতে হিমশিম খেতে হতো তাঁকে। শৈশবে স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে চাকরি করব। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেই সেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। ১৩ বছর বয়সেই বধূ সেজে যেতে হয় শ্বশুরবাড়িতে।
১৯৭৮ সালে পড়ালেখায় ইতি টেনে চলে যেতে হয় আশুলিয়া গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে। তখন ‘সংসার’ জিনিসটাই ঠিকমতো বুঝতাম না। স্বামী রমজান আলী বেকার। কোনো আয়-উপার্জন নেই। কাজ নেন একটা ধান ভাঙার কলে। বেতন যৎসামান্য। তাতে হাতখরচই চলে না। কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে অটোটেম্পো কেনেন তিনি। নিজেই চালাতেন। দিন-রাত হাড়ভাঙা খাটুনি। বাড়িতে আমি নতুন বউ। সারা দিন একা বসে থাকতাম। কিছুই ভালো লাগত না। এক বছরের মাথায় সঙ্গী পেলাম। কোলজুড়ে পুত্রসন্তান এল। নতুন অতিথির আগমনে সংসারের খরচও বেড়ে গেল। পরপর সংসার আলো করে এল আরও দুই পুত্র-কন্যা। তিন অতিথির আগমনে সংসারের খরচ বেড়ে গেল।
১৯৮৪ সাল। আমার কোলে তখন ১০ মাসের কন্যাসন্তান। আমার স্বামী টেম্পো বিক্রি করে দিয়ে সৌদি আরবে পাড়ি জমালেন। ছোট ছোট তিনটি সন্তান নিয়ে আকূলপাথারে পড়লাম। স্বামী বিদেশ থেকে হাতখরচের কিছু টাকা পাঠাতেন। কিন্তু তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। ইচ্ছে ছিল শ্বশুরবাড়ির পাশে এরুলিয়া বাজারে একটা খাবার হোটেল দেব। কিন্তু নারী হয়ে হোটেলে বসাকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিশ্চয় ভালো চোখে দেখবেন না। ভাবনাটা বাদ দিলাম।
সন্তানদের নিয়ে উঠলাম বগুড়া শহরের বৃন্দাবনপাড়ায় বাবার বাড়িতে। সেখানেই ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করালাম। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগল ওরা। ছেলেমেয়ে কলেজে ভর্তি হলো। বড় ছেলেটা খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশতে শুরু করল। সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। ধারদেনা করে বড় ছেলেটাকেও সৌদি আরবে পাঠিয়ে দিলাম।
এবার দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসারে আমি একা। মেয়েটা তখন কলেজে পড়াশোনা করে। ২০০০ সালের কথা। মা-মেয়ে দুজনে ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছি। হঠাৎ কেব্ল টেলিভিশনের একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেল। ‘রমণীতে রান্না শিখুন’ বিজ্ঞাপনটা দেখেই মেয়েকে বললাম, ‘রুমা, রান্না শিখবি?’ মেয়ে বলল, ‘চলো দুজনেই শিখি।’ আমি বললাম, ‘এই বয়সে আমার শেখায় কাজ নেই, চল তোকে ভর্তি করিয়ে দিই।’ টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠা মুঠোফোন নম্বরে ফোন করলাম রান্নার ইশকুলে।
পরদিন মেয়েকে নিয়ে গেলাম শহরের সূত্রাপুরের একটি বাসায়। রান্নার প্রশিক্ষক একজন নারী। ৫০০ টাকায় কেক বানানো শেখাবেন। মেয়েকে ভর্তি করানোর পর ওই প্রশিক্ষক আমাকে বললেন, ‘আপনি এখন যান, দুই ঘণ্টা পরে এসে মেয়েকে নিয়ে যাবেন।’ আমি বললাম, ‘আমি তো মেয়েকে একা কোথাও যেতে দিই না। আপনি আমার মেয়েকে শেখান, আমি বসে থাকি।’
