ছোটবেলায় পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসতাম। তখন গল্প করতেন সবাই। সেসব গল্প বেশির ভাগ হতো ব্যবসা নিয়ে। কোথাও হয়তো বেড়াতে গেছি কিংবা পারিবারিক আলোচনায় দেখা যেত কী করলে ব্যবসায় আমরা আরও ভালো করতে পারব, এসব নিয়ে বড়রা কথা বলতেন। সেসব শুনতে শুনতেই মনে হয় ব্যবসার প্রতি একধরনের আগ্রহ জন্মেছিল। আবার এটাও জেনেছিলাম যে এ জগৎও সহজ নয়, ভালো-মন্দ বা লাভক্ষতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে বাবা লতিফুর রহমানের গড়া প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (টিডিসিএল) অফিসার হিসেবে যোগ দিই। এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এটি। এসকেএফের সব ধরনের ওষুধ, ডেনমার্কভিত্তিক নোভো নরডিস্কের ইনসুলিন ও ফ্রান্সভিত্তিক সারভিয়ারের ওষুধ বাংলাদেশের আনাচকানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব জায়গায় পৌঁছে দেয় টিডিসিএল। শুধু ওষুধ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন নামী ব্র্যান্ডের কনজ্যুমার ও ডায়াগনস্টিক প্রোডাক্টসও ডিস্ট্রিবিউট করে থাকে তারা।
বাবা যে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, সেখানে আমি উচ্চপদে যোগ না দিয়ে অন্যান্য কর্মীর মতো করে শুরু করি। আমাকে বিপণন, বিক্রয়, অর্থসহ সব বিভাগে কাজ শিখতে হয়েছে, কাজ করতে হয়েছে। এটি শুনলে অনেকে অবাক হয়ে যান।পারিবারিক ব্যবসা বলেই যে আমি উচ্চপদে যোগ দেব, বাবা তেমনটি কখনো ভাবতেন না। তিনি মনে করেন, যিনি যে কাজ ভালো পারবেন, তাঁর তা-ই করা উচিত।
আমার সব বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলে সেটা আমার জন্যই ভালো হবে। সেভাবেই অন্য কর্মীদের মতো কাজে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই আমি এগিয়েছি। এক দিনে আমি আজকের অবস্থানে আসিনি। ২০ বছর আমাকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। ২০১০ সালে আমি টিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছি। এর আগে ২০০৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আমার কর্মজীবনে আরেকটি বড় পরিবর্তন আসে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে। একটি নতুন চ্যালেঞ্জ আসে আমার সামনে। ২৫ বছরের পেশাজীবনে সেটিই আমার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এবং কঠিন একটি সময় ছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠান এসকেএফ বাংলাদেশ লিমিটেডের সে সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হঠাৎ করেই চাকরি ছেড়ে দেন। কান্ডারিবিহীন এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরার প্রস্তাব দিলেন ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমান। এসকেএফের সংকট নিরসনের সেই সভায় তিনি বলেন, ‘সিমিনই এখন দেখুক না কিছুদিন।’ ভাইয়ের কথায় সায় দিলেন বাবাও।
আমার মনে কিছুটা শঙ্কা ছিল। আমি অর্থনীতি ও ব্যবসা নিয়ে পড়েছি। ওষুধশিল্প নিয়ে খুব একটা জানতাম না। এই সময় মা বলেন, তোমাকে পারতেই হবে। তুমি পারবে। নিজেকে অন্যভাবে প্রমাণ করার এটাই তো সুযোগ। আর বাবা শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, ‘হোল ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ইজ ওয়াচিং এসকেএফ।’
মায়ের সাহস ও বাবার পরামর্শ এই দুটো সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করলাম এসকেএফে। এবার নিজেকে প্রমাণ করার পালা। বাইরের মানুষ তো বটেই, প্রমাণ করার ছিল সহকর্মীদের কাছেও। সেই সময়টা আমার কাছে অনেকটা ‘অ্যাসিড টেস্টের’ মতো। কেননা, আপনি নিজে কিছু না পারলে কেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আপনাকে মানবেন, শ্রদ্ধা করবেন। আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা না থাকলে কোনো দিন প্রতিষ্ঠান লাভজনক বা সফল হতে পারবে না।