কিছুটা অসম্মতি সত্ত্বেও ওই প্রশিক্ষক মেয়ের সঙ্গে আমাকে থাকতে দিতে রাজি হলেন। প্রথম দিনেই এক মুঠো ময়দা-চিনি-সয়াবিন আর চারটা ডিম দিয়ে একটা কেক বানানো শেখালেন। বাড়িতে এসে সারা রাত ঘুম হলো না। চোখের সামনে কেক বানানোর ফর্মুলা ভেসে উঠল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেয়েকে রসুইঘরে ডেকে কেক বানাতে লেগে পড়লাম। এক মুঠো ময়দা-চিনি-সয়াবিনের সঙ্গে কয়েকটা ডিম মিশিয়ে তৈরি হলো কেক। নিজে খেলাম, খুব সুস্বাদু। আরও কয়েক দিন মেয়ের সঙ্গে ওই প্রশিক্ষকের কাছে গিয়ে সাধারণ কেক, প্যাস্ট্রি কেক, চকলেট কেক ও বার্থডে কেক তৈরির কৌশল রপ্ত করলাম।
১০ থেকে ১২ দিন এভাবে কেক বানানো শেখার পর বাড়িতে মা-মেয়ে পুরোদমে কেক বানাতে শুরু করলাম। বানানো কেক প্রথম কয়েক দিন প্রতিবেশীদের খেতে দিলাম। সবাই প্রশংসা করতে শুরু করল। অল্প দিনেই কেকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল পাড়াজুড়ে। কিন্তু কেক বানানোর উপকরণ কিনতে যে খরচ হতো, তা নিয়ে চিন্তায় পড়লাম।
হোটেল ব্যবসার ইচ্ছে থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম তৈরি করা কেক বাজারে বিক্রি করব। স্বামীর বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা কষ্টে জমিয়ে ১০ হাজার টাকায় একটা ওভেন কিনলাম। প্রথম দিকে সারা রাত জেগে প্যাস্ট্রি কেক তৈরি করতাম। সকালে তা ট্রেতে করে নিয়ে শহরের দোকানে দোকানে ঘুরে বিক্রি করতাম। এভাবেই ছোট পরিসরে শুরু হলো আমার উদ্যোগ। ফেরি করে কেক বিক্রি করেছি প্রায় দুই বছর। যে দোকানেই কেক দিতাম, পরদিন সেখানে কেক নিয়ে গেলেই দোকানিরা প্রশংসা করে বলতেন, ‘আপা, সগলি আপনের কেক খ্যায়া খুব প্রশংসা করিচ্চে।’ সবার প্রশংসা শুনে উজ্জীবিত হতাম। খুব ভালো লাগত। এভাবে ছোট পরিপরে ব্যবসা চলল দুই বছর।
আমি ব্যবসা শুরু করেছিলাম ২৭ হাজার টাকায়। এখন ১০–১২ লাখ টাকার পুজি খাটছে কারখানায়। বিক্রয় কেন্দ্রে বিনিয়োগ ২০ লাখ টাকা। আমার রয়েছে চার তলা বাড়ি। কারখানার সঙ্গে রয়েছে ৪৩ শতক জায়গা, যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা ২০০২ সালের দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম, শুধু কেক দিয়ে হবে না, অন্য কিছু তৈরি করতে হবে। ওই বছর পরিচিত একজনের বেকারি কারখানা দেখতে পুরান ঢাকায় গেলাম। কিন্তু সেখানে যেসব বেকারিসামগ্রী তৈরি হয়, তার বাজার বগুড়ায় নেই। গেলাম কমলাপুরের আনার বেকারিতে।
সেখানে পরিচয় হলো কারিগর মজিবর রহমানের সঙ্গে। তাঁর কাছে শিখলাম কেক, বিস্কুট ও চানাচুর তৈরি করা। বগুড়ায় ফিরে সাড়ে ২১ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নামলাম। একটা বড় মাইক্রোওয়েভ ওভেন কিনলাম। শুরু করলাম হরেক পদের বিস্কুট, কেক আর চানাচুর তৈরি। হাতে তৈরি এসব বিস্কুট, চানাচুর আর কেক ফেরি করে বিক্রি করতে আমার সঙ্গে যোগ দিল আমার ছোট ছেলেটিও। সারা দিন সাইকেলে করে শহরের দোকানে দোকানে এসব পণ্য বিক্রি করতে থাকলাম মা-ছেলে দুজন। কিন্তু তখনো কেক-বিস্কুট বানাই অনেকটা ইচ্ছেমতো। নিয়মমতো ময়দা, তেল বা ডিম দিয়ে খামির তৈরি করতে পারতাম না।
২০০৩ সালে ঢাকার কারিগর মজিবর রহমান বগুড়ার আকবরিয়া কনফেকশনারিতে কাজ নিলেন। বাসা ভাড়ার খোঁজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বাড়ির পাশে ওঁকে একটা বাসা ঠিক করে দিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় উঠলেন মজিবর। ভালো সম্পর্ক তৈরি হলো। সারা দিন কারখানায় কাজ করে রাতে বাসায় ফিরে আমাদের বিস্কুট-কেক-চানাচুর তৈরি করা হাতে-কলমে শেখাতে লাগলেন।
বাজারে তখন জলি ফুড প্রোডাক্টসের কেক-বিস্কুট জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। আমার পাশে দাঁড়াল একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। সেখান থেকে ঋণ নিয়ে বাড়িতেই বেকারি কারখানার তন্দুর বসালাম। শুরু হলো নতুন করে সংগ্রাম। কারখানা ও বিক্রয় বিভাগে যুক্ত হলেন অর্ধশত শ্রমিক। উৎপাদিত পণ্য বগুড়ার গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেল জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জসহ আশপাশের জেলায়।
তখন কারখানার উৎপাদন, বিপণন নিজেই তদারক করতাম। নিজেই বাজার ঘুরে কাঁচামাল কিনতাম। একজন নারী হয়ে এত সব সামলাতে হিমশিম খেতে হতো। সৌদি আরবে গাড়ি চালাতেন আমার স্বামী। তাঁকে বললাম, ‘ওখানে কী চাকরি করো তুমি? দেশে ফিরে এসো। আমিই তোমাকে চাকরি দেব।’ তিনি তখন বিশ্বাস করতেই চান না।
অবশ্য সাড়ে ১৯ বছর প্রবাসজীবনের ইতি টেনে একদিন দেশে ফিরলেন আমার স্বামী রমজান আলী। প্রথম দিকে কারখানার কাঁচামাল কেনার দায়িত্ব দিলাম ওঁকে। কিন্তু প্রবাসফেরত মানুষটা ব্যবসা বোঝেন না। বাড়িতে বসেই ডিম কিনতেন। তাতে বাজারের তুলনায় ১০০ ডিমে ৫০ টাকা বেশি খরচ হতো। বুঝলাম তাঁকে দিয়ে এ কাজ হবে না। বড় ছেলে জুয়েলকে দেশে ফেরালাম। সবার বেতন নির্ধারণ করে দেওয়া হলো।
ব্যবসার শুরুতে যেহেতু মেয়ের অবদান রয়েছে, তাই তাকেও প্রতি মাসে আট হাজার টাকা বেতন দিই। এখন স্বামী ও দুই সন্তান আমাকে ব্যবসায় সাহায্য করে। তবে এখনো বাজার ঘুরে ঘুরে নিজেই কাঁচামাল কিনি। বেকিং পাউডার নিজেই তৈরি করি। তবে আগে যেভাবে দোকানে দোকানে ঘুরে বিস্কুট-কেক বিক্রি করতাম, এখন আর তা করতে হয় না। এখন প্রায় ৩০ প্রকারের পণ্য উৎপাদিত হয়। সবই কারখানা থেকে কমিশনে কিনে নিয়ে যান এজেন্টেরা। তাঁরা ডেলিভারি ভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে প্রতিদিন দোকানে দোকানে পণ্য সরবরাহ করেন। শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় নিজস্ব একটি বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছি, তবে সেটা আপাতত নিজে চালাচ্ছি না, ভাড়া দিয়েছি।
আমি ব্যবসা শুরু করেছিলাম ২৭ হাজার টাকায়। এখন ১০–১২ লাখ টাকার পুজি খাটছে কারখানায়। বিক্রয় কেন্দ্রে বিনিয়োগ ২০ লাখ টাকা। আমার রয়েছে চার তলা বাড়ি। কারখানার সঙ্গে রয়েছে ৪৩ শতক জায়গা, যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ এরই মধ্যে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে সফল নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছি।
একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে অন্যদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো: যেকোনো কাজে সফলতা অর্জনের স্বপ্ন দেখতে হবে। সফলতার জন্য প্রচেষ্টা ও আত্মপ্রত্যয় থাকতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সাহস, মনোবল ও লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। হিসাবি হতে হবে। কষ্ট-সংগ্রাম করলে সফলতা কেউ রুখতে পারবে না।
(অনুলিখন) মোছা. জলি বেগম, সফল নারী উদ্যোক্তা, স্বত্বাধিকারী, জলি ফুড প্রোডাক্টস, বগুড়া।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।