সেই সময় আমার সঙ্গে ছিলেন অসম্ভব দক্ষ আটজন মহাব্যবস্থাপক। পরিচালকদের মধ্য থেকে আমি ব্যবস্থাপনা কমিটির সমন্বয়ক হিসেবে হাল ধরলাম। প্রথম এক বছরে আশাব্যঞ্জক ফলও পেলাম আমরা। ২০১১ সালে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিয়োগ পাই। পরের বছর ২০১২ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে।
এই বছরটি আমার ও আমাদের কাছে খুব আনন্দের একটি বছর। ব্যবসায়িক সততা ও নৈতিকতা চর্চার কারণে ২০১২ সালের ৭ মে ট্রান্সকম গ্রুপ ও এসকেএফ বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আমার বাবা লতিফুর রহমান সম্মানিত হন ‘অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড’ পদকে।
একটা কথা বলি, ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্মিথক্লাইন ও ফ্রেঞ্চের (এসকে অ্যান্ড এফ) মালিকানাস্বত্ব বাংলাদেশে কিনে নেয় ট্রান্সকম। শুরু হয় এসকেএফের পথচলা। সেই সময় প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং লোকসান ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। আমি যখন দায়িত্ব নিই, তখন বছরে বিক্রয় হতো ৪০০ কোটি টাকা। বর্তমানে এসকেএফের বিক্রি এক হাজার কোটি টাকারও বেশি।
ওষুধশিল্প নিয়ে বাবার দিকনির্দেশনা হলো: আমরা সেই ওষুধই উৎপাদন ও বাজারজাত করব, যা আমি, আমার সন্তান ও তাঁদের সন্তানেরা, আমার আপনজনসহ সবাই নির্দ্বিধায় সেবন করতে পারব। এই নীতি আমি ও আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সব সময় মনে রাখি।
এসকেএফ গুণগত মান রক্ষায় সব সময় আপসহীন। তারই স্বাক্ষরস্বরূপ আমরা পেয়েছি ইএমএ (ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি), ইউকে এমএইচআরএ (ইউনাইটেড কিংডম মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি), টিজিএ (থেরাপিউটিক গুডস্ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অস্ট্রেলিয়া, ভিএমডি (ভেটেরিনারি মেডিসিনস ডিরেক্টরেট) ইউকে এবং ইউনিসেফের মতো বহু প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন।
বর্তমানে ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার মতো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত বাজারসহ বিশ্বের ২২টি দেশে রয়েছে এসকেএফের পদচারণা। ‘প্রযুক্তি স্থানান্তর’-এর মাধ্যমে ডেনমার্কের নোভো নরডিস্কের বিশ্বমানের ইনসুলিন এখন তৈরি হচ্ছে টঙ্গীর এসকেএফের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্লান্টে। নোভো নরডিস্কের বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত সাপ্লাই চেইনের মধ্যে এসকেএফই প্রথমবারের মতো লাভ করেছে ‘সর্বোচ্চ কমপ্ল্যায়ান্স’ রেটিং।
ব্যবসায়ী বলে সামাজিক দায়িত্বশীলতার দিকও ভুলে যাইনি। বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির সঙ্গে এসকেএফ যুক্ত। লোসেকটিলের ‘অ্যাসিডদগ্ধ পুনর্বাসন প্রকল্পে’ অংশগ্রহণ, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে ফ্লুক্লক্সিনের সম্পৃক্ততা, অটিস্টিক শিশুদের বিকাশে জিঙ্কের ভূমিকা—তেমনই কিছু কার্যক্রম। আমার জীবনে কাজ ও পরিবার দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। এরপর শুরু হয় ব্যস্ত দিন। সময় মেনে ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা দিন চলি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বছরে অন্তত একবার হলেও যাওয়ার চেষ্টা করি। সরাসরি চিকিৎসক ও কেমিস্টদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করি। মাঠপর্যায়ে গিয়ে কাজ করলে যেকোনো সমস্যা বুঝতে পারা যায়। দল নিয়ে এগিয়ে যেতে হলে কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার কথাও জানতে হবে। তাঁরা খুশি না থাকলে ভালো কিছু হবে না প্রতিষ্ঠানের জন্য। প্রতিষ্ঠানের সকল ব্যবস্থাপক ও কর্মীদের কঠোর পরিশ্রম, সততা ও স্বকীয়তাকে আমরা মূল্যায়ন করি। চার হাজারের বেশি সদস্যের বৃহৎ এক পরিবার হলো এসকেএফ। তাঁরা প্রত্যেকে যেন এই প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করে কাজ করতে পারেন, সেই পরিবেশ দেওয়া হয় পরিকল্পিতভাবে।
১৯৯৬ সালে ফ্রান্সের বিখ্যাত প্রসাধনী ব্র্যান্ড লরিয়েলের ভোক্তা বিভাগটি (কনজ্যুমার ডিভিশন) পরিচালনার কাজ শুরু করেছিলাম। এখান থেকে শুরু হয় আমাদের কনজ্যুমার বিজনেস ডিভিশন (সিবিডি)। এরপর একে একে যুক্ত হয় গার্নিয়ার, হাইনজ ও মার্সসহ বেশ কিছু বিশ্বসমাদৃত ব্র্যান্ড। এভাবেই পেপসিকোর ফুড ডিভিশন ফ্রিটলের লেইস ও কুড়কুড়ে নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করি। এর মধ্য দিয়েই আমরা পেপসিকোর গ্লোবাল ফুড ফ্র্যাঞ্চাইজি বিভাগের আস্থা অর্জন করি এবং সারা বিশ্বের মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশে তাদের হয়ে খাদ্যপণ্য উৎপাদনের অনুমোদন পাই। অন্য সব দেশে পেপসিকোর ফুডের সকল পণ্য তাদের তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পেপসিকো ফুডের কুড়কুড়ে তৈরি হচ্ছে টিসিপিএলের তত্ত্বাবধানে। পরে অন্য ব্র্যান্ডগুলোও তৈরি হবে। এ জন্য বগুড়ায় একটি অত্যাধুনিক ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা হয়েছে।
গত বছর পেপসিকোর চেয়ারপারসন ও সিইও ইন্দ্রা কে নুই প্রথমবারের মতো আসেন বাংলাদেশে। টিসিপিএলের বিশ্বমানের ফ্যাক্টরি ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার প্রতি তাঁর সন্তুষ্টি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আমার এমন কর্মব্যস্ত জীবনের কথা শুনলে বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, হয়তো পরিবারে পুরোপুরি সময় দিতে পারি না। আমার জীবনে কাজ ও পরিবার দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। এরপর শুরু হয় ব্যস্ত দিন। সময় মেনে ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা দিন চলি। আমার সকল কাজে স্বামীর সাহায্য পাই।
আমার দুই ছেলে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করছে। ওরা এখানে যখন স্কুলে পড়ত, ওদের কোনো স্পোর্টস ডে, প্যারেন্টস-টিচার মিটিং ডে-তে যাইনি এমনটি হয়নি। আবার এর জন্য প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে, তেমনটিও হয়নি। ব্যবসার জায়গায় কিংবা করপোরেট জগতে পুরুষের আধিক্য বেশি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকার মন্ত্র তো মা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। মা বলতেন, এটি পুরুষদের দুনিয়া। নিজেকে প্রমাণ করতে একজন পুরুষের থেকে তোমাকে ১০ গুণ বেশি কাজ করতে হবে।
মায়ের কথা মনে রেখে সেই চেষ্টাই করেছি। দিনে অন্তত একবার মা-বাবার সঙ্গে বসে চা-কফি খাই। এমন মা-বাবা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা কতখানি, তা লিখে বোঝানো যাবে না। কাজের বাইরে পুরো সময়টুকু যেহেতু শুধুই পরিবারের, তাই সামাজিক জীবন কিছুটা অবহেলিত হয়েছে। তা নিয়ে অবশ্য আমার কোনো অনুশোচনা নেই। একসঙ্গে সবকিছু করতে গেলে সাফল্য আসে না। পার্টি, আড্ডা এই বিষয়গুলো আমাকে টানে না। তা করতে গেলে হয়তো এত কাজ করতে পারতাম না।
আমি কাজ দিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। আমার জীবনের পরামর্শক হলেন বাবা লতিফুর রহমান। মা শাহনাজ রহমান অনুপ্রেরণাকারী। আমি মনে করি, সততা, নৈতিকতা, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ভালো পণ্য, সময়োপযোগী যোগ্য ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক সফলতা হলো আমাদের মূল শক্তি। সব সময় মাথায় এটি রাখি বলেই প্রতিষ্ঠানের কঠিন সময়গুলো পার করতে পারছি। আমি বিশ্বাস করি, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের পেছনে দূরদৃষ্টি ও উৎসাহ–উদ্দীপনা জোরালোভাবে থাকতে হবে। এই দুইয়ের সমন্বয় ভালো হলে সাফল্য আসবেই।
সিমিন হোসেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এসকেএফ, টিসিপিএল, টিডিসিএল।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো ডটকম।